কোলেস্টেরল নিয়ে অপপ্রচার কেন?

 

মুনীরউদ্দিন আহমদ । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডি.কম

কয়েক দশক ধরে আমাদের চিকিৎসকরা বলে আসছেন, কোলেস্টেরল স্ট্রোক ও হৃদরোগের মূল কারণ এবং এসব রোগ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে হবে। লাইফস্টাইল পরিবর্তন বা প্রাকৃতিক উপায়ে নয়, কোলেস্টেরল কমাতে হলে নামিদামি ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ১৯৮৭ সালে ‘দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এ প্রকাশ করেন যে ৫০ বয়ষোর্ধ্ব মানুষের মৃত্যুর কারণের সঙ্গে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই। ওই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আরো দেখা যায়, কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি কমে গেলে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এখানেই শেষ নয়। অতি সম্প্রতি ‘দ্য জার্নাল অব কার্ডিয়াক ফেলিয়ার’ ও জার্নাল ‘ল্যানসেট’ প্রকাশ করেছে, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে গেলে জটিল হৃদরোগীদের মৃত্যুহার বেড়ে যায়।

প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত কোলেস্টেরল স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কিন্তু কোলেস্টেরলকে  উচ্চতাপে পোড়ানো হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কোলেস্টেরল সহজে পরিবর্তনীয় নয়। কিন্তু ১২০ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রায় এক ঘণ্টা উত্তপ্ত করা হলে কোলেস্টেরল অক্সিডাইজেশনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক যৌগে রূপান্তরিত হয়। এগুলোকে ক্ষতিকর (Damaged) কোলেস্টেরল বলা হয়। এসব ক্ষতিকর উপাদানের মধ্যে রয়েছে ৭-আলফা হাইড্রোক্সিকোলেস্টেরল, ৭-বিটা হাইড্রোক্সিকোলেস্টেরল, ৫-আলফা ইপক্সিকোলেস্টেরল, ৫-বিটা ইপক্সিকোলেস্টেরল, কোলেস্টেনট্রায়ল ও ৭ কিটোকোলেস্টেরল। ২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হলে কোলেস্টেরলের গাঠনিক সংকেত (Structure) পুরো ভেঙে যায়। যেসব খাবার রান্না করার জন্য ১২০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রার দরকার হয়, সেসব খাবারে বিদ্যমান কোলেস্টেরল স্বাস্থ্যোপযোগী থাকে না, ক্ষতিকর কোলেস্টেরলে রূপান্তরিত হয়। কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ প্রাণিজ খাবার যেমন, খাসি, গরু, শূকর-জাতীয় পশুর মাংস উচ্চতাপে দীর্ঘক্ষণ ধরে রান্না করতে হয় বলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। কেউ যদি প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর কোলেস্টেরল ও ফ্রি রেডিক্যালসমৃদ্ধ খাবার খায়, তবে এসব ক্ষতিকর উপাদান রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেবে এবং ক্রমান্বয়ে শিরা-উপশিরার অভ্যন্তরের গায়ে জমতে শুরু করবে। তাই কেলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার দীর্ঘক্ষণ উচ্চ তাপে রান্না বা পোড়া তেলে ভাজা আপনার স্ট্রোক ও হৃদরোগের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে।

কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রাসায়নিক যৌগ। শরীরে পর্যাপ্ত কোলেস্টেরল না থাকলে ভিটামিন ডি, টেস্টোস্টেরন, ইসট্রোজেন ও অ্যালডোস্টেরন জাতীয় অত্যাবশ্যকীয় হরমোন উৎপাদন কমে যাবে। ফলে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে গেলে অসুস্থতার উপসর্গ দেখা দেবে, যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং শরীরে হতাশা বাসা বাঁধবে। কোলেস্টেরল কমানোর জন্য চিকিৎসকরা যাদের স্ট্যাটিন গ্রুপের (জেনেরিক : অ্যাটরভেস্ট্যাটিন, ব্র্যান্ড : লিপিটর, ম্যাভাকর, যুকর, প্যাবাকল, ল্যাসকল) ওষুধ প্রদান করেন, তাদের যৌন ক্ষমতা বা যৌন বাসনা প্রায় ক্ষেত্রে হ্রাস পায় নতুবা বিনষ্ট হয়ে যায় (Loss of libido)। এ সমস্যা নিয়ে অনেক রোগীকে আবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। অনেক চিকিৎসক তখন রোগীকে ভায়াগ্রা বা ওই জাতীয় বিপজ্জনক ওষুধ গ্রহণ করা বা এমন সব পরামর্শ দেন, যা করলে তাকে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের মনে রাখা দরকার। আমাদের শরীরের কয়েক ট্রিলিয়ন কোষের (Cell) প্রাচীর তৈরির জন্য কোলেস্টেরল একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কোলেস্টেরলের অভাবে কোষপ্রাচীর তৈরি হয় না বলে শরীরে পর্যাপ্ত কোলেস্টেরল থাকা বাধ্যতামূলক। মস্তিষ্কের মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশ কোলেস্টেরল। পর্যাপ্ত কোলেস্টেরলের অভাবে মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এত কিছুর পরও চিকিৎসকরা রোগীকে কোলেস্টেরল কমানোর জন্য একেবারে চকোলেট বা ক্যান্ডির মতো উচ্চ মাত্রার স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, তিন-চতুর্থাংশ রোগীর মধ্যে এ গ্রুপের ওষুধ কোনো কাজই করে না বা করলেও তা নগণ্য পরিমাণে করে। ‘কোচরান লাইব্রেরি’ কর্তৃক প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, ৩৪ হাজার রোগীর মধ্যে স্ট্যাটিনের ১৪টি ট্রায়ালের ফলাফলে রোগীদের মধ্যে হতাশা, মেজাজ পরিবর্তন, যকৃতের সমস্যা বা কর্মক্ষমতা হ্রাস, কিডনি বিকল হওয়া, চেখে ছানিপড়া, পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও সাময়িক স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া অন্যতম বলে প্রমাণিত হয়েছে। সারা বিশ্বে এখন স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধের রাজত্ব চলছে। ২০০৭ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে লিপিটরের বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় আট বিলিয়ন ডলার। আর সারা বিশ্বে এর বিক্রির পরিমাণ ছিল কম করে হলেও ১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকরা পাঁচ কোটি ৭০ লাখ রোগীকে লিপিটর প্রেসক্রাইব করেছিলেন। কেন এত মানুষ অ্যান্টিকোলেস্টেরল ওষুধ গ্রহণ করে? এ জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের একটা বড় ভূমিকা আছে। ২০০৪ সালে চিকিৎসকদের একটি দল স্ট্রোক আর হৃদরোগের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে এলডিএলের স্বাভাবিক মাত্রা ১৩০ থেকে ১০০তে নামিয়ে আনেন। হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর নাম করে তাঁরা আবার এলডিএলের মাত্রা ১০০ থেকে ৭০-এ নামিয়ে আনেন। এ মাত্রা কমিয়ে আনার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় দুই কোটি মানুষ লিপিটর গ্রহণের আওতায় চলে আসে। প্রিয় পাঠক, এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ফাইজারের একটি মাত্র ওষুধ কেন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। পরবর্তী সময়ে গোপন কথা প্রকাশ হয়ে যায় যে যেসব চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও চিকিৎসক কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর কাজে লিপ্ত ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কম্পানির একটি স্বার্থসংশিষ্ট যোগসূত্র ছিল। এই অনৈতিক অপকর্মের জন্য তাঁরা ১০টি কম্পানি থেকে প্রত্যেকে লাখ লাখ ডলার সম্মানী পেয়েছিলেন। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

কারো রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা যদি অস্বাভাবিক পর্যায়ে বেড়ে যায়, তা আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক নিয়মে ও লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিক মাত্রায় কমিয়ে আনতে পারি। প্রাকৃতিক উপায়ে কোলেস্টেরল কমানোর পরিবর্তে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ক্ষতিকর ওষুধ খেয়ে আমরা নিজেদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিটাই বেশি করি। আমরা অনেক সময় অসুস্থ হয়ে থাকি স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ন্যূনতম যে সাধারণ জ্ঞানটুকু থাকার দরকার, তা অর্জন করতেও আমাদের প্রচণ্ড অনীহা। স্বেচ্ছাচারিতা বা বাড়াবাড়ির কারণে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়লে সুস্থ হওয়া বা সুস্থ থাকার জন্য আমরা অতিমাত্রায় আত্মসচেতন হয়ে পড়ি। অমূলক ভয়ভীতির কারণে জীবনযাপন বা খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে এমন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করি, যা আবার বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। সুখী ও সুস্থ জীবনের জন্য সব সময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়। আমাদের ধারণা, কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার খেলেই শুধু রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার যেমন খাসি, গরু, শূকরের মাংস, ডিম, দুধ, যকৃৎ, মগজ ইত্যাদি খেলে রক্তে যে পরিমাণে কোলেস্টেরল বাড়ে তার চেয়ে বেশি কোলেস্টেরল তৈরি হয় মাত্রাধিক চিনি, ভাত, রুটিজাতীয় খাবার থেকে। অসংখ্য তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বলা হয়ে থাকে যে কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার খেলে শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রায় তেমন কোনো হেরফের হয় না। এসব খাবার খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কিছু বাড়লেও তা শরীরে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। তার প্রধান কারণ, শরীরের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কোলেস্টেরল তৈরি হয় লিভার কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার থেকে উৎপন্ন গ্লুুকোজ থেকে। বাকি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ  কোলেস্টেরল আসে কোলেস্টেরল মৃদ্ধ খাবার থেকে। বিশ্বায়নের কারণে আমাদের খাদ্যাভ্যাস অতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। শুধু ছোটরা নয়, বয়স্করাও আজকাল ফাস্ট ফুড বা জাঙ্কফুডে আসক্ত হয়ে পড়ছে। সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের অলিগলির যেদিকে তাকাই শুধু রংবেরঙের ফাস্ট ফুডের দোকানই দেখি। এসব দোকানে ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। এসব ফাস্ট ফুডের দোকানে যেসব খাবার বিক্রি হয় তাতে প্রচুর লবণ, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল ও ট্রান্সফ্যাট থাকে। এ ছাড়া থাকে মাত্রাতিরিক্ত চিনিসমৃদ্ধ ফলের রস ও কোমল পানীয়। উল্লিখিত সব খাবারই বয়স্ক লোকদের স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ তাপে তেলে বা ট্রান্সফ্যাটে পোড়া সব খাবারই স্ট্রোক ও হৃদরোগের মূল কারণ।

দক্ষিণ ক্যারোলাইনার বয়স্ক মানুষের ওপর পরিচালিত এক বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পনির, বাটার, সসিজ, শূকরের মাংস, সম্পূর্ণ দুধ, ডিম, প্রাণিজ চর্বি, লাল গোশতজাতীয় তথাকথিত খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে শরীরের কোলেস্টেরল মাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিদিন একটি করে ডিম খেলে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ে না বা থাকে না। বলা হচ্ছে, প্রতিদিন দুটি করে ডিম খেলেও সুস্থ মানুষের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে না। অথচ বছরের পর বছর ডিমের সাদা অংশ খেতে খেতে আমরা আসল ডিমের স্বাদই ভুলে গেছি। উদার প্রকৃতির চিকিৎসক হলে হয়তো তিনি সপ্তাহে একটি বা দুটি ডিম খাওয়ার কথা সুপারিশ করবেন। অনুন্নত বিশ্বে স্ট্রোক ও হৃদরোগের ভয়ে মানুষ বাটার বা মাখন খায় না। অথচ বাটার শরীরের জন্য অতি দরকারি ও উপকারি একটি খাবার। বাটারে রয়েছে ভিটামিন-ই, ভিটামিন কে-২ ও ভিটামিন-এ। এ ছাড়া বাটারে রয়েছে দরকারি খনিজ পদার্থ, স্বাস্থ্যসম্মত চর্বি, আয়োডিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ক্যান্সার নিরোধক উচ্চমানের লিনোলিক এসিড। ডিম সম্পর্কেও আমাদের রয়েছে বড় মাপের ভ্রান্ত ধারণা। অথচ ডিম হলো দুধের মতো একটি অত্যাবশ্যকীয় সুষম খাবার। ডিমে রয়েছে প্রোটিন বা আমিষ, চর্বি, কোলিন, সেলেনিয়াম, বায়োটিন, বি-ভিটামিন, ফসফরাস, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট লিউটিন ও জিয়াজেন্থিন। কোলেস্টেরলের ভয়ে আমরা এত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বর্জন করে চলেছি বছরের পর বছর। ডিম কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এবং এই কোলেস্টেরল হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের জন্য দায়ী এ ধরনের কথার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বহু মানুষ দুধ খায় না চর্বির ভয়ে। বাজারে যেসব দুধ পাওয়া যায়, তার মধ্যে অধিকাংশ চর্বি মুক্ত বা এক থেকে ১.৫ শতাংশ চর্বি রয়েছে বলে বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হয়। বিদেশেও আমি ঠিক একই প্র্যাকটিস দেখে এসেছি। দুধে শতকরা এক বা ১.৫ শতাংশ চর্বির পরিবর্তে ৫ শতাংশ চর্বি থাকলে সেই দুধ স্বাস্থ্যসম্মত হবে না বা খাওয়া যাবে না, এ রকম ভাবার কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ নেই। তার পরও ডিম, দুধ ও বাটার খাওয়ার ব্যাপারে আমরা অতি মাত্রায় নৈর্বাচনিক ও রক্ষণশীল হয়ে পড়েছি। সমীক্ষার ফল এটাই সমর্থন করে যে আমরা অতীতে যা ভাবতাম, খাদ্য থেকে প্রাপ্ত কোলেস্টেরল তার চেয়ে অনেক কম ক্ষতিকর। ক্রিস মাস্টারজন কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টি বিজ্ঞানের ওপর পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি বলেন, প্রতিদিনের কার্যসম্পাদনের জন্য শরীরের যে পরিমাণ কোলেস্টেরল দরকার, সেই পরিমাণ কোলেস্টেরল আমরা খাবার থেকে গ্রহণ করতে পারি না বলে শরীর নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নিজেই কোলেস্টেরল সংশ্লেষণ করে থাকে। আমরা কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার থেকে যদি বেশি পরিমাণ কোলেস্টেরল গ্রহণ করি, তবে শরীর ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য কম পরিমাণ কোলেস্টেরল তৈরি করবে। ডিম, দুধ, বাটার বা যকৃতের মতো কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিলে আমাদের শরীর এই অত্যাবশ্যকীয় যৌগটির সংশ্লেষণ (Synthesis) বাড়িয়ে দেয়। ৭০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার সামান্য পরিমাণ কোলেস্টেরল বাড়ায় বা একদম বাড়ায় না। বাকি ৩০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়, তবে এই বর্ধিত কোলেস্টেরলের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কোনো সম্পর্ক আছে বলে বিজ্ঞান সমর্থন করে না। গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়নি যে শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়লে তা স্বাস্থ্যহানির কারণ হবে।

মাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক গবেষক ড. স্টেফানি সেনেফ মনে করেন, মানসম্পন্ন আমেরিকান খাবার থেকে অতি মাত্রায় কোলেস্টেরল পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু রক্ষণশীল খাদ্যাভ্যাসের কারণে অনেকেই অতি অল্প কোলেস্টেরল গ্রহণ করে থাকে, যা শরীরের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ওয়েস্টন এ. প্রাইস নামের একজন গবেষক বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিটি দেশের দেশজ খাবারের ভূমিকা কী তা পরীক্ষা করার জন্য। গবেষণায় তিনি দেখতে পান, কোলেস্টেরলের বর্তমান মানদণ্ডের হিসাবে প্রতিটি দেশের মূল দেশজ খাবার অতিমাত্রায় কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ। সামুদ্রিক মাছের ডিম, লিভার, শূকরের অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ডের মতো খাবারে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল রয়েছে। এসব খাবার খাওয়া অনেক দেশের মানুষের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ এসব খাবার খাওয়ার কারণে ওসব দেশের মানুষ হৃদরোগ ও অন্যান্য আধুনিক রোগে অধিকহারে আক্রান্ত হয়েছে বা হচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ড. সেনেফ মনে করেন, শরীরে কোলেস্টেরল মাত্রার সর্বোচ্চ সীমারেখা বা নিম্ন সীমারেখা নির্ধারণ মানুষের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করেছে।

স্ট্রোক, হৃদরোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমরা কিছু পন্থা অবলম্বন করতে পারি। এক. খাদ্য তালিকা হতে হবে পরিমিত ও সুষম। খাবার নিয়ে বাড়াবাড়ি ভালো নয়। দুই. কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারের পরিমাণ কমাতে হবে। চিনিসমৃদ্ধ খাবার ও কোমল পানীয় বর্জন করা দরকার। সাম্প্রতিককালের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, অতিমাত্রায় ‘হাই ফ্রুকটোস কর্ন সিরাপ’ গ্রহণ করার কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। চিনি ছাড়াও ফ্রুকটোস কর্ন সিরাপ ব্যবহার করে ইদানীং কোমল পানীয়গুলো প্রস্তুত হচ্ছে। চিনিভর্তি এসব কোমল পানীয়ের প্রতি অনেকেরই প্রচণ্ড আসক্তি রয়েছে। অতি মাত্রায় চিনি, হাই ফ্রুকটোস কর্ন সিরাপ, বেশি ভাত-রুটি বা স্টার্চ-জাতীয় খাবার খেলে বাড়তি কার্বোহাইড্রেট লিভারে চর্বি ও ডায়াবেটিস জাতীয় রোগ তৈরি করে। ফাইবার বা আঁশজাতীয় শাকসবজি, ফলমূল, খোসাযুক্ত আটা ও চাল খাবারের মূল অংশ হতে হবে। স্বাস্থ্যের উপযোগী চর্বির জন্য অ্যাভাকাডো, অলিভ, নারিকেল, দুধ, ডিম, বাটার, পনির, মিঠা পানির মাছ খাওয়া আবশ্যক। তেলে পোড়া খাবার, আগুনে ঝলসানো ও উচ্চ তাপে রান্না প্রাণিজ খাবার কম খেতে হবে। প্রতিদিন অন্তত তিন লিটার পানি পান অত্যাবশ্যক। বাকি থাকল ব্যায়াম। অবশ্যই প্রতিদিন পর্যাপ্ত ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়াম স্ট্রোক, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বহু জটিল রোগ থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারে।

সবাই নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করুন ও সুস্থ থাকুন।

লেখক : অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

drmuniruddin@gmail.com

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!