কক্সবাজার কি জঙ্গী তৈরীর কারখানা হবে?

কক্সবাজার কি জঙ্গী তৈরীর কারখানা হবে?
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্যন্যাপ

কক্সবাজার উথিয়া যেমনও অপরূপ সৌন্দর্যম-িত এলাকা, যেমনও দেশী-বিদেশী পর্য্যটকের আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্র এবং পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত হিসেবে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া বাংলাদেশের অহংকার, তেমনই কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা নানাবিধ অপরাধের কেন্দ্রও হয়ে উঠেছে বেশ অনেকদিন যাবত। সবারই জানা ঐ এলাকায় একজন এম.পি ও ইয়াবা স¤্রাট ও কোটিপতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মনোনয়ন না পাওয়া এবং আওয়ামী লীগ থেকে তার এম.পি. হওয়া সম্ভব হয় নি। তাঁর স্থলে তাঁর স্ত্রীকে মনোনয়ন দিয়ে এম.পি. নির্বাচিত করে আনা হয়েছে। সুতরাং ঐ সাবেক এম.পি’র গড়ে তোলা সা¤্রাজ্য রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত হয়েছে। আরও অনেক ইয়াবা-সম্রাট এবং ইয়াবা চোরাচালানকারীর অস্তিত্বও সেখানে আগে থেকেও ছিল এখন তা বেড়েছে আরও বহুগুণে।

বিগত কয়েক বছর যাবত ঐ এলাকায় লাখে লাখে রোহিঙ্গা নর-নারী এসেছেন রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের নির্মম অত্যাচার সইতে নাপেরে। জনসংখ্যা বেড়েছে ভয়াবহভাবে। স্থানীয় মূল বাসিন্দারা পরিণত হয়েছেন একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে। ফলে ঐ সার্বিক ভারসাম্য দূরীভূত হয়ে এক অশান্ত ও দুর্বিসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশের অতিমাত্রায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা কক্সবাজারসহ তদুপরি পাঁচ লাখ স্থানীয় বাসিন্দার উপর ১১/১২ লাখ বাড়তি বাসিন্দার অতিরিক্ত চাপে এলাকাটি জর্জরিত।

রোহিঙ্গাদের তাদের নিজদেশে ফিরে যাওয়ার কথা। এ ব্যাপারে সরকার উদ্যোগী কিন্তু অনেকটা যেন অসহায়ের মত। একে মিয়ানমার সরকারের আচরণ রোহিঙ্গাদের স্বার্থ, অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার অনুকূল নয়-অপরদিকে জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায় উপযুক্ত পরিমাণ চাপ দিচ্ছেন না মিয়ানমারের সরকারের উপর। সর্বোপরি রোহিঙ্গারা নিজেরাই বাংলাদেশ ছেড়ে স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহী নন। ফলে দু’দফায় গৃহীত প্রত্যাবাসন উদ্যেগ ব্যর্থ হয়েছে। সহসা এ ব্যাপারে নতুন কোন উদ্যোগও যে সফল হবে তার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

তদুপরি জানা যাচ্ছে, ঐ এলাকায় কর্মরত শতাধিক দেশী-বিদেশী এন.জি.ও’র মধ্যে একাংশ তাদের ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ করা ও আয়েশী জীবন আরও দীর্ঘকাল বজায় রাখার স্বার্থে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরোধিতার অবর্তীর্ণ হয়েছে। তারা রোহিঙ্গা শিবিরগুলিতে নিয়মিত যাতায়ত করছে এবং রোহিঙ্গারা যাতে স্বদেশে ফিরে না যান তার জন্যে তাদেরকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছে।

শিবিরগুলিতে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের একটি বড় অংশ নানা অপরাধমূলক কার্য্যকলাপে লিপ্ত। সকল আইন ও নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা বে-আইনী অস্ত্রের ব্যবসা, ইয়াবা আমদানী, বাংলাদেশের নাগরিক সেজে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ বাংলাদেশের পাসপোর্ট তৈরী, হাতে হাতে দামী দামী মোবাইল ফোন প্রভৃতি সব কিছুরই মালিক এমন কাজ বাংলাদেশেরপ্রকৃত নাগরিকদের পক্ষেও করে ওঠা দূরূহ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের একাশং অঢেল টাকার মালিক হওয়াও পুলিশ, সাধারণ প্রশাসন, পাসপোর্ট অফিস সব কিছুই বে-আইনী অর্থের বিনিময়ে হাত করে ফেলেছে বলে অপরাধে তারা তাবৎ অপকর্মে লিপ্ত হতে পেরেছে।

রোহিঙ্গারা ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম হওয়াতে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মান্ধ দল ও প্রতিষ্ঠানগুলির বড্ড সুবিধা হয়েছে ঐ লাখ লাখ রোহিঙ্গার মস্তক ধোলাই করে তাবৎ অসৎ ও সন্ত্রাসী কাজে তাদেরকে লিপ্ত করতে। দেশের সংবাদপত্রগুলিতে খবর বেরিয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলিতে ১৫টিরও অধিক সশস্ত্র গ্রুপ তৈরী হয়েছে। শান্তি প্রিয় কক্সবাজারবাসীর জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে ঐ সশস্ত্র প্রুপগুলি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজারবাসী যেন স্বদেশে বিদেশী এবং রোহিঙ্গারা বিদেশে স্বদেশীতে পরিণত হচ্ছেন।

এমন কথাও অতীতে শুনা গেছে যে ঐ এলাকায় অনেকদিন যাবত সক্রিয়ভাবে কর্মরত রাজনৈতিক উগ্রপন্থী, রোহিঙ্গা উগ্রপন্থীদের সাথে হাত মিলিয়ে মিয়ানমারের আরাকানের সাথে কক্সবাজার মিলিয়ে একটি পৃথক ও স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐ এলাকাগুলিতে নানামুখী রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সন্ত্রাসী ক্রিয়াকলাপ চালাচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্ক বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ নজর দিয়ে যাচাই করা জরুরী প্রয়োজন কারণ এমনটি ঘটলে তা বাংলাদেশের নীতি আদর্শের প্রতি সাংঘর্ষিক এবং মিয়ানমারের সাথেও শত্রুতা সৃষ্টির একটি অশুভ উদ্যোগ। বাংলাদেশ বিরোধী দেশী বিদেশী নানা মহল এই চক্রান্তের সাথে জড়িত বলেও কখনও কখনও শুনা গেছে।

যাই শুনা যাক না কেন, তার সবটাই মিথ্যে এমনটি নাও হতে পারে। তাই সরকারের উচিত হবে সংশ্লিষ্ট সকল এজেন্সীর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে খোঁজখবর করা। সামান্যতম সত্যতা পাওয়া গেলে দ্রততার সাথে উপযুক্ত ব্যবস্থাদিও নেওয়া।
বস্তুত: রেহিঙ্গা শ্বরণার্থীরা সর্বাধিক মানবিকতা দরদ সহানুভূতি বাংলাদেশের সবার কাছে পেলেও তারা নিজেরাই তার মর্র্য্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। মানবিক সহানুভূতিই এখন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। তাই পরিস্থিতির নতুন করে মূল্যায়ন ও গভীরভাবে পর্য্যালোচনা অপরিহার্য্য হয়ে পড়েছে। দ্রুত হাজারে হাজারে সন্তান জন্ম দিয়ে রোহিঙ্গারা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি সংকট এভাবে বাড়িয়ে চলেছে তা ১১/১২ লক্ষ রোহিঙ্গা নর-নারী। কিন্তু এক কোটি বাঙালি ১৯৭১ এ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্য্যাতনে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অসংখ্য শরণার্থী শিবির খোলা হয়েছিল প্রধানত: সমগ্র পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায় সর্বত্র। সকল শরণার্থীরই লক্ষ্য ছিল কখন মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হবে কখন সবাই দেশে ফিরবেন। দেশে ফেরার জন্য সে কী আগ্রহ কী প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। সবার মুখেই ধ্বনিত হতো ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। তাই ১৯৭২ এর ডিসেম্বরে যখন মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হলো তখন দেশে ফেরার কি অসাধারণ উত্তেজনা সকলের চোখে মুখে ফুটে উঠলো।

তার মানে এই নয়, থাকা-খাওয়া নিয়ে বাঙালি শরণার্থীদের কোন অসুবিধা হচ্ছিল বা তাঁদের কারও মনে কোন ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাও অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে তখনও ছিল। কিন্তু কোন বাঙালি শরণার্থী কোন সশ্রস্ত্র গ্রুপ গঠন করে নি বা কোন প্রকার সন্ত্রাসী কার্য্যকলাপেও লিপ্ত হয় নি অবৈধ পস্থায় কেউ সেখানে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ বা কেউ কোনভাবে গিয়ে বহুতল বিশিষ্ট বাড়ীঘরও গড়ে তোলে নি। কোটি কোটি টাকার মালিকও হয় নি কেউ। শরণার্থী হিসেবে বিদেশে থাকা আরামদায়ক নয় কোথাও কিন্তু যুদ্ধাক্রান্ত দেশের চাইতে হাজার গুণ যে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেছিল ভারত সরকার ও ভারতবাসী তার জন্য সকলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে একটি বাঙালিও দ্বিধা করেন নি।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের বেলায় ঘটনা ঘটছে সম্পূর্ণ বিপরীত যা এদেশের অধিবাসীদের মধ্যে একজনও আশা করেন নি। আজ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ব্যাপী সারা দেশের মানুষই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুতই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য্য।

ঢাকা শহরের নানা জায়গায় অবস্থিত পুলিশ ক্যাম্পগুলিতে অতর্কিত বোমা হামলা বেশ কয়েকটি ঘটে গেল। এ ব্যাপারে জড়িত একজন সন্ত্রাসীকেও এ পর্য্যন্ত গ্রেফতার করা সম্ভব হয় নি। তবে যে কোন মুহুর্তে যে কোন স্থানে বড় ধরণের জঙ্গী সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে বলে পুলিশের আশংাক। তাই আইন শৃংখলা নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের সকল বাহিনী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।

মনে রাখা প্রয়োজন, যতই কেন গোপনীয়তা সন্ত্রাসী জঙ্গীরা বজায় রাখুক না কেন, তাদের সংখ্যা যে ইতোমধ্যে অনেক বেড়েছে এবং এই সংখ্যাবৃদ্ধির পিছনে রোহিঙ্গা জঙ্গী সন্ত্রাসীরাও থেকে যেতে পারে তাই সম্ভাব্য সকল এলাকা এবং সকল রোহিঙ্গা শিবিরে ব্যাপক এবং দফায় দফায় তল্লাসী চালানো, যে সরকারী কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিচ্ছেন, যাঁরা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র করে দিচ্ছেন এবং বিটিআরসি’র সন্ধানে অবৈধ সিম ও ফোন যাঁরা বিক্রি করছেন যাঁরা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে টাওয়ার নির্মাণ করে ইন্টারনেট সংযোগ নিতে রেহিঙ্গাদের কে সহায়তা করেছেন দ্রুত তাঁদের সকলকে আইনের আন অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন।

এই ব্যবস্থাদি অবলিম্বে গ্রহীত না হলো কক্সবাজার জঙ্গী তৈরীর কারখানায় পরিণত হবে উদ্বেগ সেখানেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!