ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা:)

 

হযরত ওমর (রা:) হযরত আবু বকর (রা:)- কে বললেন, ‘হে আবু বকর (রা:)! রাসুলুল্লাহ্ (সা:)- এর পর আপনিই হচ্ছেন সর্বোত্তম ব্যক্তি।‘ এ কথা শুনে হযরত আবু বকর (রা:) বললেন, ‘হে ওমর! আপনি আমাকে সর্বোত্তম ব্যক্তি বলছেন, অথচ আমি স্বয়ং নবী করীম (সা:)- কে বলতে শুনেছি যে, “সূর্যের উদয়াস্তের মাঝে ওমরের চাইতে উত্তম মানুষ আর কেউ নেই।“ (মুন্তাদ রাক হাকেম, সাহাবায়ে কেরাম (রা:)- এর পরিচয় অধ্যয়)
হযরত ওমর (রা:)-এর মতের অনুকুলে বারবার ওহী নাযিল হয়েছে। মাঝে মাঝে ওমর (রা:) মুখ নিঃসৃত বাক্য হুবহু অহিরুপে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু কখনও ওমর (রা:)-এর মনে এ কথা উদিত হয় নাই যে আমি একটা কিছু হয়ে গেছি বা আমার উপরও অহি অবতীর্ণ হচ্ছে। কারন তিনি বুঝতেন যে রাসুল (সা:)-এর সাহচর্যের বরকতে হৃদয়ে যে নূরানী ভাব সৃষ্টি হয়েছে তার কারনেই এসব হচ্ছে। মাঝে মাঝে কোন বিষয়ে অহি নাযিল হওয়ার পূর্বেই তার হৃদয়ে সে বিষয়ের ভালমন্দ সৃষ্টি হয়ে যেত। কিন্তু তিনি কখনও এ নিয়ে অহংকার বা গর্ববোধ করেননি। উপরন্ত দেখা গেছে কোন ক্ষেত্রে রাসুল (সা:) ও ওমর (রা:)- এর মত ভিন্ন ভিন্ন হলে ওমর (রা:)- এর মতের অনুকুলেই অহি নাযিল হয়েছে। তখন ওমর (রা:) আনন্দিত হওয়া তো দূরের কথা বরং কয়েকদিন লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে থাকতেন।(কিমিয়ায়ে সা‘আদাত)
হযরত ওমর (রা:)- এর নিকট একজন বলল, মিশরের শাসনকর্তা আয়াশ বিন গানাম মিহি পোষাক পরিধান করেন এবং দরবারের দরোজায় দারোয়ান নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি একজন লোক পাঠালেন এবং বললেন, সে যে পোষাক পরিহিত আছে, সেই পোষাকেই নিয়ে আসবে। আয়াশ বিন গানামকে নিয়ে আসলে দেখা গেল সে মিহি পোষাক পরিহিত অবস্থায় আছে। লোকটির বর্ণনা সত্য প্রমানিত হওয়াতে খলিফা তাকে শাসনকর্তা হতে বরখাস্ত করলেন এবং বললেন তুমি বায়তুল মালের ছাগল ও ভেড়ার রাখালি করবে।
আমিরুল মু’মিনীন ওমর (রা:) জানতে পারলেন যে সিরিয়ার শাসনকর্তা আমীর মোয়াবিয়া (রা:)- এর পিতা আবু সুফিয়ান সিরিয়া গিয়াছিলেন এবং সেখান থেকে অনেক ধনরতœ নিয়ে এসেছেন। আমীরুল মু’মিনীন আবু সুফিয়ানকে ডেকে আনলেন এবং জোর করে তার হাতের আংটি খুললেন এবং একজনের হাতে দিয়া তার স্ত্রী হেন্দার নিকট পাঠালেন এবং বললেন আংটি টি দেখায়ে বলবে যে আবু সুফিয়ান মোয়াবিয়ার নিকট থেকে যে ধনরতœ নিয়ে এসেছে সেই বাক্রটি নিয়ে যেতে বলেছে। লোকটি বাক্রটি নিয়ে আসলে দেখা গেল তাতে অনেক ধনরতœ আছে। সেই ধনরতœ সম্পূর্ন বায়তুল মালে জমা করলেন।
হযরত ওমর (রা:) যখন মুসলিম জাহানের খলিফা তখন তাঁর পুত্র হযরত হাসান (রা:) ও হযরত হোসাইন (রা:)- এর সঙ্গে খেলা করতে ছিলেন। এক পর্য্যায় কথা কাটাকাটির সময় এমাম ভ্রাতৃদ্বয় হযরত ওমর (রা:)- এর ছেলেকে বললেন, ‘তুমি আমাদের নানার গোলামের বাচ্চা। এ কথা শুনে ওমর (রা:)- এর ছেলে বাড়ীতে গিয়ে তাঁর বাবার কাছে নালিশ করলেন। হযরত ওমর (রা:) তাঁর ছেলেকে বললেন, এটাতো অত্যন্ত খারাপ কথা, তাঁদের এত বড় স্পর্দা। তাহলে এখন কি করা যায়? ছেলে বললেন, এর একটা বিচার হওয়া উচিত। হযরত ওমর (রা:) কতিপয় সাহাবাদের ডেকে বললেন, আমি এর জন্য বিচার করতে চাই। এ কথা শুনে হযরত আলী (রা:) খুব চিন্তিত হলেন এবং হযরত ওমর (রা:)- এর নিকট গিয়ে বললেন, ভাই ওমর (রা:) ছোট ছেলেরা বুঝে না, তাই এত বড় অন্যায় কথা বলেছে। আপনি মাফ করে দিন। হযরত ওমর (রা:) বললেন, তা হবে না, এর বিচার করতে হবে। তারপর শুক্রবার মসজিদে সকল সাহাবাদের সন্মুখে বিচারের আয়োজন করলেন। হযরত আলী (রা:) ছেলেদের নিয়ে মসজিদে হাজির হলেন। হযরত ওমর (রা:) এমাম ভ্রাতৃদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা আমার ছেলেকে কি বলেছেন? তাঁরা সম্পূর্ন সত্য কথা বললেন। তখন হযরত ওমর (রা:) এই কথাটি কাগজে লিখে উভয়কে স্বাক্ষর করতে বললেন, তাঁরা তাই করলেন। উপস্থিত সাহাবারা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে দেখতে লাগলেন, রাসুল (সা:)- এর অত্যন্ত আদরের নাতিদের না জানি কি বিচার করা হয়। হযরত ওমর (রা:) কাগজটি হাতে নিয়ে তা ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, এই কাগজটি যতœ করে রেখে দিবে এবং আমার মৃত্যুর পর ইহা আমার কাফনের কাপরের নীচে আমার বুকের উপর দিয়ে দিও। হাশরের দিন আল্লাহ্ যখন আমাকে বলবেন, আমার জন্য দুনিয়াতে কি করেছ? আমি তখন বলব আমি কিছুই করতে পারি নাই। তবে আমি আপনার হাবিবের গোলামী করেছি, তার সার্টিফিকেট এই কাগজটি। আপনার হাবিবের নাতিরা ইহাতে স্বাক্ষর করেছেন।
মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা:)-এর শাসনামলে হযরত আমর ইবনুল আস (রা:) মিশরের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন, তখন মিশরের নীলনদের অবস্থা ছিল এই যে, প্রতি বছর একটি যুবতী মেয়েকে উলঙ্গ করে বলি না দিলে পানি প্রবাহিত হতো না। খলিফা যখন এ বিষয়ে অবগত হলেন, তখন তিনি একটা চিঠি লিখে শাসনকর্তাকে দিয়ে বললেন, ‘এটা পাঠ করে নদীতে নিক্ষেপ করে দিও।’ শাসনকর্তা নদীর পাশে গিয়ে চিঠি পাঠ করতে লাগলেন, (চিঠিতে লেখা ছিল) ‘হে নীল নদী, তুমি যদি তোমার নিজস্ব ক্ষমতায় অথবা কোন শয়তানের ক্ষমতাবলে প্রবাহিত হয়ে থাক, তাহলে তোমার মত নদীর প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে ভরাট করে দিব। আর যদি আল্লাহ্র হুকুমে প্রবাহিত হয়ে থাক, তাহলে আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি আমার চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে প্রবাহিত হয়ে যাও।’ এই চিঠি নদীতে নিক্ষেপ করার সাথে সাথে পানি প্রবাহিত হয়ে গেল। আর এমন ভাবে প্রবাহিত হলো যে, আর কখনও নীল নদী শুকায়নি। কেয়ামত পর্যন্ত আর শুকাবেও না। (কিমিয়ায়ে সা’আদাত)
হযরত জাবের (রা:) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা:) এরশাদ করেছেন: মেরাজের রাত্রে আমি বেহেশতের এক স্থানে শ্বেত শুভ্র একটি সুরম্য প্রাসাদ দেখে ফেরেস্তাদের জিজ্ঞেস করলাম এই সুন্দর প্রাসাদটি কার? উত্তরে তাঁরা বললেন, এটা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা:)- এর প্রাসাদ। (বোখারী শরীফ)

মো: ফজলুর রহমান
সাবেক প্রধান শিক্ষক
হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়
হুগড়া, টাঙ্গাইল সদর, টাঙ্গাইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!