সার্থক জীবন আমার: ৮৭ তম জন্মদিনের কথা

সার্থক জীবন আমার: ৮৭ তম জন্মদিনের কথা
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতী মন্ড-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পৈত্রিক বাসস্থান পাবনা জেলার সাবেক সাঁথিয়া থানার ভুলবাড়ীয়া নামক অজ পাড়াগাঁয়ে হলেও আমার জন্ম হয়েছিল রাজশাহী জেলার ন’হাটাতে আমার দিদিমনির আগ্রহে। ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর তারিখে আশ্বিনের হালকা শীতল আবহাওয়ায়।

কিন্তু জন্মের দু’এক মাসের মধ্যেই মায়ের কোলে চড়ে চলে আসি ইছামতী নদী তীরবর্তী ভুলবাড়িয়াতে। হামাগুড়িদিয়ে চলা হাঁটা শেখা-দৌড়ানো সব ঐ গ্রাম থেকেই শিখেছিলাম। আজ দৌড়ানো নিষেধ, খোলামেলা জায়গাও নেই, নেই কোন মাঠও দৌড়ানোর মত। তবে বৃষ্টি না থাকলে আর অত্যধিক এবং অসহনীয় গরম না পড়লে সকাল বেলায় ঘন্টাখানেক হাঁটি। ওতেই যথেষ্ট আরাম বোধ করি, শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধে তৃপ্তি পাই।

বাবা প্রয়াত রমেশ চন্দ্র মৈত্র ছিলেন ভুলবাড়িয়া গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ভাল শিক্ষক এবং সৎ মানুষ হিসেবে। সে কালে গ্রামে রাজনীতির প্রচলন ছিল না-তাই তিনি ছিলেন রাজনীতির সংশ্রবহীন। তবে ছিলেন মাহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের ভক্ত।

সে কালে গ্রামে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল না। কিন্তু বাবা সংবাদপত্র ভক্ত। তখন অবিভক্ত ভারত। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আনন্দবাজার রাখতেন। ডাকে আসত।

সে কারণেই কি সংবাদপত্র ভক্ত আমিও হয়েছি সেই বাল্যকাল থেকে? বাবাকে হারাই ১৯৫৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলাম তখন। এডওয়ার্ড কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি।

অসাধারণ জনপ্রিয় এবং কৃষক দরদী ছিলেন আমার বাবা। তাই আদৌ কোন রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও কৃষকদের অনুরোধে তিনি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক কর্তৃক প্রচলিত ঋণ সালিশী বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ভুলবাড়িয়া ইউনিয়নের। এই বোর্ডের উদ্দেশ্য ছিল ১৩৫০ এর ভয়াবহ মন্বন্তরে (পঞ্চাশের মন্বন্তর) যে কৃষকেরা পেটের দায়ে জমি জলের দামে বিক্রী করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যৌক্তিকতা বিবেচনা করে সেই জমিগুলি উদ্ধার করে তার মালিক কৃষকদের কাছে প্রত্যর্পণ করা। যতগুলি আবেদন বাবা পেয়েছিলেন তার সবগুলি জমি উদ্ধার করে তিনি কৃষকদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
মা ননীবালা মৈত্র ছিলেন গৃহিনী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তাঁর ঘটে নি পারতেন শুধুমাত্র নাম স্বাক্ষর করতে। কিন্তু কি অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিলো মায়ের।রামায়ন মহাভারত, এই দুটি বিশাল গ্রন্থ ছিল তাঁর মুখস্ত। হাতের রান্না ছিলো অপূর্ব। গ্রামের অনেকে চেয়ে নেমন্তন্ন নিতেন। মায়ের রান্না খাওয়ার লোভে। কিন্তু নিজের কোন অহংকার ছিল না বা কোন লোভ ছিল না।গরীবকে ভালবাসতেন। লোভ লালসাহীন ও গরীব প্রীতি বাবা-মা উভয়েরই ছিল।

চেষ্টা করেছি ঐ ধারাকে আজীবন ধারণ করার জন্যে। পেরেছিও এ যাবত কাল পর্য্যন্ত। জীবনের বাকী ক’টা দিনও পারব বাবা-মায়ের ঐ দুটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে। আমি এবং আমার সহধর্মিনী পূরবীও। সংসার জীবনে নানা ঝড়-ঝঞ্ঝা অতিক্রম করেছেন তিনি। দারিদ্র্য কদাপি তাঁর পিছু ছাড়ে নি। আমার দীর্ঘ কারাজীবনে একদিকে নিজের উদ্যোগে ইন্টারমিডিয়েট ও ¯œাতক ডিগ্রী অর্জন ও ¯œাতকোত্তরও এক বছর পড়েও শারীরিক কারণে মাষ্টার্স দিতে পারেন নি। আমার দীর্ঘদিন জেল জীবনে তাঁকে একাই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে এবং সন্তানদের লালন পালন শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থাও করতে হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এক্ষেত্রেও পূরবী সফল।

বাবার প্রাইমারী স্কুল থেকেই চর্তুথ শ্রেণী পর্য্যন্ত ভুলবাড়িয়াতে পড়াশুনা শেষ করে ভুলবাড়িয়া গ্রাম থেকে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে তিন মাইল দূরে আতাইকুলা হাই স্কুলে পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্য্যন্ত পড়ি। আতাইকুলা হাই স্কুলের স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক সুধীর ঘোষ, ইংরেজী ও ইতিহাসের শিক্ষক সুরেন্দ্র নাথ সিংহ ও এম. এ. ইসহাকের ¯েœহের ছাত্র ছিলাম বলে আজও গর্ববোধ করি।

অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম ১৯৪৮ সালে। পাবনা শহরে চলে এলাম বাবা-মা-ভাই-বোন সহ স্থায়ীভাবে। ঐ বছরেই শুরু হলো ভাষা আন্দোলন তাতে অংশ নিলাম। ভর্তি হয়েছিলাম পাবনা গোপাল চন্দ্র ইনষ্টিটিউশনে। তখন অত্যন্ত নাম করা স্কুল ছিল সেটি। ওখানে একগুচ্ছ ভাল শিক্ষকের সান্নিধ্য পেলাম। প্রধান শিক্ষক রাধাবিনোদ বসাক, সহ প্রধান শিক্ষক মথুরা নাথ মুখার্জী, হরিপ্রসাদ ঘোষ, জ্যোতিভূষণ চাকী-যাঁদের সান্নিধ্য গ্রাম থেকে আসা আমাকে বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছে, পৃথিবীটাকে দেখতে ও বুঝতে শিখিয়েছে। ঐ স্কুল থেকেই ১৯৫০ সালে ঢাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত সেকে-ারী এডুকেশন বোর্ডের নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে উর্ত্তীণ হই বোর্ডের প্রথম ব্যাচে।

এবারে জীবনের প্রথম চাকুরী নিতে হলো পাবানর প্রথম ওষুধ প্রস্তুত কারখানাএডরুক লেবরেটরীজ (ইষ্ট পাকিস্তান ড্রাগস এন্ড কেমিক্যালস্) লিমিটেডে তাদের অফিস সুপারিন্টে-েন্ট হিসেবে। নেহায়েতই সাংসারিক আর্থিক দৈন্য কিছুটা হলেও ঘুচানোর লক্ষ্যে। দু’বছর চাকুরী করে সংসারের দৃশ্যমান কোন উন্নতি না হওয়ায় বাবার অনুমতি নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই ১৯৫২ সালে। তার আগেই সংগঠিত করি ভাষা আন্দোলন অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে।

১৯৪৭ সালে উগ্র সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে। শুরু হয় রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক, সামাজিক বিভাজন ও সকল ক্ষেত্রেই মারাত্মক শূণ্যতা ও সংকট। ভাষা আন্দোলন বাঙালি মুসলমানদের সজাগ, সচেতন করতে সহায়ক হলো। তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হতে থাকলো অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চিরায়তবাঙালি সংস্কৃতিতে। মেঘাচ্ছন্ন রাজনৈতিক সাংষ্কৃতিক আকাল পরিচ্ছন্ন করার প্রয়োজনীয়তা অনূভূত হলো। সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা এক ঝাঁক তরুণ পাবানতে গড়ে দুলি “শিখাসংঘ” নামে এক প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথকে আড়াল করার অপচেষ্টা এবং নজরুলকে বিকৃতভাবে উপস্থানের উদ্যোগ প্রতিরোধই ছিল শিখা সংঘ গড়ে তোলার মূল প্রেরণা।

মার্কসবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য অধ্যায়নের শুরু শিখাসংঘ থেকেই। একই প্রেরণায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করা এবং এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তির পর সদ্য গঠিত “পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের” পাবনা জেলা সাংগঠনিক কমিটি গঠন করে দেশব্যাপী বাম-প্রগতিশীল আন্দোলনের উন্মেষ ঘটানোর প্রচেষ্টায় সক্রিয় অংশীদার হওয়া। একের পর এক ঘটনা দ্রুতই ঘটে যাচ্ছিল-দেশ বিভাগের পর অসাম্প্রদায়িক প্রথম সংগঠন হিসেবে যুবলীগের এবং প্রথম সাম্প্রদায়িকতা-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের আত্মপ্রকাশ পংকিল রাজনীতি ও মেঘাচ্ছন্ন সাংস্কৃতিক চেতনায় বেশ জোরে সোরে আঘাত হানতে সুরু করা গেল। গতি ছিলো দুর্বার এক অচলায়তন ভেঙ্গে নতুন সূর্য্যােদয়ের পথ রচনার প্রয়াসের।

এ দুটি নব গঠিত ছাত্র যুব সংগঠন বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারায় মানুষকে ফিরিয়ে আনায় বিপুল অবদান রাখতে পেরেছিল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (১৯৪৮ সালে গঠিত) এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে (১৯৪৯ সালে গঠিত) অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত করতে সংগঠন দুটির অভ্যন্তরে তখনও দুর্বল অবস্থানে থাকা অসাম্প্রদায়িক অংশে সাথে মিলে মিলে নতুন উদ্বুদ্ধ করতে যুগান্তকারী ভূমিকা।ঐতিহাসিক ঐ সময়টাকে বাঙালির নব উত্থানের জন্য অপরিহার্য্য তিত গড়ার সময়। ঐ ক্রিয়াকালে হাজারো সহযোদ্ধার সাথে নিজেও সাধ্যমত অবদান রাখতে পেরে গর্বিত বোধ করি। তাবৎ প্রগতিমুখীন আন্দোলনের জন্য অবকাঠামো তৈরি অর্থাৎ সংগঠন বা চেতনা সমৃদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলার যুগ ছিল তখন। যুগটি ছিল আক্ষরিক অর্থেই বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই ঘরে ফেরার যুগ। আর ঘরে ফেরানোর লড়াকু সৈনিক ছিলাম আমরা।

পঞ্চাশের দশক ছিল গড়ার যুগ। তাবৎ প্রগতিশীল আন্দোলন ও চেতনার উন্মেষের দশক যার সফলতার উপর ভিত্তি করেই আরও অধিক সংখ্যায় মিলিত হয়ে ষাটের অগ্নিঝরা দশক গড়া সম্ভব হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের মত শূণ্য হাতে শুরু করতে হয় নি ষাটের দশকের ঐতিহাসিক দুনিয়া কাঁপানোর অসাধারণ বিপ্লবী কর্মকা-। আর পঞ্চাশ ষাটের মিলিত ধাক্কাতেই রাতের আঁধার কাটানো, সূর্য্যরে আবাহন শুরু করার বিপ্লবী পরিবেশ রচনা করে। এতে (ষাটের দশকে) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা, ছাত্রসমাজের এগার দফা শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করে সকলেরসম্মিলিত আঘাতে একাত্তরের সংগ্রাম ও বিজয় গাথার রচনা। সবগুলিতে পর্য্যায়ক্রমে ভূমিকা রাখার অংশীদার হওয়ার গৌরব ধারণ করি গর্বের সাথে। প্রায় একা থেকে উল্লম্ফনে লাখে পণিত হওয়া অসাধারণ এক গৌরবের ইতিহাস।

ইতিহাসের বাঁক ঘোরানো গেল। তার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান (ইনিমহানায়ক)। তা ছাড়াও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড মনি সিংহ, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর এবং আরও অনেকে। সম্ভবত: পরের সারিতে যে অগণিত নেতা কর্মী ক্লান্তিহীনভাবে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন ক্ষুদ্র হলেও তাঁদেরই একজন পাবার ফলে ইতিহাসের নির্মাতা অবশ্যই হতে পেরেছি।

১৯৫৮ সালের শুরুতে বি.এ.পাশ করে কঠিন সামরিক শাসনের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার চাকুরি গ্রহণ অতঃপর বিয়ের বাজনা বেজে উঠলো। নাটোরের সাবেক জোতদার শ্রদ্ধেয় সুধীর নাথ তালুকদার ও এর প্রথম সন্তান পূরবী এলেন ঘরে সহধর্মিনী হিসেবে। স্কুল থেকে কোয়ার্টার বরাদ্দ হলো তাই সংসার জীবনের শুরুও পাকশী থেকেই।
১৯৫৫ তে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৫৭ তে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনে ভূমিকা রাখি। চীন-রাশিয়ার আদর্শিক দ্বন্দ্ব প্রচ-ভাবে নাড়া দিল প্রগতিশীল রাজনীতিতে। ১৯৫৭ তেই গোপন কমিউনিষ্ট পার্টির সদ্যপদ আনুষ্ঠানিকভাবে পেলাম। কাজ ন্যাপের মধ্যেই করে গেলাম আজীবন সামান্য বিরতিসহ। গোপন কমিউনিষ্ট পার্টি ভাঙ্গলো। ভাঙ্গলো ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও রুশ-চীন দ্বন্দ্বের অভিঘাতে। চীন পন্থীরা আইউবকে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধীবলে আখ্যা দিয়ে ঐ সামরিক শাসকের পক্ষে দাঁড়ানোকে ন্যাপের বৃহত্তর অংশ আমরা রুশ পন্থী বলে অভিহিত অংশে বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলননের মূল ধারায় ১৯৬৯ সালে ন্যাপের রিকুইজিশান কাউন্সিল অধিবেশন থেকে।

অত, গণ-অভূত্থান, ৭০ এর নির্বাচন,ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, অসহযোগ আন্দোলন এবং সর্বশেষ নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহাসিক বিজয়। মাঝখানে ১৯৫৪ তে প্রথম এবং ১৯৭৭এ শেষবারের মত প্রায় ১৫ বছর বিনাবিচারে আটক।
সংসার? সেটির হাল ধরে থাকলেন দৃঢ়ভাবে সহধর্মিনী পূরবী আমাদের পাঁচ সন্তানসহ। পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে দু’বছর বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে শিক্ষকতা করে অত:পর বামপন্থী শিক্ষক বিতাড়নের আইউবী। আজগুবি সিদ্ধান্তে বেসরকারি বিদ্যালয়ে চাকুরিটাও রক্ষা করতে পারা গেল না। কমিটি, ছাত্র, শিক্ষক অভিভাবকদের মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতেহয়েছিল। আরও অনেকের ক্ষেত্রেই সমগ্র দেশজুড়ে তাবৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।

সপরিবারে স্থায়ীভাবে পাবনা চলে আসা। চাকুরির সন্ধান করাকালে হঠাৎ জানা গেল তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইত্তিয়ার পূর্ব পাকিস্তান অংশে অফিস সহকারী পদে লোক নেওয়া হবে। দরখাস্ত করলাম লিখিত পরীক্ষা দিলাম ব্যাংকটির পাবনা শাখা কার্য্যালয়ে। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী তাদের শাখা অফিসগুলোতেই ঐ পরীক্ষায় অংশ নেন আবেদনকারীরা। অত:পর অপেক্ষা।

ইতোমধ্যেই ঢাকায় সংবাদ কার্যালয়ে বার্তা বিভাগের ডেস্কে চাকুরি। বেতন সামান্য এবং অনিয়মিত।
আকস্মাতৎ জানা গেল ব্যাংকের পরীক্ষার্থী সারা প্রদেশে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রথম স্থান পাওয়াতে চাকুরিটি নিশ্চিত হয়েছে-শীঘ্রই নিয়োগপত্র আসবে। শ্রদ্ধেয় রণেশদার (রণেশ দাশগুপ্ত) সাথে আলাপ করলে তাঁর পরামর্শে চলে এলাম পাবনায়। আবারও অপেক্ষা। নিয়োগপত্রে ঊর্ধতন কর্মকর্তর স্বাক্ষর হওয়ার খবরও ঢাকা থেকে পাওয়া গেল জানা গেল পাবনা শাখাতেই যোগদিতে হবে। কিন্তু দীর্ঘঅপেক্ষায়ও এলা না নিয়োগপত্র। অতঃপর জানা গেল নিয়োগপত্রটি ডেসপ্যাচ সেকশনে গোয়েন্দা বিভাগ আটকে দিয়েছে-তারা বলেছে সরকার চায় না আমাকে নিয়োগ দেওয়া হোক। তাই নিয়োগপত্র আর এলোই না।

১৯৫১ সালে থেকে সাংবাদিকতা করে আসছি-তাতে কোন বেতন ছিল না। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে বেতন বোর্ড রোয়েদাদের ভিত্তিতে কোন কোন পত্রিকা জেলা সংবাদ দাতাদের জন্যে নামমাত্র লাইনের প্রথা চালু করে বটে কিন্তু তা নিতান্তই সামান্য। ফলে বিকল্প উপার্জনের পথ সন্ধান। পূরবীর প্রচেষ্টায় জেলে বসে আইন পাশ করে বাইরে এসে ওকালতি প্রায় ২৫ বছর।

অতঃপর শ্রবণ শক্তির মারাত্মক বিলোপের কারণে ওকালতি বর্জন ১৯৯৯ সাল থেকে। আবরও পূর্বাবস্থা। ২০০১ থেকে কলাম লেখা আজ অব্যাহত। উপার্জন তথৈবচ। এর মধ্যে নিজ প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন পূরবী কিন্তু ২৭ বছর চাকুরি করে আসবে এ যাবত।

বেদনার দিকও আছে। আমাদের ঘাম রক্ত দিয়ে গড়া ন্যাপ আজ খন্ডিত দুর্বল। দেশ দুর্নীতি, গণতন্ত্র হীনতা, একদলীয় শাসন, বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিগুলির ঐক্য গড়ে না ওঠা সর্বাধিক পীড়াদায়ক। সাধ্যমত এই শক্তিগুলির ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কর্মরত।

পারিবারিক ক্ষেত্রে একটি বিপর্য্যয় ঘটে গেল। মেজ মেয়ে কুমকুম, আমাদের সবার অত্যন্ত আদরের, চিরতরে চলে গেল অকালেই। ব্যথা-বেদনা, হাসি-আনন্দ, সাফল্য ব্যর্থতা নিয়েই জীবন। জীবন আজ চলমান-আজও সক্রিয়।
সাকুল্যের হিসেবে অর্জনের পাল্লা অনেক ভারী। বাড়ী-গাড়ী-ব্যাংক ব্যালেন্স নেই-এম.পি-মন্ত্রীত্ব নেই। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় সফল এবং তাই তৃপ্তও।

অসংখ্য শুভার্থী, স্বজনদের ভালবাসা নিয়ে ৮৭ বছরে আজকের পদার্পন খুবই গৌরবের বিশেষ করে যখন ভাবি এই দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার কথা। সক্রিয় এবং সুস্থ থেকে দেশের কাজ অবিরাম করে যাওয়া আজকের আকাংখা।
আর চাইবো, জীবনে বহুবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সহিংসতা বেদনার সাথে দেখেছি। পাবনাতে জনগণকে সাথে নিয়ে বার দুয়েক প্রতিরোধও করতে পেরেছি। আকাংখা, আর যেন না হয়। আকাংখা, যদি হতে নেয় তা যেন জনগণকে তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধ করতে পারি।

জীবনকালে ঐক্যবদ্ধ হতে দেখবো বাম প্রগতিশীল শক্তিগুলিকে। তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি পারবে আবার গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে জন সমর্থে বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে, শরীক থাকতে চাই সেই প্রচেষ্টায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!