সেলিনা জাহান প্রিয়ার: ‘এক রোকেয়ার গল্প’

 

 

এক রোকেয়ার গল্প

———————   সেলিনা জাহান প্রিয়া

 

দুবাই ফেরত রোকেয়া । ভাব সাব বেশ অন্য রকম । গ্রামের গরিব দিন মজুরের মেয়ে । বিয়ের পর জামাই যৌতুক জন্য অনেক অত্যচার করে। গ্রামে এই নিয়া বেশ কয়েক বার সালিশ হয়েছে । জামাই গফুর মিয়া সাথে এলাকার চিটার মেম্বারের খুব ভাল সম্পর্ক ।

মেম্বার একদিন রোকেয়াকে বাড়িতে একা পেয়ে বলে – ভাবি সাব আপনার বাপ জেনে শুনে এমন লোকটার কাছে বিয়ে দিল । কাজ টা ঠিক করে নাই । আমাদের তো একবার জিজ্ঞাসা করতে পারত । গফুর না থাকলেই বাড়িতে মেম্বার এসে রোকেয়ার সাথে সুখ দুখের কথা বলে । পান সুপারি খায় । মাঝে মাঝে রোকেয়া লেবু পাতা দিয়ে সুগন্ধি চা পানিয়ে দেয় । মেম্বরের বউ বিষয় জেনে চেয়ারম্যান কে জানাই । গফুর মিয়া বউ কে শাসন করার একটা রাস্তা খুঁজছিল । পাইয়া গেল ।

গফুর বাড়িতে আইসা রোকেয়া কে খুব কঠিন মাইর দিল । সে এই বউ নিয়ে খাইব না। কারন বউয়ের চরিত্র ভাল না। রোকেয়ার বাপ চেয়ারম্যান কে জানালো । একটা বিচার করে দেয়ার জন্য । মেম্বার গোপনে রোকেয়ার বাসায় এসে বলে তোমার উপকার করতে আমার বিপদ । তোমার বাবার পক্ষে তো লাখ টাকা যৌতুক দেয়া সম্ভব না। তবে তুমি চাইলে এমন একটা ব্যবস্থা করে দিব । তোমার জামাই জিবনে আর কোন দিন তোমারে মারতে পারব না। রোকেয়া বলে – তাই করেন । আমার বাবা এত টাকা কি ভাবে দিবে । মেম্বার বলল – ভাবি জিবনে ভাল কিছু পেতে হলে ভাল কিছু দিতে হয় । আপনি শুধু চেয়ারম্যান কে একটু খুশি করে দিবেন । দেখি আমি চেয়ারম্যান কে রাজি করাই । গফুর কে জনমের শিক্ষা দিয়া দিমু । কালকে সন্ধ্যায় চেয়ারম্যানের বাগান বাড়িতে চলে আইসেন।
গফুর রোকেয়া কে বলে চেয়ারম্যান কি আমার ভাত তরে খাওয়াইতে পারবে । তোর বাবা আমার নামে বিচার দেয় হারাম জাদি । এই বলে আরও দুই চর মারে গালে পিঠে ।
সন্ধ্যায় মেম্বরের সাথে চেয়ারম্যানের কাছে আসে রোকেয়া । মেম্বার চেয়ারম্যান কে বলে -চেয়ারম্যান সাব গরীবের মেয়ের উপর অত্যাচার খোদায় সহ্য করবে না। আপনি এর একটা বিহিত করেন । চেয়ার ম্যান বলে আচ্ছা মেম্বার তুমি বলছ ।
চেয়ারম্যান বলে বিষয় টা জটিল তোমার বাবা তো বিয়ের সময় বলেছিল কিছু টাকা পয়সা ছেলে কে দিবে । তবে তুমি যদি আমাদের কথা শুন । তোমার জামাই গফুর কে মরা সাপের মত সোজা করে ফেলব । মেম্বার বলে চেয়ারম্যান রোকেয়া যাও ভিতরে যাও । চেয়ারম্যান সাহেবের খাস কামরায় যাও । চেয়ারম্যানের হাতে মদের গ্লাস টা মেম্বার দিয়ে বলে বেশী দেরি কইরেন না চেয়ারম্যান গফুর করিম গঞ্জের হাটে গেছে । চেয়ারম্যান রোকেয়া কে বলে কত সুন্দর পরীর মতো মেয়েটা কে কেউ এভাবে মারে । রোকেয়া নীরবে চেয়ারম্যানের লালসার স্বীকার হয় । চেয়ারমান রোকেয়াকে বলে তুমি বস মেম্বার কে পাঠাই । আরে চিন্তা কর না । এখন তো আমরা তোমার সাথে আছে । আমাদের হাত তোমার উপরে । মেম্বার ও রোকেয়ার শরীরের লালসার খেলায় ডুবে যায় । রোকেয়া কে রমিজের রিক্সা নামিয়ে দিয়ে আসে ।
চেয়ারম্যান ও মেম্বার একসাথে বলে আহা রে গরীবের মেয়ে খোদায় আমাদের জন্যই বানায় । নাও মেম্বার এই গ্লাস টা শেষ কর ।।
সকাল বেলায় বিচার শুরু । সবাই আসছে । চেয়ারম্যান গফুর কে বলে কি রে মেয়েটা কে কই দিন পর পর মারস । টাকা চাস । দেশে কই আইন কানুন নাই ।
গফুর বলে টাকা ছাড়া এই মেয়ে নিয়ে আমি সংসার করব না। চেয়ারম্যান বলে না এটা কোন কথা না। তোমাকে এই মেয়ে নিয় সংসার করতে হবে । মেয়ের তো কোন দোষ নাই । তুমি তাকে সব সময় নির্যাতন কর । বিষয় টা মেম্বার ও তোয়ার এলাকার সবাই বলছে ।গফুর বলে আমার বউ আমি মারছি অন্য মানুষের কি সমস্যা ? চেয়ার ম্যান বলে তোর তো অনেক সাহস । এই কে আছস এর হাত পা বাঁধ । একটা বানান দে । যে গ্রামের মানুষ দেখুক । নির্যাতন আর যৌতুকের বিচার চেয়ারম্যান কি ভাবে করে ! গফুর কে ইচ্ছা মত চেয়ারম্যানের লোক জন পিটাইলো ।
হাত পা পিটাতে পিটাতে একদম কঠিন মাইর দিল । চেয়ার ম্যান বলে দিল । এই বউ নিয়াই চলতে হবে । গফুর মিয়া বাড়িতে এসে বলে । আমার ঘরে তোর জায়গা নাই । তার পর বেশী দিন আর টিকে নাই সংসার রোকেয়ার । মেম্বার ইদানিং আর কোন খবর রাখে না। চেয়ারম্যান বলে একবার বিচার করে দিলাম । তোমাকে নিয়ে সংসার না করলে কি জোর করে সংসার করানো যায় । মাঝে মধ্য আইসো টাকা পায়সা লাগলে নিয়ে নিও । রোকেয়া অল্প সময়ে জেনে গেল । টাকা ছাড়া মানুষের জিবনের কোন মুল্য । মেয়ে মানুষের কোন কেও স্বার্থ ছাড়া উপকার করে না। । বাপের ঘরে ফিরে আসে । মাঝে মধ্য মেম্বার খুঁজ খবর নেয় । পাশের বাড়ির এক মহিলা ঢাকা বাসায় কাজ করে । রোকেয়া তার সাথে ঢাকা আসে । যেই বাসায় কাজ পায় । সেই লোক মানুষ বিদেশ পাঠায় । রোকেয়া তার সাথে ভাব জমিয়ে বিনা পায়সায় চলে আসে দুবাই । মাঝ খানে কেটে যায় ৭ বছর । রোকেয়া এখন অনেক টাকার মালিক । গ্রামে পাকা বাড়ী । ধানের জমি । দুই বোন কে ভাল জায়গায় বিয়ে দিছে । গ্রামে একবার দুই সপ্তাহের জন্য এসেছিল । কত মানুষ তাকে দেখতে আসছে । একেই গ্রাম থেকে সে আরও দুই জন কে বিদেশ নিয়েছে । দুবাই থেকে ফেরত আসার পর মেম্বার আসছে দেখতে । আজ মেম্বারের হাতে মিষ্টি । পান খাইতে খাইতে মেম্বার বলল- রোকেয়া তুমি এই গ্রামের অহংকার । আমাদের গর্ব । রোকেয়া একটু হেসে বলে হ মেম্বার গরীব কমলে তো আপানাদের মাছ শিকার কমে যাবে । তা চেয়ারম্যানের মেয়ে নাকি কোন পোলার প্রেমে পড়ে বিষ খেয়ে মরেছে । আর মেম্বার তোমার মেয়ে ও তো মাসাল্লাহ বড় হইতাছে । আমার ছোট ভাই এইবার মেম্বারিতে দাঁড়াইব । ভাই মেম্বারি পাশ করলে তোমার চালাকি তা ওরে শিখাইমু । মেম্বার চুপ করে একটা মিছকি হাসি দিয়ে বিদায় নেয় । মনে মনে বলে দেশ বিদেশ ঘুরে মেয়েটা বেশী চালাক হইছে । শরীরে গোস্ত আর চর্বি হইছে ।

একটু না কমাইলে সমস্যা । মেম্বার মনে মনে রোকেয়ার আগের সরল মুখটা চিন্তা করে ।। কিশোর গঞ্জ শহরে কিছু কেনা কাঁটা শেষ করে একটা রিক্সায় উঠে । রিক্সার চালকের মুখটা গামছা দিয়ে ঢাকা । রোকেয়া একটা পান খাচ্ছে । গ্রামের সুনসান রাস্তা । রোকেয়া বলে- কি এই ড্রাইভার এই গরমের মধ্য গামছা দিয়া মুখ ঢেকে রাখেছ কেন ? কোন গ্রামে বাড়ী তোমার । ভাড়া নিয়া চিন্তা কর না। রোকেয়া বেগমের টাকার অভাব নাই । ড্রাইভার কোন কোন কথা বলে না। বউলাই বাজার পার হবার পর চার দিক শুধু ধানের জমি । মাঝ খান দিয়ে রাস্তা । একটা বাতাস এসে ড্রাইভারের গামছাটা রাস্তায় পড়ে যায় । রিক্সা থেকে নেমে ড্রাইভার গামছা তুলতে গেলে রোকেয়া চেয়ে দেখে গফুর মিয়া । তার স্বামী । রোকেয়া রিক্সা থেকে নেমে স্বামীর গালে হাত দেয় । নিজের উরনা দিয়ে গফুরের মুখের ঘাম মুছে দেয় । গফুর মাথা নিচু করে থাকে । রোকেয়া বলে তুমি আমি একটা বোকা মানুষ ।

চল ঐ শিমুল গাছটার নিচে বসি । হাছের নিচে বসে বলে তুমি আমারে টাকার জন্য গরুর মতো মরতে কিন্তু সত্যি করে বল তো । বিয়ের রাইতে আমাকে হাত ধরে বলেছিলে রুকু আমি তোমাকে অনেক সুখে রাখব । দরকার পড়লে রিক্সা চালাইয়া তোমারে ভাত খায়াইব । তুমি আমি কত সুখে ছিলাম । চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে গফুর – মেম্বার আমাকে বলে তোমারে মারলেই তোমার বাপে টাকা দিবে । আর বলে আমি মাঝে মাঝে গফুর তোমার বাড়িতে যাব । এই উসিলা দিয়ে মারবে । টাকা হইলে বলছে মেম্বার আমাকে গঞ্জে একটা দোকান নিয়ে দিবে । আসলে আমি মেম্বারের কথায় এসব করেছি । মেম্বার বলে তোমার বাপে চেয়ারম্যান কে বিচার দিয়েছে । রোকেয়া বলে সব ঐ মেম্বারের কাজ । আমার বাবা কে দিয়ে এই শয়তান চেয়ার ম্যান কাছে বিচার বসিয়েছে । যাই হোক যা হবার হয়েছে । তুমি কি আবার বিয়ে করেছ । গফুর বলে বউ নির্যাতন কারি কে কেউ মেয়ে বিয়ে দেয় না। এমন কি ফকিন্নির মেয়েও না। আমি ৫ বছর ঢাকায় রিক্সা চালায়ে তোমারে অনেক খুজি ।

একদিন শুনি তুমি বিদেশ । তোমার অনেক টাকা । পড়ে মনে মনে বলি রুকু কি আর আমার মত নিষ্ঠুর মানুষ কে মনে রাখবে । পড়ে ঢাকা থেকে গ্রামে আসি । আজ তুমি হটাৎ করে রিক্সা উঠলা ।
তোমার পড়নে কত দামী কাপড় জুতা গয়না । কি সুন্দর তোমাকে দেখা যায় বিবি সাবের মত । আমি তাই লজ্জায় মুখটা গামছা দিয়ে ঢেকে রাখছি । রোকেয়া গফুরের পিঠের ঘাম আবার শাড়ীর সাথে গলায় পেচানো ওড়না দিয়ে মুছে দেয় । রোকেয়াও কাঁদতে থাকে শিমুল তলে বসে । আকাশ অন্ধকার করে মেঘ আসে । গফুর বলে তুমি রিক্সায় উঠো নামিয়ে দিয়ে আসি বৃষ্টি আশার আগে । রোকেয়া বলে কেন তুমি আমাকে নিবা না। তোমার ঘর কি আমার ঘর না। বৃষ্টি ঝুম ঝুম করে নামতে থাকে । গফুর তার গামছা টা রোকেয়ার মাথায় দেয় । রোকেয়া কে নিয়ে বৃষ্টি তে ভিজতে ভিজতে গফুরের বাড়ির সামনে রিক্সা আসে । বৃষ্টি শেষ হয় কিছুটা রোদ উকি দেয় গফুরের উঠানে ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!