টাঙ্গাইলে পরিবার বলয়মুক্ত প্রথম পৌর নির্বাচন ॥ চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ

 

সম্পাদকীয় ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডি.কম

স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে সবসময় নিয়ন্ত্রণ থেকেছে খান ও সিদ্দিকী পরিবারের। এই দুই পরিবারের মধ্যে এক পরিবারের গাঁয়ে লেগেছে সন্ত্রাসী তকমা আর অপর পরিবার বিচ্ছিন্ন রাজনীতির মূল ধারা থেকে। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম কোনো নির্বাচন হচ্ছে যেখানে এই দুটি প্রভাবশালী পরিবারের কেউই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। ফলে টাঙ্গাইলের আট পৌরসভায় ভোটের হিসাব হচ্ছে নতুন সমীকরণে। প্রার্থীদের জোড়ালো প্রচারণা চলছে পৌর এলাকায়। নির্বাচনী উৎসব বিরাজ করছে ৮টি পৌরসভায়। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আলোচনায় প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজের চেয়ে দলীয় প্রতীকই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। পাশাপাশি গুরুত্ব পাচ্ছে প্রার্থীদের ব্যক্তি ইমেজ। প্রধান দুই দলের লড়াইয়ে মূল অস্ত্র দলীয় প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষ। জেলার আট পৌরসভার এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের মর্যাদার লড়াই আর বিএনপির জন্য মরণ কামড় হিসেবেই দেখছেন জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

সরেজমিনে দেখাগেছে, চায়ের আড্ডা থেকে রাজপথ, সর্বত্র চলছে নির্বাচনী আলাপ-আলোচনা। প্রতীক ও প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজ প্রভাব ফেলছে ভোটারদের উপর। জেলার রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে; ৩০ ডিসেম্বর কারা বিজয় উৎসব করবে, আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি? তবে জয়ের স্বপ্ন নিয়ে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন দুই দলের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা।

জয়ের ব্যাপরে উভয় দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীরাই আশাবাদী। টাঙ্গাইলের ৮টি পৌরসভার মধ্যে ৭টিতেই বর্তমানে আওয়ামী লীগের মেয়র রয়েছেন। এটা আওয়ামী লীগের জন্য সহায়ক। তবে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে আওয়ামীলীগ প্রার্থীদের জন্য ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য আওয়ামীলীগ দলীয় প্রার্থীরাও কোমরবেঁধে মাঠে রয়েছেন।

অপরদিকে, টাঙ্গাইলের পৌর নির্বাচনের মাঠে একক প্রার্থী রয়েছে বিএনপির। তবে বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কাও রয়েছে। তারপরও বিএনপির প্রার্থীরাও নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সর্বশক্তি নিয়ে। প্রথমদিকে বিএনপি প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করলেও তা হয়নি। ফলে ফুরফুরে আমেজে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা।

টাঙ্গাইল সদর পৌরসভায় আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন প্রথমে আওয়ামীলীগ, মাঝে কৃষক শ্রমিক জনতালীগ সর্বশেষ আবার আওয়ামীলীগে ফিরে আসা দু’বারের নির্বাচিত সফল মেয়র জামিলুর রহমান মিরন। নেতাকর্মীরা তার পাশে থাকলেও আওয়ামী লীগের ‘খান পরিবার’ সমর্থিত কর্মীরা এখনও তাকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া দল পরিবর্তন করা কারণেও তিনি কিছুটা সমালোচনায় পড়েছেন। তারপরও তিনি দলের একক প্রার্থী। এ পৌরসভায় আওয়ামীলীগের কোন বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। মেয়র প্রার্থী জামিলুর রহমান মিলন বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মধ্যে। সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য মুক্ত টাঙ্গাইল হবে এটাই তার অঙ্গীকার।

অন্যদিকে, সদর পৌরসভায় বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দৌহিত্র ও টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক সফল চেয়ারম্যান শামসুল হকের ছেলে মাহমুদুল হক সানু। নির্বাচনী বিজয় ছিনিয়ে আনতে রাত-দিন একাকার করে ভোট প্রার্থনায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। মেয়র প্রার্থী মাহমুদুল হক সানু বলেন, পারিবারিক গন্ডির বাইরে জনগন এবার ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ আচরণ করছেন না অভিযোগ করে তিনি বলেন, ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারলে তিনি জয়ী হবেন।

উন্নয়নের আশ্বাস আর স্বপ্নজাগানিয়া কথার ফুলঝুরি নিয়ে ভোটারদের মুখোমুখি হচ্ছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর পরে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন পৌরসভার মেয়র প্রার্থীরা। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় জেলার ৮ পৌরসভা নির্বাচনে ৪টি রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও অধিকাংশ পৌরসভায় নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীদের ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে, প্রধান এ দু’দলে মধ্যেই মূল লড়াই হবে।

এদিকে পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করতে সবধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলা নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন। স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা ধারনা করছেন, জেলা প্রশাসনের কঠোরতার ওপরই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া-না হওয়া নির্ভর করছে। জেলা নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী জেলার ৮টি পৌরসভায় বিভিন্ন দলের ২৫ জন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

টাঙ্গাইল পৌরসভা ২৯.৩৪ বর্গকিলোমিটার আয়তন ও ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পৌর এলাকার মোট ভোটার ৯৪ হাজার ৬৪৪জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪৬ হাজার ১৩০ ও নারী ভোটার ৪৮ হাজার ৫১৪ জন। হালনাগাদ ভোটার নিয়ে নতুন ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার।

টাঙ্গাইলের ৮ পৌরসভায় বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে লড়ছেনঃ টাঙ্গাইল সদরে মাহমুদুল হক সানুভূঞাপুরে আব্দুল খালেক মন্ডল, মধুপুরে শহীদুল ইসলাম সরকার (সরকার শহীদ), ধনবাড়ীতে আব্দুস সোবহান, মির্জাপুরে হযরত আলী মিঞা, গোপালপুরে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও বর্তমান মেয়র খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম রুবেল, সখিপুরে নাসির উদ্দিন ও কালিহাতীতে উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আলী আকবর জব্বার।

টাঙ্গাইলের ৮ পৌরসভায় আওয়ামীলীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচনে লড়ছেনঃ টাঙ্গাইল সদরে সাবেক মেয়র জামিলুর রহমান মিরন, ভূঞাপুরে বর্তমান মেয়র মাসুদুল হক মাসুদ, মধুপুের মাসুদ পারভেজ, ধনবাড়ীতে বর্তমান মেয়র খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম তপন; মির্জাপুরে সাহাদৎ হোসেন সুমন; গোপালপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রকিবুল হক ছানা; সখিপুরে বর্তমান মেয়র আবু হানিফ আজাদ ও কালিহাতীতে বর্তমান মেয়র ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী বিকম।

তবে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে চারটি পৌরসভায় মেয়র পদে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতা। তারা হচ্ছেন গোপালপুরে বেলায়েত হোসেন ও আশরাফুজ্জামান আজাদ, ভূঞাপুরে আজহারুল ইসলাম, ধনবাড়ীতে জহুরুল ইসলাম হেলাল ও কালিহাতীতে হুমায়ুন খালিদ। দলীয় নির্দেশনা অমান্য প্রার্থী হওয়ায় গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে জেলা আওয়ামীলীগ তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করেছে।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ শামছুল আলম তোফা জানান, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হলে এবং ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে পৌর নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হবেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জানান, পৌরসভা নির্বাচনে খান ও সিদ্দিকী এই দুই পরিবারের কোনো প্রভাব নেই। তিনি বলেন, দলের নির্দেশনা অমান্য করে যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। বহিস্কৃতরা দলের কেউ নন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জনগন দলীয় প্রার্থীদের ভোট দেবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, জেলার পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম টাঙ্গাইলের কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে খান ও সিদ্দিকী পরিবারের প্রভাবমুক্ত পরিবেশে। এ দু’পরিবারের কোন প্রার্থীও নেই নির্বাচনে। টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী দুই পরিবারের মধ্যে হজ ও তাবলীগ জামাত নিয়ে মন্তব্য করে দল ও রাজনীতির বাইরে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। অন্য দিকে নিজ দলে নেতাকে হত্যা মামলায় ফেঁসে গেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান খানের ভাতিজা আমানুর রহমান খান। ১২৮ বছরের পুরনো টাঙ্গাইল পৌরসভায় বর্তমান মেয়রও এই পরিবারের। সন্ত্রাস ও খুনের অভিযোগে খান পরিবারের চার ভাই এখন পলাতক।

টাঙ্গাইলে এক সময় খান ও সিদ্দিকী পরিবারের কথায় বাঘে মহিষে জল খেত এক ঘাঁটে। এবারই প্রথম তাদের প্রভাবের বাইরে টাঙ্গাইলের আট পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেড়িয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ছোট ভাই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী গঠন করেন ‘কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ’। আগের সব নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও এবার ভোটের বাইরে দলটি। আলোচিত দুই পরিবার এখন কোনঠাসা। পৌরভোটের মাধ্যমে নতুন আবহে চলে যাচ্ছে টাঙ্গাইলের রাজনীতি। টাঙ্গাইলের ভোটাররা চায় এবার নির্বাচন হবে সন্ত্রাস এবং হানাহানী মুক্ত।

মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!