একটি রাষ্ট্রীয় রোগের নাম ‘সৌন্দর্যবর্ধন’

 

এয়ারপোর্ট রোডে বনসাই দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন করতে গিয়ে আলোচনায় এসেছেন মেয়র আনিসুল হক। পড়েছেন তীব্র সমালোচনার মুখে। ফুটপাত, রোড ডিভাইডার ভাঙা-গড়া নিয়েও তিনি সমালোচনায় পড়েছেন। এয়ারপোর্ট রোড আবার সিটি কর্পোরেশনের না, বনসাই সিটি কর্পেরেশন লাগায় নি। যদিও সমালোচনা মেয়রেরই হচ্ছে।

এসবই চলছে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ নামক শব্দটিকে কেন্দ্র করে। এই শব্দটি নিয়েই আজকের আলোচনা।

০১.
‘সৌন্দর্যবর্ধন’র কর্মটি এদেশে বহু বছর ধরে চলছে। আনিসুল হক বিষয়টি প্রথম শুরু করেছেন, তা নয়। এই ‘সৌন্দর্যবর্ধন’র সঙ্গে দুর্নীতি শব্দটি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। সড়ক ও জনপদ বিভাগ যখন ৩ কোটি টাকা দিয়ে চীন থেকে আমদানি করে বনসাই আনছেন, তখন অনেকে এর সঙ্গে দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন। এর সঙ্গে উত্তর সিটি কর্পোরেশন জড়িত নয়।

একটি বিষয় শুরুতেই পরিষ্কার করে বলে রাখা দরকার, সিটি করপোরেশনের টাকা আনিসুল হক আত্মসাত করবেন বা করছেন, এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। জেনে-বুঝেই আমি বিশ্বাস করি না- করছি না। অনুরোধ করি আপনারাও এটা বিশ্বাস করবেন না যে, মেয়র আনিসুল হক জনগণের টাকা চুরি করছেন বা করবেন।

বিশ্বাস রাখেন, তিনি আর যাই হোক নিজেকে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করবেন না, করেননি। সিটি করপোরেশনে এখনও দুর্নীতি আছে, তবে তা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে কমেছে।

সুতরাং, মেয়র আনিসুল হককে নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে নয়। তেজগাঁও এলাকার রাস্তা থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড সরানোর মতো দুঃসাহসিক কাজ তিনি করতে পেরেছেন। যা অতীতের কোনো মেয়র পারেননি। কিছু দৃশ্যমান সাফল্য তার আছে। সেটাকে বিবেচনায় নিয়েই মেয়র আনিসুল হকের ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ মানসিকতার সমালোচনা করছি।

০২.
প্রথমে আসি বনসাই প্রসঙ্গে। সড়ক ও জনপদ বিভাগের এয়ারপোর্ট রোডে বনসাই লাগানোয় ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ হয়নি, তা নয়। প্রশ্ন হলো, কেন চীন থেকে আমদানি করে বনসাই এনে লাগাতে হবে? সৌন্দর্যবর্ধনের মতো দেশীয় গাছ কি দেশে নেই? আনিসুল হক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ঢাকার তাপমাত্রা কমানোর কথা বলেছিলেন। গাছ লাগিয়ে তাপমাত্রা কমাতে চেয়েছিলেন, গাছ কেটে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ করবেন- এমন কিছু বলেননি। আমদানি করা বনসাই আনিসুল হকের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদিও এক্ষেত্রে হয়ত আনিসুল হকের তেমন কিছু করার নেই। তিনি যদি বনসাই লাগানোর বিরোধিতা করতেন, মানুষ বুঝতেন যে তিনি এর বিরুদ্ধে ।

ঢাকা শহরের জন্যে দরকার ছায়া দিতে সক্ষম সবুজ গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। যা আবার দৃষ্টিনন্দনও হবে। বনসাই শুধু কৃত্রিম দৃষ্টিনন্দন হচ্ছে। চোখের শান্তির ছায়াশীতল ব্যাপারটা বনসাই থেকে পাওয়া যায় না। সবুজ গাছ, লাল টকটকে ফুলের কৃষ্ণচূড়া ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ গাছ হিসেবে অতুলনীয়।

শুধু কৃষ্ণচূড়া নয়, ‘সৌন্দর্যবর্ধন’র আরও অনেক গাছ দেশেই আছে। বিদেশ থেকে কোনো ভালো জাতের সবুজ গাছ বা ফুলের গাছ আমদানি করে আনা যাবে না, তা নয়। নিশ্চয়ই আনা যাবে। এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে, পরিবেশ বা গাছ বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়াটা জরুরি ছিল। তা না করে বনসাই আমদানি করাটা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে।

০৩.
মেয়র আনিসুল হক গাছ লাগানোর একটি কর্মসূচিও নিয়েছেন। কিছু গাছ লাগিয়েছেন, আরও লাগাবেন। প্রশংসা করি এই উদ্যোগের। কিন্তু ঢাকার রাস্তার বিশ পঁচিশ বছরের পুরনো গাছগুলো হত্যা করা হলো কেন? এসব গাছ বাঁচিয়ে রেখে ফুটপাত, রোড ডিভাইডারের ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ করা অসম্ভব ছিল না।

বাস্তবে গাছ বাঁচানোর পরিকল্পনা বিবেচনাতেই নেয়া হয়নি। গণভবনের পেছনের রাস্তা, বনানীসহ বহু রাস্তার বড় বড় গাছ নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে গুলশানের রোড ডিভাইডারের মাঝেরসহ অনেক রাস্তার পুরনো গাছ। বনসাই আমদানি এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ।

একদিকে ছায়াশীতল পুরনো গাছ হত্যা করে বনসাই আমদানি, খুব বড় রকমের প্রশ্নবিদ্ধ কর্ম। সবুজ ধ্বংস করে কংক্রিটের জঙ্গল বানানো মানে ‘উন্নয়ন’ বা ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ নয়। ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে এমন মানসিকতারই বাস্তবায়ন ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

০৪.
ফুটপাত ভাঙা-গড়া, রোড ডিভাইডার একবার সরু, একবার সম্প্রসারণ, গাছ লাগানো, একটু বড় হলে সেই গাছ কেটে আবার নতুন গাছ লাগানো, বিরতিহীনভাবে ঘটনাগুলো ঘটতে দেখা যায়। ক্ষমতায় কে থাকেন, মেয়র কে, তার সঙ্গে এই তথাকথিত ‘সৌন্দর্যবর্ধন’র সম্পর্ক নেই। প্রতিবছর নিয়ম করে যা করা হয় তা আসলে কর্ম নয়, অপকর্ম। এটা বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রীয় রোগ’ বললে হয়তো যথার্থ হয়। এই রোগের পুরোটাই দুর্নীতিতে জর্জরিত।

মেয়র আনিসুল কমিশন নেন না, নিজে দুর্নীতি করেন না, ধারণা করা হয়েছিল এবার হয়তো এই রোগ থেকে মুক্তি মিলবে। বাস্তবে এই রোগ আরও বড়ভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। সম্পূর্ণ ভালো ফুটপাত, রোড ডিভাইডার ভেঙে আবার নতুন করে করা হয়েছে, হচ্ছে? সিরামিক ইটের রুচিসম্মত, অক্ষত রোড ডিভাইডার ভেঙে সিমেন্টের ঢালাই দেয়া রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা হচ্ছে।

যখন সিরামিক ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল, তখন এখন যেটা দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটা ভাঙা হয়েছিল। ফুটপাতের যে টাইলস লাগানো ছিল, সম্পূর্ণ অক্ষত সিমেন্টের সেই টাইলস ভেঙে আর একটু চকচকে টাইলস লাগানো হয়েছে। হ্যাঁ, অস্বীকার করি না এটা দেখতে আগেরটার চেয়ে সুন্দর হয়েছে। তাই বলে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’র জন্যে ভালোটা ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে? এত বিলাসিত কেন?

যে নগরে এখনও কয়েক লাখ মানুষ খোলা আকাশের নিচে থাকে। রোদে পোড়ে বৃষ্টিতে ভেজে, শীতের পোশাক থাকে না। আরও কয়েক লাখ মানুষ বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করে। সৌন্দর্যবর্ধন’র নামে প্রতি বছর কয়েক’শ কোটি টাকা খরচ করার আগে অবশ্যই ভাবা দরকার। মুক্তিযুদ্ধে এই গরীব পরিবারগুলোর অবদান কারও চেয়ে কম ছিল না।

আপনি ধনী হলে, বিপুল অর্থ থাকলে, নিজের বাড়ি ভাঙা-গড়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন। তাতে কারও আপত্তি থাকার কারণ নেই। থাকলেও গুরুত্ব না দিতে পারেন। কিন্তু ফুটপাত, ডিভাইডার তো হচ্ছে জনগণের অর্থে। জনগণের অর্থ নিয়ে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধিকার কারও থাকা উচিত নয়।

বিশেষ করে ভালোটা ভেঙে নতুন করে করার পক্ষে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ কেন, কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। জনগণের নামে ঋণ করে এনে এই খাতে প্রতিবছর কয়েক’শ কোটি টাকা খরচ করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। একবার চিকন, একবার মোটা পাইপ বসানোর জন্য রাস্তা কাটাকাটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

এসব ক্ষেত্রে নিয়ম করে অর্থ অপচয় করা ছাড়াও আরও অনেক কিছু করার আছে। এই শহরের মানুষের আরও অনেক কিছু চাহিদা আছে। যে চাহিদার খুব সামান্য অংশই সিটি করপোরেশন পূরণ করতে পারে।

০৫.
ঢাকার মানুষ তার সমস্যা সমাধানের জন্যে তাকিয়ে আছেন মেয়র আনিসুল হকের দিকে। অথচ তার ক্ষমতা অতি সামান্য। যানজট কমানো, গণপরিহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার প্রায় কিছুই করার নেই। ওয়াসা, তিতাস, ডেসা… কাজ করে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। তাদের পরিকল্পনায় আনার ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব মেয়রের নেই।

বনসাই লাগানোর মত উদ্ভট কর্ম করছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ, মেয়র আনিসুল হক কিছু করছেন না বা পারছেন না। মানুষ মেয়রকে নিয়েই হাসাহাসি করছেন।

মেয়রের কাছে বিশেষ করে মেয়র আনিসুল হকের কাছে আকাশ সমান প্রত্যাশা আছে। এই প্রত্যাশা জন্মের ক্ষেত্রে আনিসুল হকের ভূমিকা আছে। তার কর্তৃত্ব নেই এমন অনেক প্রতিশ্রুতি তিনি নির্বাচনের আগে দিয়েছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পরও জনগণের প্রয়োজনটা বিবেচনায় প্রায়োরিটি না দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তিনি চাকচিক্যের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

‘উন্নয়ন’ দর্শনতত্ত্বে ভুল করছেন আনিসুল হক। তিনি ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বানাতে চাইছেন। ফুটওভার ব্রিজে গাছ লাগিয়ে তা বাঁচিয়ে রাখতে পারছেন না। সড়ক ও জনপদ বিভাগ বনসাইগুলো কতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন, যথেষ্ট সন্দেহ থাকছে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষতা, একটি সামগ্রিক বিষয়। বিচ্ছিন্নভাবে এক্ষেত্রে সফলতা আসে না। ঢাকাকেও সিঙ্গাপুর বানানো যাবে না। ঢাকাকে ঢাকাই বানাতে হবে, ঢাকার মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং প্রয়োজন অনুযায়ী। ঢাকার জন্যে কৃষ্ণচূড়া, নিম বা দেবদারু রুচিসম্পন্ন প্রয়োজনীয় সৌন্দর্যবর্ধন গাছ। বনসাই আমদানি করে এনে সৌন্দর্যবর্ধন জনচাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

[সংশোধনী : এয়ারপোর্ট রোড সিটি কর্পোরেশনের নয়, সড়ক ও জনপদ বিভাগের। বনসাই আমদানি ও লাগানোর কাজ তাদের তত্ত্বাবধানেই হচ্ছে। বলা হয়েছে, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে এই সৌন্দর্যবর্ধন চলছে।]

গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail.com


 

 

 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!