আসন্ন বাজেটঃ উন্নয়ন ও পাবনা

আসন্ন বাজেটঃ উন্নয়ন ও পাবনা
রণেশ মৈত্র (একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক)
সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

২০১৯-২০২০ সালের বাজেট আসন্ন জুন অধিবেশনে পাশ করা হবে এবং জুলাই থেকে তা কার্য্যকরী হওয়ার কথা। এ কথা ভাবাই যায়, খসড়া বাজেট প্রণয়ন কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে এবং এখন হয়তো তার ঝাড়াই-বাছাই চলছে। আসন্ন ঈদু-উল-ফিতরের অব্যবহিত পরেই সম্ভবত: জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই অধিবেশ সুরু হবে।

অতীতে কয়েকবার লিখেছি দেশে উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা নেহাতেই অসম। অসম উন্নয়নের দ্বারা দেশের সামান্য কিছু মানুষ উপকৃত হতে পারেন কিন্তু সকল এলাকার মানুষের ভাগ্যে সে উন্নয়ন কোন প্রভাব ফেলতে পারে না পারে না সমভাবে তার ফলভোগ করতে। সুতরাং সুষম উন্নয়ন ও সম্পদের সুষম বণ্টনের পথে যাত্রা সুরু করা জরুরী প্রয়োজন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারও তাই। কিন্তু কোন এক দুঃসহ কারণে, বাজার অর্থনীতির দৌরাত্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে সম্পদের অসম বন্টন-ব্যবকস্থার ফলে ঢাকা শহরে কতই না জৌলুষপূর্ণ বিশ তলা, পঞ্চাশ তলা, শত তলা বিশিষ্ট প্রাসাদোপম দালান-কোঠা হরহামেশাই নির্মিত হচ্ছে কিন্তু দরিদ্রজনদের জন্য ফুটপাতও জুটছে না।

আবার জেলাওয়ারীভাবে দেখলে দেখা কোন কোন জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু বেশীর ভাগ জেলায় তা না হয়ে এক চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা জেঁকে বসছে। তেমনই নিষ্ঠুর বৈষম্যের স্বীকার পাবনা জেলা। যদিও উত্তরবঙ্গের সকল জেলাকেই প্রায় বৈষম্যের শিকার বলে অভিহিত করা যায়।

এই বৈষম্য দূর করে সুষম উন্নয়ন বিধান করা কিছুটা কঠিন বলে মনে হলেও তা আদৌ অসম্ভব কিছু না। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। একের পর এক জেলা-উপজেলা-বিভাগ তৈরী করা অযৌক্তিক এবং জনস্বার্থ বিরোধী হলেও আমরা দিব্যি তা করে চলেছি।

নিবন্ধটির পরিসরের কথা ভেবে পাবনার উন্নয়ন নিয়ে জনগণের দীর্ঘদিনের সর্বসম্মত দাবীগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই বাজেটকে সামনে রেখে। বিস্ময়কর হলো, দাবীগুলি দীর্ঘদিনের হলেও তার প্রতি আজও প্রায় নজর দেওয়া হয় নি।

রেল যোগাযোগ। এই দাবীটির বাস্তবায়ন হলে যে বহুমুকী সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হবে তাতে গোটা দেশের মানুষই উপকৃত হবে। সেই ইংরেজ আমলে কলকাতার সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের স্বার্থে কলকাতা থেকে ঈশ্বরদী-সান্তাহার-পার্বতীপুর রেলপথটি নির্মিত হয় তবে তা বহুমুখী উপকার সাধন করে সংশ্লিষ্ট এাকার জনগণের। সিরাজগঞ্জে কাগজকল প্রতিষ্ঠার পর ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথটি নির্মিত হলেও তাতে বিশাল এলাকার চাষীরাও উপকৃত হতেন। ঐ এলাকা মাছ, দুধ, ডিমের ব্যাপক উৎপাদনের ফলে সেগুলি রোজ কলকাতায় চালান দিয়ে কৃষকদের ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন সাধনে তা সক্ষম হয় যদিও এগুলির বৃহৎ ব্যবসায়ীরা উৎপাদকদের তুলনায় অনেক বেশী লাভবান হন। নানা কাজে এক স্থান থেকে সস্তায় অপর স্থানে যাওয়ার সুযোগ সুবিধাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এতে উপকৃত হতেন মাত্র ৫/৭ টি গ্রামীন উপজেলার মানুষ সকল এলাকার জনগণ নন।

তাই দাবী ঈশ্বরদী থেকে পাবনা শহর দিয়ে আতাইকুলা-মাধপুর-বনগ্রাম-দুলাই-কাশীনাথপুর-নগরবাড়ী পর্য্যন্ত রেলপথ নির্মিত হোক। মাঝখানে যমুনা নদীতে আরও একটি সেতু নির্মাণ করে আরিচা ঘাটের সাথে সংযুক্ত করে একেবারে আরিচা-ঢাকা রেল পথ নির্মাণ করে সমগ্র উত্তর বঙ্গের বিশেষ রাজশাহী বিভাগের সকল জেলার মানুষের জন্য নানা কাজে, (চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি) স্বল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করা হোক। এই দাবী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আমলে ইতিবাচক উদ্বোধন হলেও তাঁর হত্যালীলার পর প্রকল্পটি হিমঘরে পাঠানো হয়।
অতঃপর বছর দশেক আগে ব্যাপক সংশোধনী এনে ঐ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলেও এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাতে অগ্রগতি ঘটেছে সামান্যই। ঈশ্বরদী থেকে পাবনা এবং পাবনা থেকে রাজশাহী পর্য্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করার পর একটি মাত্র ট্রেন, পাবনা এক্সপ্রেস নামে, দিনে একবার মাত্র পাবনা রাজশাহী রুটে যাতায়াত করতে পারা যাচ্ছে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর এ অগ্রগতিকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও পাবনার পূর্ব বর্ণিত মৌলিক দাবীটি কত শতাব্দীতে পূরণ হবে তা গবেষণা সাপেক্ষ।

সুচিত্রা এক্সপ্রেস
এ প্রসঙ্গে মানুষের জরুরী দাবী পাবনা থেকে যমুনা সেতু দিয়ে ঢাকা পর্য্যন্ত সুচিত্র সেন স্মরণে “সুচিত্রা এক্সপ্রেস” নামে অবিলম্বে একটি নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু করা হোক।

অপরপক্ষে মূল প্রকল্প থেকে সরে গিয়ে দুই সাবেক মন্ত্রী পাবনা থেকে সুজানগর-আমিনপুর-কাশীনাথপুর-বেড়া হয়ে রেলপথ টেনে নিয়ে মানিকগঞ্জের কোন একটি স্থানের সাথে ফেরী যোগাযোগের ব্যবস্থা করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই সংশোধিত রেলপথ নির্মিত হলেও তা বাণিজ্যিক সফলতা পাবে না বরং মূল যে পরিকল্পনাটি পাবনা-আতাইকুলা-মাধপু-বনগ্রাম, দুলাই-কাশীনাথপুর-নগরবাড়ী পথটি নির্মিত হলে তা স্পল্পতর ব্যয় সাধ্য হবে এবং বাণিজ্যিক সফলতাও নিশ্চিত হবে। তাই অবিলম্বে নগরবাড়ী পর্য্যন্ত আতাইকুলা হয়ে রেলপথ ও নগরবাড়ী পাটুরিয়া সেতু (রেল ও বাস চলাচল উপযোগী) নির্মাণ করে এবং অতঃপর পাটুরিয়া ঢাকা রেলপথ নির্মানের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রকল্প অনুমোদন করে আসন্ন বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জাতীয় অর্থনীতি যথেষ্ট পরিমাণে উপকৃত হবে এবং বর্তমান যমুনা সেতুর উপর দিয়ে চলাচলকারী নানাবিধ পরিবহণের চাপও অনেক কমবে।

এবারে আসি ইছামতী নদী উদ্ধার প্রসঙ্গে: এই দাবীটিও দীর্ঘদিনের নদীটি পদ্মা থেকে উৎপত্তি হয়ে পাবনা শহর দিয়ে সদর উপজেলা, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় গিয়ে হুড়া সাগর তথা যমুনাতে গিয়ে পড়েছে।

আমাদের ছোটবেলায় এই নদী বর্ষাকালে বিশাল ও ¯্রােতস্বিনী রূপ ধারণ করতো, শহর ও গ্রামের বহু আবর্জনা বয়ে নিয়ে গিয়ে শহর গ্রাম পরিস্কার করতো, বেড়া-পাবনা নৌ চলাচল এবং পণ্য আমদানী-রফতানীর ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখতো। কিন্তু ইংরেজ আমলে শিতলাই জমিদারীদের বিশাল অট্টালিকা পদ্মার ভাঙনের কবলে পড়ার উপক্রম হলে পদ্মা ও ইছামতীর সংযোগস্থলে একটি মজবুত বাঁধ নির্মাণ করায় এখন আর বর্ষাতে পানি আসে না এক ফোঁটাও। যমুনা নদীর সংযোস্থলেও বিশাল চর উঠে যমুনার জলও ইছামতীতে আর ঢুকতে পারে না ফলে নদীটি শুকিয়ে ক্ষীর্ণকায় হয়ে পড়েছে। ভূমি গ্রাসীরাও অবৈধ কাগজপত্র তৈরী করে ইছামতীর উভয় পাশে বিশাল বিশাল দালানকোঠা তুলে নদীটির অস্তিত্বকেই হুমকিতে ফেলেছে। এখন ইছামতী একটি সরুখাল মাত্র। তাই সি.এস.খতিয়ান অনুযায়ী ইছামতী নদীর সীমানা নির্ধারণ এবং ঐ সীমানার মধ্যে নির্মিত সকল প্রকার স্থাপন অবৈধ হওয়াতে তা ভেঙ্গে ফেলে দ্রুত সকল এলাকা দখলে নিয়ে নদীটির ব্যাপক খনন কার্য্য করে তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও গভীরতা নিশ্চিত করে পদ্মার মুখে নির্মিত বাঁধ ভেঙে ফেলে পদ্মার জল প্রবাহ ইছামতী দিয়ে আগের মত প্রবাহিত করতে হবে পরিবেশ, নৌ-চলাচল, সেচ কার্য্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ পুনরায় চালু করার উদ্দেশ্যে। এতে যেমন কৃষি পণ্য উৎপাদন বাড়বে, তেমনই আবার বিপুলভাবে বাড়বে মৎস্য উৎপাদন।

এ প্রকল্প ইতোমধ্যেই গৃহীত হয়েছে বলে শুনি। যদি তা হয়ে থাকে তবে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন যাতে জুলাই আগষ্ট বা বর্ষা থেকেই ড্রেসিং শুরু করা যায়। তার আগে নানাবিধ স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার কাজ এখুনি শুরু করা প্রয়োজন। ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় পাবনার মানুষের এই দাবীটি পূরণে কোন অজুহাতেই যেন আর বিলম্ব করা না হয়।

স্বাস্থ্য
সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়েই কোটি কোটি মানুষ স্বাস্থ্য-চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্যায় সেই আদ্যিকাল থেকে ভুগে চলেছেন। আজ এই একবিংশ শতাব্দী যখন প্রায় তার মধ্যগগণে উঠতে চলেছে, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যখন সারা বিশ্বেও সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে, চিকিৎসা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তখন পাবনার সরকারী হাসপাতালগুলিতে আসন সংখ্যার তীব্র অভাব, হাসপাতালের ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন করা ওষুধ হাসপাতালে না পাওয়া, ডাক্তার-নার্সের মারত্মক স্বল্পতা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভয়াবহ দুষ্প্রাপ্যতা এই সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটি এমনই যে যে কোন রোগীকেই সামান্য যে কোন রোগের চিকিৎসার জন্যেই ছুটতে বাধ্য হন ঢাকাতে। অবশ্য যদি সেই রোগীর বা তার অভিভাবকদের সামান্যতম স্বচ্ছলতা থাকে। ঢাকায় দৌড়াতে হয়।

রোগীকে ঢাকায় নিয়ে গেলেও ভর্তি করা এক দুঃসহ ব্যাপার যেন একটি যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। আসন সংখ্যার স্বল্পতার কারণেই এমনটি ঘটে থাকে এবং সেই সুযোগে ভর্তির ক্ষেত্রে অনেক দুর্নীতির অভিযোগও শুনা যায়। সাধারণত: ভর্তি হতেই সপ্তাহ খানে লেগে যায় যদি সেই রোগী বা তার অভিভাবকদের উপরতলায় প্রভাবশালী কারও সাথে প্রভাব না থাকে।
এভাবে সঙ্গতি সম্পন্ন রোগীরা তাদের চিকিৎসা সুবিধার্থে আদায় করে নিতে পারলেও বেশীর ভাগ রোগীই চিকিৎসা নিতে না পেরে চরম ভোগান্তীর মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হন।

এমন পরিস্থিতি আর কতোকাল? পাবনাতে সরকারী জেনারেল হাসপাতালটিকে কমপক্ষে ১০০০ বেডে উন্নীতকরণ, সকল বিভাগে উপযুক্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ, চিকিৎসকদের শ্যূন্য আসনগুলি পূরণ, নার্সদের সংখ্যা স্বলপতা দূরীকরণ অবিলম্বে করা প্রয়োজন। আমরা যেন ভুলে না যাই স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার এবং এ সংক্রান্ত সুযোগহ-সুবিধা সকল নাগরিকই প্রয়োজন অনুযাী পেতে অধিকারী এটি আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে। সেই অধিকার কার্য্যত: হরণ করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি না করে। এদিকে লক্ষ্য দেওয়া সমস্যাগুলি দূর করাও অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বেও অন্তর্গত।

শিক্ষা
শিক্ষাক্ষেত্রে বহিরাঙ্গনে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে মানতে কোন দ্বিধা নেই। যত সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও নানা পর্য্যায়ের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা কল্পনাতীত। ছাত্র সংখ্যাও অবিস্বাস্য হারে বেড়েছে। কিন্তু এর পরেও শিক্ষার উন্নয়ন ঘটছে বা ঘটেছে এমন দাবী করা যাবে কি? বস্তুত: শিক্ষার উন্নয়ন বলতে বুঝায় শিক্ষার মানোন্নয়ন। সেই ক্ষেত্রে আমরা অধিকতর অবিশ্বস্য রূপে পিছিয়ে আছি এবং এগুলোর বিন্দুমাত্র লক্ষ্মনও চোখে পড়ছে দেখে আতংকিত বোধ করি।

দেহের ওজনের চেয়ে অনেক বেশী অনবরত পরীক্ষা নেওয়ার নামে ছেলেমেয়েদের আটকে রেখে, জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ার প্রতিযোগিতার সাথে সাথে অধিক সংখ্যায় পাশ করানো হলেও মানের অবনতি ভয়াবহ। উচ্চতর শিক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হবে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল , হাজী মোঃ মোহসিন, বেগম রোকেয়ারা শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে হরিয়ে যেতে বসেছেন-এটিও কম সংকার কথা নয়। তাই এদিকে নজর দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!