এসো হে বৈশাখ এসো রবীন্দ্রনাথ

এসো হে বৈশাখ এসো রবীন্দ্রনাথ
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

প্রতি বছরের মত এবারেও এসে শুভ নববর্ষ পহেলা বৈশাখ – যা সমগ্র বাঙ্গালি জাতির জীবনে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও আনন্দময় দিন। বাঙ্গালি ধর্মপ্রান জাতি হলেও তারা যে সাম্প্রদায়িকতায় ভোগেন না তার সুষ্পষ্ট প্রমান মেলে পহেলা বৈশাখের ভোরে ঢাকার রমনার সবুজ মাঠেযখন লক্ষাধিক নরনারী শিশু সমবেত হন ছায়ানট আয়োজিত সংগীত, নৃত্য, আবৃতি ও পাঠ সমন্বয়ে পরিবেশিত দীর্ঘক্ষনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঐ অনুষ্ঠানে যে হিন্দু-মুসলিম নারী-পুরুষ শিল্পীরা তাঁদের অপূর্ব অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন – তেমনই দর্শক শ্রোতাবৃন্দও নানা ধর্মে, নানা বর্ণে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসী হয়েও ভোররাত থেকে রমনার মাঠে এসে হাজির ঐ অনুষ্ঠানে গরিবার আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে, নতুন পোশাক পরিধান কওে, চা নাস্তার সাথে ইলিশ পান্তা খেয়ে এক অপূর্ব এবং অসাধারন মিলনমেলায়।
অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও রবীন্দ্র গবেষক ড. সনজিদা খাতুন। মঞ্চটি সাদামাঠা ভাবে সজ্জিত হলেও তাতে বসে সঙ্গীত পরিবেশন করতে দেখা যায় কমপক্ষে অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ খ্যাতনামা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীগণ। শুধু ঢাকা শহরের শিল্পী নন, সমগ্র বাংলাদেশের নানা অঞ্চল থেকেও অজস্্র শ্রোতা দর্শক এসে পৌঁছান ঐ অনুষ্ঠানমালা প্রত্যক্ষ করতে। শুধু তাই নয়, যাতে প্রতিটি দর্শক শ্রোতা গায়ক-গায়িকা দের কন্ঠস্বর শুনতে পারেন তার সুবিধার্থে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে উন্নততম মাইক্রোফোনের নেটওয়ার্কটি গড়ে তোলা হয় দূরতম অঞ্চলের জন্য।
এই অনুষ্ঠানমালা ঝড়-ঝঞ্চা, ভুমিকম্পেও স্থগিত হয়নি। কিন্তু জঙ্গী মৌলবাদীরা, তথাকথিত ইসলামপন্থীরা যেমন কদাপি বাংলাদেশ চায়নি – তেমনই চায়নি বাঙ্গালি সংস্কৃতির বিকাশ। তাই তারা আজ থেকে কয়েকবছর আগে পরপর গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে এই বর্ষবরনের অনুষ্ঠান চলাকালে। আমি তখন ছিলাম পাবনাতে। পাবনাতে বাসায় বসেই টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত ঐ অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করছিলাম ভোর থেকে। টেলিভিশনের আওয়াজও খুলে দিয়ে প্রতিটি শিল্পীর পরিবেশিত গানই শুনছিলাম তন্ময় হয়ে। অকস্মাৎ প্রচন্ড আওয়াজ যেন পাবনার ঘরটাই উড়ে যাচ্ছে এমনটাই মনে হলো। টেলিভিশনের দিকে চাইতেই দেখি অনুষ্ঠান প্রাঙ্গনে প্রানভয়ে ছোটাছুটি। তীব্র কন্ঠের আর্তনাদ। দৃশ্যটি দেখে নিজের চোখের জলই নিবারন করা দুরুহ হয়ে পড়েছিল। ঘটনাটি যেমন আকষ্মিক তেমনই অস্বাভাবিক। কোন অপরাজনীতিনা, কোন ধর্মেও বিরুদ্ধেনা। শিল্পীরা দর্শক শ্রোতারা নিজ নিজ অদম্য আগ্রহে জমায়েত হয়েছিলেন অনুষ্ঠানমালা শুনতে কিন্তু তাতে তাদের অনেককেই প্রানভয়ে চলে যেতে হলো। পাবনাতে নিজ বাসায় বসেই প্রমাদ গুনলাম। কতইনা প্রানহানি ঘটে আর কি কোনদিন এমন আয়োজন হবে এমন সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ? হবে কি রমনার সবুজ ময়দানে পরের বছর থেকে পুনরায় এই আয়োজন ? কাকেই বা জিজ্ঞেস করি ? তেমন কেউ তো পাবনায় থাকেন না সবাই থাকেন ঢাকায় – আয়োজকদের সবাই।

মনে পড়ে এই আয়োজনের শুরুর কাহিনী। তখন আজ থেকে অর্ধশতাব্দিরও আগের কথা। ১৯৬১ সালের এক দু:সাহসী ইতিহাস। ঐ সময় জেনারেল আইউবের সামরিক শাষনের যাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হচ্ছিল, বাঙ্গালি জাতির ও বাঙ্গালি সংস্কৃতির গভীর দু:সময়ে আইউবের তথ্যমন্ত্রী বাঙ্গালির কুসন্তান মুসলিম লীগের অখ্যাত নেতা শাহাবুদ্দিন কথা নেই, বার্তা নেই নির্দেশ জারী করে বসলেন পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথের গান, আবৃত্তি প্রভৃতি নিষিদ্ধ। তখন দু:সাহসী দুই রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক এবং তাঁর পত্নী ড. সনজিদা খাতুন ডাকলেন ঢাকার সকল প্রগতিমনা সাংস্কৃতিক কর্মীকে পরিস্থিতি আলোচনার জন্য। ঐ বৈঠকে তাঁরা সামরিক সরকারের ঐ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা ঐ নির্দেশ মানবেন না। কারন এটা বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে খুন করার এক জঘন্য উদ্যোগ। তাই ওটাকে সম্মিলিতভাবে অমান্যের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।

অপরদিকে ১৯৬১ সালেই রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী। আর ঐ বছরেই এমন নিষেধাজ্ঞা। তাই নয় শুধু রবীন্দ্রনাথ যিনি মানবতার কবি, বিশ্ব ভ্রাত্বত্ববোধ জাগানিয়া কবি, বাঙ্গালি জাতির অমর গৌরব যিনি – যিনি প্রথম বাঙ্গালি যাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলী’র নোবেল পুরস্কার অর্জন করে সমগ্র জাতিকে গৌরবান্বিত করেন, যিনি তার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমগ্রবিশ্বে পরিচিত করেন। তাকে ধর্মান্ধ শাষকগোষ্ঠি রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধই শুধু ঘোষনা করলেন না আরও বহুদুর এগিয়ে গিয়ে বলে বসলেন, রবীন্দ্রনাথ মুসলমানের কবি না তিনি হিন্দু তিনি সাম্প্রদায়িক তাঁর জন্ম মৃত্যু সবই ভারতে তিনি ভারতের দালাল ইত্যাদি। ওরা ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন দমানোর জন্যও বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও একই অস্ত্রে ঘায়েল করতে অপচেষ্টার কোনটাই বাদ রাখেনি। তাই সেদিন (১৯৪৮ – ৫২ সালে) বাঙ্গালি তরুন সম্প্রদায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জীবন মরনপন করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল অদম্য বাঙ্গালি জাতি। সামরিক শাষকেরা সেদিন বুঝতে পারেনি তাদের এ অস্ত্রও ব্যর্থ হবে। তাই শুরু হলো পূর্ববাংলা ব্যাপি রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী পালনের, কোথাও দিনব্যাপি, কোথাও সপ্তাহব্যাপি, কোথাও বা মাসব্যাপি রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালনের সুসংগঠিত আয়োজন। ঢাকায় গঠিত হলো “ছায়ানট” উদ্দেশ্য রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উৎসব আকারে পালন করা। এবং তাই হলো। সেই থেকে শুরু হলো প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ অত্যন্ত জাঁকজমক পূর্ন ভাবে উদজাপন করা। আজও তা অব্যাহত আছে দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে এবং প্রতিবারই অধিকতর দর্শক শ্রোতার আগমন হচ্ছে এবং দিনে দিনে তা এতই বৃহৎ জনসমাগমে সমৃদ্ধ হচ্ছে যে রমনার বিশাল ময়দানে আর স্থান সংকুলান হচ্ছেনা। আমার ধারনা স্থান সংকুলান নিয়ে এখনই ভাবা শুরু করা প্রয়োজন এবং তা হয়ত ২০২০-২১ সালেই করতে হবে। বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলার মত হয়তো বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও পহেলা বৈশাখের রবীন্দ্র উৎসব প্রসারিত করতে হতে পারে। বাঙ্গালীর রবীন্দ্র প্রীতির আরও কি নমুনার বা প্রমানের দরকার আছে ?

আমরা তখন পাবনাতে। শাহাবুদ্দিনের হুংকার আমাদের মনেও প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল। বন্ধু বান্ধব সমেত আমরা কয়েকজন যুবক যারা তখন শিখাসংঘ নামক প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিও আয়োজন করতাম, তারাই আবার দেশ বিভাগ উত্তরকালে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর সাথে ছিলাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। লাইব্রেরীর একসিকিউটিভ কমিটির সদস্য থাকি বা না থাকি, কোন অনুষ্ঠান করতে হলেই ডাক পড়তো আমাদেও সেটি করায় সহযোগিতা করার জন্য। সিদ্ধান্তও নেয়া হতো আমাদের সাথে বসেই। এসে গেল রবীন্দ্র জন্ম শত বার্ষিকী। কমিটির সভায় আমরাও বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। সভায় আলোচনা শুরু হল জন্ম বার্ষিকী কিভাবে উদযাপন হবে তা নিয়ে। আমরা তখন কেউ ছাত্র ইউনিয়ন কেউ বা ন্যাপ করি। আমরা প্রস্তাব রাখলাম অন্যান্যবার পালন করা হত শুধুমাত্র রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী কিন্তু এবার তো পালিত হবে রবীন্দ্রজন্মশত বার্ষিকী। তাই এবারে পালিত হোক সপ্তাহব্যাপী উৎসব একদিনের নয়। সেই সপ্তাহব্যাপি উদযাপনের সিদ্ধান্তই গৃহীত হলো। তখন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটগণ পদাধিকার বলে ঐ পাবলিক লাইব্রেরীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি সভায় উপস্তিত হতে পারেন নি। তাই তৎকালীন সাধারন সম্পাদক প্রয়াত ভাষা সৈনিক রওশন জান চৌধুরী সিদ্ধান্ত হওয়ায় পরদিন জেলা ম্যাজিষ্ট্রটেটের বাংলোতে গিয়ে গৃহিত ঐ সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচী অবহিত করেন।

চৌধুরী সাহেবকে জানালেন যে ঐ দিনই তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত প্রাদেশিক সরকারের প্রচারিত সার্কুলার মারফত জানতে পেরেছেন যে রবীন্দ্রনাথের গানও সাহিত্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেন বেশী মাতামাতি না হয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত যা নিয়েছেন তা বাতিল করবেন কি-না কমিটির জরুরী বৈঠক ডেকে তা পুনর্বিবেচনা করুন। সঙ্গে আমরা কেউ ছিলাম না। ফিরে এসে সাধারন সম্পাদক পরদিন জরুরী বৈঠক ডাকলেন লাইব্রেরীর কার্য্যনির্বাহী কমিটির। যথারীতি আমরাও আমন্ত্রিত।

সভার শুরুতেই সাধারন সম্পাদক জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের বক্তব্য উপস্থাপিত করলে সভায় দ্বিমতের উদ্ভব হলো। কতিপয় সদস্য সরকারকে না ক্ষ্যাপানোই শ্রেয় বলে অভিমত দিয়ে বসলে আমরা সিদ্ধান্ত অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে দৃঢ়ভাবে আমাদেও মতামত জানালাম। যথেষ্ট তর্ক বিতর্কেও পরে সিদ্ধান্ত হলো অনুষ্ঠান সাতদিন ধরেই চলবে তবে সরকারীভাবে ঘোষনা করা হবে তিনদিনের। সাধারন সম্পাদক পুনরায় পরদিন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের বাংলোতে গিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত পুরোটাই জানালেন। সভাপতি বললেন, আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো কিন্তু সরকারী দায়িত্ব থাকায় আপনাদের সাথে ঐ অনুষ্ঠানে আমি উপস্তিত থাকতে পারবোনা তবে ঠিকই আছে ঘোষনা করুন তিনদিন আর পালন করুন সপ্তাহব্যপি। চৌধুরী সাহেব ঐ বলেছিলেন, সম্মানিত সদস্যবৃন্দ। মনে রাখবেন এই লাইব্রেরী বেসরকারী হলেও জনগনের টাকায় চলেনা সরকারী অনুদান প্রতিবছর নিতে হয়। তাই সন্ত্রস্ত ছিলাম ঐ সিদ্ধান্ত সভায় গৃহীত হলেও সভাপতি তা মানবেন কি না। তবে তিনি তাতে সম্মতি দেওয়ায় নিশ্চিন্তে আমরা তিনদিনের ঘোষনা দিয়ে সপ্তাহব্যাপী পালন করতে পারব। তাই তাই হলো মহাসমারোহে।

অত:পর শিখা সংঘের পক্ষ থেকে আমরাও তিনদিনব্যাপি উৎসব পালন করলাম। তখন পাবনার পাড়ায় পাড়ায় ছিল অনেকগুলি ক্লাব সেগুলোতে ব্যায়াম শিক্ষাদি ছাড়াও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি হতো। আর ওতেও ডাক পড়বো আমাদের। আমরাও সাগ্রহে সাড়া দিতাম। সেবারও এলো। এভাবেই পাবনাতে নজির বিহীন ভাবে শহড় জুড়ে মাসব্যাপী উৎসব পালিত হলো। এ এক নজির বিহীন ঘটনা।

যা হোক, পাবনার সে গৌরব আজ আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। একদিন শুধু পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয় সেখানে। অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী, পাবনা প্রেসক্লাব এবং আরও দু একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পহেলা বৈশাখ একদিনব্যাপী পালন করে থাকে।

রবীন্দ্রনাথ ও পহেলা বৈশাখ অবিচ্ছেদ্য। তাই এই লেখায় যথাযথভাবেই রবীন্দ্র প্রসঙ্গ আলোচিত হলো। আমি গর্বিত আজ বিশ্বব্যাপী বৈশাখী মেলা ছড়িয়ে দাও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!