আদালতে দুই শিশুর কান্নায় কাঁদলেন বিচারক

আইন-আদালত ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

এক বছরেরও বেশি সময় আগে বিয়ে-বিচ্ছেদ হওয়া বাবা-মাকে মিলিয়ে দিতে আদালতের এজলাশে কান্নায় ভেঙে পড়লো দুই শিশু—মিয়া মো. সালিম সাদমান ধ্রুব ও মিয়া মো. সাদিক সাদমান লুব্ধক। এ সময় দুই শিশুর হৃদয়বিদারক কান্নায় বাষ্পরুদ্ধ হয়ে ওঠেন তাদের বাবা মিয়া মো. মেহেদী হানান ও মা কামরুন্নাহার মল্লিকা। তখন এজলাশে উপস্থিত আইনজীবীরাও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বিচারকও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সোমবার এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আবেগঘন ঘটনার সৃষ্টি হয়।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, বাদী কামরুন্নাহার মল্লিকার বাড়ি রাজশাহী ও বিবাদী মিয়া মো. মেহেদী হাসানের বাড়ি মাগুরায়। কামরুন্নাহার ঢাকার গার্হ্যস্থ অর্থনীতি কলেজে পড়া অবস্থায় ঢাকা কলেজের ছাত্র মেহেদী হাসানের সঙ্গে পরিচয়। আর এই পরিচয়ের সূত্র ধরে উভয় পরিবারের সম্মতিতে ২০০২ সালে বিয়ে হয়। এরপর তাদের কোলজুড়ে আসে দুই শিশু। বড় ছেলে মিয়া মো. সালিম সাদমান ধ্রুবর বয়স ১২ বছর। ছোট ছেলে মিয়া মো. সাদিক সাদমান লুব্ধকের বয়স ৯ বছর। তারা যথাক্রমে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।

সূত্র জানায়, মেহেদী হাসান-কামরুন্নাহার দম্পতির সংসারে দীর্ঘদিনের দাম্পত্য কলহ লেগে ছিল। অবশেষে ২০১৭ সালের ১২ মে। ওই দিন এই দম্পতির বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের একসপ্তাহ আগেই দুই সন্তানকেই ফুপুর কাছে পাঠিয়ে দেন মেহেদী হাসান। এরপর মাগুরা জেলা শহরের একটি স্কুলে তাদের ভর্তি করা হয়। সেখানেই বেড়ে উঠছিল দুই শিশু। এভাবে কেটে যায় আরও একটি বছর। এই একবছরে সন্তানদের সঙ্গে দেখা মেলেনি মা কামরুন্নাহারের। ফলে বাধ্য হয়েই তিনি দুই শিশু সন্তানকে নিজের হেফাজতে চেয়ে হাই কোর্টে একটি রিট দায়ের করেন।

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার সঙ্গে ছিলেন একেএম রিয়াদ সলিমুল্লাহ। বিবাদী মিয়া মো. মেহেদী হাসানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল।

গত ২৯ মে সেই রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে দুই সন্তানকে কেন মায়ের হেফাজতে দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। একইসঙ্গে ওই দুই শিশুকে আদালতে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ও শিশু দুটির বাবাকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই নির্দেশ অনুসারে সোমবার (২৫ জুন) মেহেদী হাসান, কামরুন্নাহার ও দুই শিশুকে নিয়ে তাদের ফুপু আদালতে হাজির হন। এছাড়া উভয়পক্ষের আত্মীয়-স্বজনও আদালতে হাজির হন।

আদালতে মামলার শুনানি শুরু হলে একপর্যায়ে বিচারপতিরা শিশু দু’টির বক্তব্য শুনতে চান। এই সময় বড় ছেলে ধ্রুব আদালতকে বলেন, ‘আমরা আর কিছু চাই না, বাবা-মাকে একত্রে দেখতে চাই। ছোট ছেলে লুব্ধকও বিচারপতিদের কাছে একই আবেদন জানায়।’ শিশু দু’টির বক্তব্য শুনে আদালত আবারও আইনজীবীদের বক্তব্য শোনেন। এ সময় বাদীর আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতকে বলেন, ‘একবছর ধরে মা তার সন্তানকে দেখতে পাচ্ছেন না। আজ যখন কোর্টে হাজির করা হয়েছে, তখনও শিশুর ফুফু তাদের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বাধা দিয়েছেন। সন্তানদের সঙ্গে মায়ের কথা বলার সুযোগ চাই আমি।’ এ সময় আদালত অনুমতি দিলে এগিয়ে যেতেই দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন মা কামরুন্নাহার। প্রায় একবছর পর মাকে পেয়ে ছেলেরাও কাঁদতে শুরু করে। বড় ছেলে তখন হাত বাড়িয়ে বাবাকে কাছে ডাকে। ছেলে বলে, ‘বাবা তুমি এসো। তুমি আমার কাছে এসো। আম্মুকে স্যরি বলো।’

কিছুক্ষণ পর বাবা মেহেদী হাসান সন্তানদের দিকে এগিয়ে আসেন। তখন এজলাশের ভেতর এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বাবা-মা দুই সন্তানরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এ সময় দুই বিচারপতি, আইনজীবীসহ উপস্থিত অন্য মামলার বিচারপ্রার্থীদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

বিচারপতিরা আবারও শিশুদের ডাকেন। সঙ্গে মা’কেও। এরপর বাদী-বিবাদীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘এ দৃশ্য দেখেও কি আপনাদের মন গলে না? আপনারা কি সন্তানের জন্যও নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না? সামনে তাকিয়ে দেখুন, আপনাদের এ দৃশ্য দেখে সবার চোখেই পানি চলে এসেছে।’ আদালতের বক্তব্যের পর বাবা-মাকে সন্তানদের কথা চিন্তা করার অনুরোধ জানান উপস্থিত আইনজীবীরা। একইসঙ্গে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক যেন পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, এ সে রকম একটি আদেশ দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন তারা।

এরপর বাদী-বিবাদী, দুই সন্তান, বাদী-বিবাদী দুজনের মা ও শিশুদের ফুপুকে আদালত ডেকে প্রত্যেকের বক্তব্য শোনেন।

সবার বক্তব্য শোনার পর আদেশ দেন আদালত। আদেশে আদালত বলেন, ‘আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে বাবা শিশু দুটির দেখাশোনা করার সুযোগ পাবেন। একইসঙ্গে আগামী ৪ জুলাই শিশু দু’টিকে সেদিন হাজির করারও নির্দেশ দেন আদালাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!