সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৪৬ তম পর্ব)

 

‘অ-মানব’-(৪৬ তম পর্ব)

————————- সেলিনা জাহান প্রিয়া

 

আজগর আলির বাড়িতে মানুষ আর মানুষ । গ্রামে মাঝে একটা মজার সংবাদ উঠেছে আজগর আলি বুইরা বয়সে একটা সুন্দরী মহিলা নিয়া আসছে , চায়ের দোকান থেকে গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে একই আলাপ ।
চেয়ারম্যানের বউ অ-মানব কে ডেকে বলল-

——- একটা ঘটনা শুনছেন ভাই জান।
—— কি এমন ঘটনা ?
——- আমাদের গ্রামে এক বুইড়া আছে । অনেক পাজি ঐ মানুষ টা । ঘরে তার তিন টা বড় বড় ছেলে। ছেলের বউ, মেয়ে বিয়া দিয়েছে সে কিনা এই বয়সে ! ছিঃ ছিঃ । এমন কাজ কেমনে করলো ।
—— অ-মানব একটু হেসে বলল একটা কথা বলি ধরুন আপনি মারা গেলেন এক দম বুড়ো হয়ে । আপনার স্বামী বেঁচে আছে । সেই বুড়ো মানুষ । ধরুন সেই বয়সে সে একা একা ঘরে থাকে, তার একটু পানি দরকার । বাহ দরুন সে টয়লেট গিয়ে কাপড় নষ্ট করলো । বাহ তার অন্য সমস্যা হল তখন তার এই কাজ কে করে দিবে । এই যে আপনার শাশুড়ি একা একা থাকতে থাকতে একটা মানসিক রোগ হয়ে গেছে । এখন আপনাদের কারো কথা তার ভাল লাগে না। এখন আপনি বলেন সে হয়ত নারী আপনি তার কাজ করে দিবেন কিন্তু শ্বশুরের কাজ কে করে দিবে ?
——- আসলে ভাই আমি এভাবে চিন্তা করি নাই । এই যে আপনি কত সুন্দর করে আজ বুজিয়ে দিলেন ।
——- আমি কি আপনাকে একটা কথা বলতে পাড়ি ?
—— আরে বলেন ?
——- আপনার বাড়িতে গরু কয়টা ?
——- হবে মনে হয় ৬ বা সাত টা।
——- আপনি বাড়ির জিনিস গুলো কে ভালবাসেন । গরু কে একটু পানি দেন । গরুর গায়ে একটু হাত বুলান । বাড়ির মুরগী গুলো কে নিজের হাতে খাবার দেন । আপনি দেখবেন তারাও একটু মমতা চায় । আর আপনাকে কত ভালবাসে ।
—— আমি যাই আপনার নামটা কেন এমন একটু বলবেন ।
—— আমি যে দিন চলে যাব সেই দিন বলব আমি কেন অ-মানব । চেয়ারম্যানের ভাগনী ফুলজান কি আজ আসবে ?
—– হে ভাই অ-মানব আমি লোক পাঠাইছি ।
——- শুনে খুশি হলাম । আমি একটু বাজারে যাই ।
——- আমার শাশুড়ি সাথে দেখা করে যাও ভাই । না হয় খুজবে । চেয়ারম্যান বউ মনে মনে বলে আসলেই এই মানুষটা একটু অন্য রকম । আমার সকল গোপন কথা জানে কিন্তু আমাকে কত সুন্দর করে স্নেহ করে কথা বলে । আজ থেকে আমি তার মত হয়ে যাব ।
বাজারে ডাক্তারের দোকানে বসা অ-মানব । ডাক্তার খুব খুশি অ-মানব আসলে ব্যবসা ভাল হয় । একজন একটা বাচ্চা কুলে নিয়ে অ-মানবের সামনে আসে বলল –
———— বাবা আমার মেয়ে টা কে একটু ঝেরে দাও । রাতে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে । আর বলে আমার বাড়ির সামনে একটা জাম গাছ আছে সেই গাছে নাকে তাঁকে ডাকে । মেয়েটার জ্বর কমে না। রাতে হলেই বলে জাম গাছ আমাকে নিয়ে যাবে ।
——- অ-মানব মেয়েটা দিকে চেয়ে দেখে বয়স ৭ হবে । তাই বলল আচ্চা আচ্ছা তুমি যাও আমি সন্ধ্যার পড় তোমার বাড়িতে বাড়ি আসব । কেনু কে নিয়া । জাম গাছটা দেখতে হবে ।
——- জাম গাছ তো জংলের মধ্যে । আমারা দিনের বেলায় ভয়ে যাই নাই ।
——- আচ্ছা আমি রাতের বেলা যাব । মেয়েটা কে বলল জাম গাছে যে থাকে তারে তুমি ইচ্ছা মত মেরে দিবা । আর তোমাকে কোন দিন । ডাকবে না
—— ভাই জান আপনি তো জানেন না। এটা একটা আছর লাগা গাছ । যেই ঐ গাছের কাছে যায় । সেই বেমার হয় ।
——- আরে বেমার আমার হবে তোমার কোন সমস্যা । আমার কাছে আসছ মেয়ে ভাল করাতে । ঠিক আছে?
——হা ঠিক আছে । আমি তাহলে মেয়ে নিয়া যাই, চেয়ারম্যান এসে বলল অ-মানব তোমাকে আমি খুজছি । কেনু কে হোন্ডা থেকে নামিয়ে বলল একটা কাজ আছে । আমাদের গ্রামের খুব কঠিন মানুষ আজগর আলি ।
তার বাড়িতে বিচার । তুমি চল আমার সাথে ।
——– আমি তো বিচার জানি না চেয়ারম্যান ।
——- বিচার জান না তা জানি । কিন্তু মানুষ কে তুমি কথা বলে জাদু করতে পার ?
——- আমি একটা অ-মানুষ । আমি নাকি জাদু জানি ?
ডাক্তার হেসে বলল যাও ভাই অ-মানব । আর আসার পথে তোমার বোনের সাথে দেখা করে আসো । কেনু বলল চেয়ারম্যান মামা অ-মানব মামার যেতে হবে না । আমি আলোচনা সব ফাইনাল করে আসছি । আপনি গিয়ে শুধু তাদের কথা শুনে একটা মতামত দিবেন । চেয়রম্যান বলল আচ্ছা কেনু তুই আগে যা । আমি তারে নিয়ে আসছি । কেনু বলল ঠিক আছে চেয়ারম্যান মামা আমি আজগর আলির বাড়িতে যাই । ঠিক আজগর আলি বাড়িতে এসেই কেনু বলল খুব সমস্যা । আজগর আলির ছেলে আলম বলে কি সমস্যা?
——- তোমার বাবা তো মনে হয় তোমাদের কিছু দিবে না। আর বাজারের সব মানুষ তোমার বাবার পক্ষে।
——– তাহলে এখন উপায় কেনু।
——- শুন আলম আমারে যা দিবা তো দিবাই । কিন্তু চেয়ারম্যান তো তোমার বাবার পক্ষে নিবে ।
——– কেনু তুমি চেয়ারম্যান সাবরে ম্যানেজ কর আমরা তিন ভাই মিলে ৫০ দিমু । আচ্ছা একটু চা খাওয়া। চেয়ারম্যান আসার আগে তোমার বাবার সাথে কথা শেষ করি । কেনু একটা লম্বা সালাম দিল । নানা কি খবর ? আরে কেনু ভিতরে আসো ।
——- নানা চেয়ারম্যান আসতাছে । একটু পড়ে বিচার তো জান ।
——– আমি আজগর আলি আমার বাড়িতে থাকি । আমার বিচার কে করবে?
——- আরে নানা রাগ হও কেন । তা তো জানি বাড়ি তোমার জমি তোমার । কিন্তু সমাজ তো আর তোমার না। আবার সাথে মেয়ে মানুষ । তোমার ছেলেরা আর গ্রামের মানুষ তো তোমার ছেলের পক্ষে ।
——- আজগর আলি বলল কেনু টাকা যা দিচ্ছি ফেরত দিবা । আমি থানা পুলিশ করব । আমি চোখে দেখি । আমার সাথে ধান্ধা করবা না।
——- আচ্ছা না কোন ধান্ধা না। চেয়ারম্যানের একটু ইজ্জত আছে না। তোমার পক্ষে তোমার পোলাদের একটা ধমক দিবে ।
———- ঠিক বলছ যাও আমি চেয়ারম্যান কে পাঁচ হাজার টাকা দিব নে । চেয়ারম্যান অ-মানব কে নিয়ে আজগর আলির বাড়িতে আসলো । সবাই বসছে । আজ গেদু মিয়া রাজ্জাক মেম্বার সবাই আসছে । চেয়ারম্যান আজগর আলি কে বলল – চাচা কারে নিয়ে আসছেন ।
——– আজগর আলি বলল একজন মহিলা নিয়ে আসছি ।
——– ভাল, তা বিয়ে করেছেন তো ?
——- সেটা পড়ে বলি ?
——- আচ্ছা আজগর চাচা আপনি ঢাকা কিভাবে গেলেন । অ-মানব একা একা হাসছে গেদু মিয়া বলল অ-মানব আপনি হাসছেন কেন ? চেয়ারম্যান বলল গেদু মিয়া কোন রহস্য আছে মনে হয় । না হয় অ-মানব
হাসার কথা না। কি অ-মানব ঘটনা কি? ঘটনা কিছুই না । বিচার আগেই শেষ । আজগর আলি বলল তোমার কণ্ঠ টা চিনা চিনা লাগে । তুমি তো সেই লোক যে আমার মনের সাহস দিছিলা । ঠিক না ।
——-অ-মানব বলল হা ঠিক । এখন চোখে সব দেখতে পান ।
আজগর আলি অ-মানব কে গলায় জরিয়ে ধরে কান্না করে দিল । আর বলল আল্লাহ্‌ কেন তোমার মত সন্তান আমাকে দিল না। যে বৃদ্ধা বাবার দুঃখ বুঝে । আমি তো মনে মনে তোমাকেই খুঁজছিলাম । তোমার নাম অ-মানব । আমি আজ সব দেখতে পাড়ি । অ-মানব তিন ছেলে কে বলল আপনারা বুড়ো হলে কি হবে একবার চিন্তা করুন । এই সব জমি তো আপনাদেরই । আপনারা বাবা কষ্ট করে এই জমি করেছে ।
আপনারা তার জমি নিতে চান । আপনারা জীবনে কয় কাঠা জমি কিনেছেন । আপনার ছেলে মেয়ে কি নিয়া আপনাদের অবহেলা করবে । আর সাথে যে মহিলা আপনার বাবা কে নিয়ে এসেছে তার জন্য কি কোন মায়া হয় না আপনাদের । না হয় আপনার বাবা যদি তার সাথে চলে যেত তাহলে বাবা কে কোথায় পেতেন ?
কাল যে এই জমি আপনাদের থাকবে তার কি কোন ভরসা আছে । আপনারা তিন ভাই বলেন আপনরা বাবা চান না জমি চান ?
আজগর আলির বড় ছেলে আজগর আলির পায়ে ধরে বলল বাবা জমি চাইনা । তোমাকে চাই ভুল হয়েছে বাবা । তার পড় দুই ছেলে এসে বাবার পায়ে পড়ল ।
আজগর আলি বলল – আমার সব জমি আমার তিন ছেলে কে আমি আজকেই লিখে দিব । তোমরা তিন ভাই আমাকে দেখ আর আমি যে মহিলা কে এনেছি তাঁকে দেখ । তিন ছেলে বলল না বাবা জমি না । জমি তো আমাদেরই থাকবে ।
অ-মানব গেদু কে বলল ভাই একজন হুজুর আনেন বিয়ের মিষ্টি খাই । অ-মানব কেনু কে বলল আজ মিষ্টির সব টাকা কেনু দিবে । কেনু একদম চুপ হয়ে গেল । কারন কেনুর ব্যবসা শেষ । আজগর আলি বলল জীবনে মনে হয় আল্লহ আজ আমাকে সব দিয়েছে । চেয়ারম্যান কেনু আর অ-মানব কে নিয়ে সন্ধ্যায় বাজারের দিকে আসে ।
গেদু মিয়া অ-মানবের আজকের এত সুন্দর কাজ দেখে বলে তাহলে ভাল কাজের ইজ্জত বেশি । গেদু বলে না আমিও একটা ভাল কাজ করব । জীবনে শুধু তিনভাই মিলে এত সুন্দর কাজ করলো আর আমি বউয়ের কথায় যে সৎ মা আমাকে লালন পালন করলো তাঁকে আমি বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি । ছিঃ আমি একটা মানুষ না ।
মা কিছু জমি পাবে তাঁকে না দেয়ার জন্য কত কিছু করছি । আরে আমি যদি মাকে একটা আদর করি ভাল বাসি তাহলে তো মা আমাকে এমনিই জমি দিবে ।
অ-মানব আসলেই কিছু জানে । এত কিছু থাকতে সে আমার মায়ের হাতের খিচুড়ি খেতে চাইছে । আর আমি তার সৎ ছেলে হয়ে আপন হতে পাড়ি নাই । ইস ১১ বছর হল মাকে দেখি না। জন্ম দিলেই কি মা হয় ?
গেদু মিয়া মনে মনে বলল মাত্র পাঁচ মাইল রাস্তা । আমি কিছু জমি আরও মাকে দেয়া দরকার কারন তার আমি ছাড়া কেউ নাই । না আমি এখনি মায়ের সাথে দেখা করতে যাব বলে সাইকেলে উঠে ।
গেদু বয়স যখন ১৫ বছর তখন গেদুর মা মারা যায় , তখন গেদুর বাবা ঐ মহিলা কে বিয়ে করে । বাবার কাছে কত মিথ্যা বলেছে কোন দিন ঐ মহিলা বাবাকে বিচার দেয় নাই । আমি গেদু ই আপন হতে পাড়ি নাই। বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পড় কোন দিন জমির জন্য পর্যন্ত আসে নাই । তাহলে তো ঐ মহিলা ভাল আমিই খারাপ ।
গেদুমিয়া ১১ বছর পড় আজ তার সৎ মায়ের বাড়িতে গেছে । গেদুর মা তার ভাইয়ের বাড়িতে সব কাজ করে থাকে । জীবনে কয়টা দিন ভাল ছিল । স্বামী মারা যাওয়ার পড় নারীর জীবনে আর কি থাকে । বাহিরে চুলাতে রান্নার ভাইয়ের সংসারে কাজের মহিলার মত থাকে আর কি ? পিছন থেকে ১১ বছর পড় ডাক দিল ও মা তুমি কই । ডাক শুনেই পিছনে তাকাই । অবাক হয়ে দেখে গেদু ।
——– কিছুটা হতবাগ হয়ে যায় । স্বপ্ন দেখছে না তো গেদু মিয়া যেয়ে তার এই মায়ের পায়ে পড়ে বলে মা আমাকে ক্ষমা কর । মা আমাকে ক্ষমা কর । মায়ের মন এত দিন পড়ে ছেলে এসেছে । চোখের পানি আঁচলে মুখে সন্তানকে বুকে টেনে নেয় । মা আর ছেলের কান্নায় বাড়ির মানুষ এক হয় । গেদু বলে মা আমি তোমাকে নিতে এসেছি । তোমার জমি তুমি নিবা আর আমি তোমাকে কিছু জমি দিব যাতে আমার সন্তান রা তোমাকে অবহেলা করে ।
গেদুর মা বলে পাগল ছেলে আমি জমি দিয়ে কি করব ? আমার কাছে কি আমার সন্তানের চেয়ে জমি বড় । আমার সব জমি বাবা তোমার । আমার বাবার বাড়ি জমি চাইলে তোমারে লিখে দিব । আমার তোমারা ছাড়া কে আছে । এই কথা শুনে গেদু আরও কাদতে থাকে, বলে মা আমি তোমারে সাথে করে না নিয়ে যাব না। আমি আজ থেকে তোমার কথা মতে চলব । আমি আর ভুল করতে চাই না।

চলমান——- 

অ-মানব-প্রথম পর্ব    অ-মানব-দ্বিতীয় পর্ব    অ-মানব-তৃতীয় পর্ব    অ-মানব-চতুর্থ পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!