ঘাটাইলের বনাঞ্চলে ১৮০টি করাত কল

 

 

এম.এস.এস.সৌরভ, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায় বনের ভিতরে লাইসেন্স ছাড়াই বনকর্মকর্তাদের মৌখিক অনুমতিক্রমে চলছে ১২০ করাত কল এবং বনের কোল ঘেষে এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে উঠেছে আরও ৬০ করাতকল। এইসব অবৈধ করাত কলে বৈধ গাছ ছাড়াও প্রতিদিন বনের গাছ চিড়াই করে গোপনে কাঠ বাইরে পাচার করায় বনাঞ্চল ছাড়াও সংরক্ষিত বন দিন দিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে।

বন বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন না করায় একদিকে যেমন হারিয়ে যাচ্ছে বন অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে তার রাজস্ব। সেই সাথে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার পরিবেশ। অতিরিক্ত বন নিধনে বিপর্যস্ত হচ্ছে গোটা জাতি।

জানা যায়, ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া রেঞ্চের আওতাধীন ৮৮.৪৫ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চলের বটতলী, ঝড়কা, চৌড়াসা, দেওপাড়া, ধলাপাড়া ও সাগরদিঘী ৬টি বিটের ৪৯টি মৌজায় বনভূমি ও সংরক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ২৯১০৬.৭৬ একর। এই বিশাল বনভূমিতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির আকাশমণি, মিনজিয়াম, ইউকিলিপটাস, সেগুন সহ গজারির শালবন। এই শালবনের ভিতরে ডিজেল মেশিন দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে ১২০ করাত কল। এইসব করাতকল ও অতিরিক্ত গাছ চুরির কারণে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকার বাগান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। করাতকলের বিরুদ্ধে অভিযান না থাকায় অনেক সংরক্ষিত বাগান বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

২০১৭ সালের ২রা আগষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল কাশেম মোহাম্মদ শাহীন, বটতলী বিট অফিসার মোশারফ হোসেন ও ধলাপাড়া বিট অফিসার জাহিদের উপস্থিতিতে দেউলাবাড়ী ইউনিয়নে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ৫টি করাত কল জব্দ করে। সে অনুযায়ী ঐসব করাতকলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া কথা থাকলেও ১৪ দিন পর ঐসব করাতকল মালিকদের ফেরত দেয় কর্তৃপক্ষ।

“পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই, নেই ভূমি অফিসের প্রত্যয়ন পত্র, বনকর্মকর্তাদের মৌখিক অনুমতি দিয়েই চলছে এইসব করাত কল”

আরও জানা যায়, বন বিভাগের বিধানে বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে করাতকল স্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও বন কর্মকর্তাদের এককালিন মোটা টাকা সেলামী দিয়ে মিল মালিকরা এসব মিল স্থাপন করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, রেঞ্চ অফিস ও বিট অফিসের নাকের ডগায় মিল মালিকরা করাতকল স্থাপন করে দিনরাত চোরাই কাঠ চিড়াই করছে। সংশ্লিষ্ট রেঞ্চ কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তা ও ফরেষ্ট গার্ডদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় বছরের পর বছর জুড়ে এসব মিল চালু রয়েছে। ১৮০ করাত কলের প্রায় অর্ধেক করাতকল গত দুই বছরে নতুন স্থাপন করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এসব নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে কোন কর্তৃপক্ষ নেই ঘাটাইলে। বনাঞ্চল সহ পরিবেশ রক্ষার্থে উপজেলায় বন ও পরিবেশ কমিটি থাকলেও এ কমিটির কার্যক্রম চলছে শুধু কাগজে কলমে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বনের ভিতরে কুশারিয়া, মাকড়াই, দেওজানা, নলমা, গাঞ্জানা, ছনখোলা, চাপড়ি, মুন্সিগঞ্জ, মানিকপুর, বোয়ালীহাটবাড়ী, ধলাপাড়া, পেচারআটা, শহরগোপিনপুর, সাগরদিঘী, জোড়দিঘী, মুরাইদ, আবেদ আলী, লক্ষিন্দর, সিংহেরচালা, গারোবাজার, দেওপাড়া, শিবেরপাড়া, মালেঙ্গা, মমিনপুর, বগা, ফকিরচালা সহ বিভিন্ন স্থানে ডিজেল মেশিন দিয়ে গড়ে উঠেছে ১২০টি করাতকল। সেই সাথে বনের কোল ঘেষে আমতলা, দেউলাবাড়ী, পাকুটিয়া, পোড়াবাড়ী, কাইতকাই, ঝড়কা, বানিয়াপাড়া, মাইধারচালা, দেলুটিয়া লাইসেন্স ছাড়া ঘুষ দিয়ে চলছে আরও ৬০ করাতকল।

রসুলপুর ইউনিয়নে মুরাইদ দক্ষিণ পাড়া বনের ভিতরে গড়ে উঠেছে কয়লা উৎপাদনের মিল। প্রতিদিন বনের গাছ কেটে এ সব কয়লা উৎপাদন করা হচ্ছে। যার ফলে যত্র তত্র করাত কল স্থাপন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় বনাঞ্চল ছাড়াও সংরক্ষিত বন আজ হুমকির মুখে দাড়িয়েছে।

এইসব অবৈধ করাত কলের বিষয়ে পৌর করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আঃ হালিম এর নিকট জানতে চাইলে তিনি জানান, ঘাটাইল উপজেলায় ২শতাধিক করাতকল লাইসেন্স বিহীন চলছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বার বার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললে ২০১৭ সালের ২ আগষ্ট যে অভিযান হয় তা ছিল নাটকীয়। পরে কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে জব্দকৃত করাতকল মালিকদের ফেরত দেয়।

মিল মলিক ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, বনের ভিতরে এসব করাতকলের ৯০ ভাগ মালিক কাঠ ব্যবসায়ী। কাঠ চোরদের সাথে মিল মালিকদের রয়েছে দহরম সর্ম্পক। যারা সর্বদা গাছ চুরি করে তাদের মধ্যেও অনেকে সঙ্গবদ্ধ হয়ে করাতকল স্থাপন করে অবাধে বনের গাছ নিধন করে যাচ্ছে।

অবৈধ করাত কল কিভাবে চলে জানতে চাইলে দেউলাবাড়ী ইউনিয়ন করাতকল মালিক সমিতির সেক্রেটারী ওমর ফারুক জানান, দশজনের মতো করে কর্তৃপক্ষের সাথে মিলে মিশেই চালাই।

নতুন নতুন করাতকল স্থাপন করার বিষয়ে বটতলী বিট কর্মকর্তা সোলায়মানের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিভাবে স্থাপন হয় তা আমি জানি না তবে আমি কোন টাকা পয়সা নেইনা।

অবৈধ করাত কলের বিষয়ে ধলাপাড়া রেঞ্চ কর্মকর্তা রেজাউল করিমের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব করাত কল কিভাবে চলে আমি নিজেও জানি না। তবে করাত কল স্থাপনের সাথে আমি কিংবা আমার বিট অফিসারের কোন সম্পৃক্ততা নাই। তাহলে কিভাবে এইসব মিল স্থাপিত হয় বা চলে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে বলেন, সাক্ষাতে কথা বলব বলে মোবাইলের লাইন কেটে দেন।

করাতকল বন্ধ করার বিষয়ে উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান এর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপজেলা মাসিক মিটিং চলাকালে অবৈধ করাতকল বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনেকবার বলা হয়েছে। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি আরও বলেন, যারাই রক্ষক তারাই ভক্ষন করে তাহলে বন রক্ষা হবে কিভাবে?


কাগজটুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!