‘তুই রাজাকার’ থেকে ‘আমি রাজাকার’

সব শব্দেরই একটা আভিধানিক অর্থ থাকে। ‘রাজাকার’ শব্দটিরও আছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ‘রাজাকার’ শব্দটি আভিধানিক অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯৭১ সালে জামায়াত নেতারা গঠন করেছিল ‘রাজাকার’। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। রাজাকাররা পাকিস্তানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এহেনো অপকর্ম নেই, যা করেনি। নিজেরা খুন-ধর্ষণ-আগুন দিয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীকে ধর্ষণে-খুনে-আগুন দেওয়া সহায়তা করেছে। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ শব্দটি সবচেয়ে অসম্মানজনক একটি গালিতে পরিণত হয়েছে। ‘রাজাকার’ শব্দটির চেয়ে অসম্মানজনক আর কোনো গালি সম্ভবত এখন বাংলা ভাষায় নেই।

নাটকে পাখির মুখ দিয়ে ‘তুই রাজাকার’ শব্দটি বলিয়েছিলেন কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বাঙালির বা মধ্যবিত্তের মনস্তত্ত্ব বোঝার শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। ‘তুই রাজাকার’ শব্দের ব্যবহার তার একটি বড় প্রমাণ। সেই সময় প্রায় সব মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে ‘তুই রাজাকার’ শব্দটি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের প্রতি মানুষের যে ঘৃণা তা এই একটি শব্দ, ‘তুই রাজাকার’ শব্দটির মধ্য দিয়ে অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। সাধারণ জনমানুষের চেতনাজগতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, যুদ্ধাপরাধ বিষয়টি আলোড়ন তৈরি করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির সঙ্গে জনমানুষের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। তারপর একটা লম্বা সময় গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারা দেশ উত্তাল হয়েছে। থেমেও গেছে একটা সময়। নতুন করে ‘তুই রাজাকার’ শব্দ ভিন্নমাত্রা নিয়ে তরুণ সমাজের মুখে এসেছে গণজাগরণ মঞ্চকে কেন্দ্র করে। ‘ক’ তে কাদের মোল্লা ‘তুই রাজাকার’- অভিনব জনপ্রিয় সেøাগান হিসেবে তরুণ সমাজের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। যার প্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের আন্তরিকতা তো অবশ্যই ছিল। সেই আন্তরিকতায় পুরো বাংলাদেশ সমর্থন জুগিয়েছে।

২.
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, শেখ হাসিনা সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সাহসী কাজ। এই কাজটির জন্যে ইতিহাস মনে রাখবে শেখ হাসিনাকে। যুদ্ধাপরাধের বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ অসত্য নয়, খারাপ কিছুও নয়। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল, সেই দলটি একটি কাজ করে তার সুবিধা রাজনৈতিকভাবে নিতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে দোষের কিছু দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। প্রজ্ঞার অনেক কিছু দেখি যে, য্দ্ধুাপরাধের বিচারের মতো একটি ইস্যু আওয়ামী লীগ ধারণ করার সাহস দেখিয়েছে, সফল হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি নির্বাচনী ইশতেহারে নিয়ে আসাটা আওয়ামী লীগের অত্যন্ত দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল। এটা যে দেশের মানুষের কত বড় চাওয়া, তা তারা বুঝতে পেরেছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়ে, এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সম্পৃক্ততা হয়তো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়েছিল। দেশের যে তরুণ সমাজ, যাদের ক্ষেত্রে বলা হতো তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়ে নেই। তারা পেছনে না ফিরে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা যে প্রজন্ম তারা হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ ধারণ করে না, এমন একটা প্রচারণা ছিল। একই রকম প্রচারণা ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়েও। এটা যে কত বড় ভুল ধারণা ছিল, তা যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় প্রমাণ হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল শিক্ষার্থী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যারা প্রচলিত ধারায় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তারা ‘তুই রাজাকার’ সেøাগান হৃদয়ে ধারণ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণজাগরণ মঞ্চকে উত্তাল করে তুলেছিল।

৩.
যে কোনো জিনিসের ‘অতি ব্যবহার’ ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। ‘রাজাকার’ শব্দটির অতি ব্যবহার করা হয়ে গেছে। অতি ব্যবহারেও হয়তো সমস্যা ছিল না, যদি তা প্রাসঙ্গিকভাবে ব্যবহার করা হতো। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার পর থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং সরকার ‘রাজাকার’ শব্দটি অপব্যবহার শুরু করেছে। যত সময় গেছে, অপব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে। সরকারের যে কোনো কাজের সমালোচনা করলেই ‘রাজাকার’ শব্দটি ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বড় আকার ধারণ করেছে। অনিয়ম দুর্নীতিগুলোও হয়েছে বড় বড়। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি দিয়ে ভয়াবহ দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে। যারা সুনির্দিষ্টভাবে এই দুর্নীতি এবং দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের লোকজনের বিষয়ে কথা বলেছেন, তাদেরকে বলা হয়েছে ‘রাজাকার’ ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী’ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল ষড়যন্ত্রকারী’। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, শেয়ারবাজার, অবকাঠামো নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ পাচার যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বললেই তাকে জামায়াত বা রাজাকার বলা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক, যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, কেউ আওয়ামী লীগের ‘রাজাকার’ ট্যাগ থেকে রেহাই পায়নি।

৪.
যে ছেলেটি অন্য কোনো রাজনীতি বা আন্দোলনে থাকে না, সেও ‘তুই রাজাকার’ সেøাগান নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চে এসেছিল। সেই ছেলেটিই এখন এসেছে ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনের দাবি নিয়ে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে এসেছিল, সে মনে করেছিল অপরাধীদের বিচার হতে হবে। সে জেনেছিল ১৯৭১ সালে কাদের মোল্লারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল। তাদের বিচার হতেই হবে। সরাসরি রাজনীতি না করেও সে এসেছিল।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সে যৌক্তিক মনে করেছে। আজ তাকে বলে দেয়া হচ্ছে, সে রাজাকার-সে জামায়াত-সে শিবির। তার মনোজগত ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়েছি, তুই রাজাকার সেøাগান দিয়েছি, আর আজ আমাকেও রাজাকার বলা হচ্ছে! আমার বাবা-মাকে টেনে আনা হচ্ছে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে!! বিক্ষুব্ধতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেই হয়তো সে বলছে ‘হ্যাঁ আমি রাজাকার’। পড়ছে ‘আমি রাজাকার’ লেখা টিশার্ট।

আপনি তার বোধ-বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। বলতে পারেন, তাই বলে ‘আমি রাজাকার’ বলবে! হ্যাঁ, বিস্মিত-ক্ষুব্ধ আপনিও হতে পারেন। একই সঙ্গে আপনাকে এটাও বিবেচনায় নিতে হবে, তার বা তাদের মতো নিরীহ ন্যায্য আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলে মানসিকভাবে তাদের কতটা আঘাত করা হয়েছে! কতটা বিপর্যস্ত হয়েছে তাদের মন-হৃদয়?

যে কাউকে অকারণে রাজাকার বলার মানসিকতা পরিত্যাগ করা জরুরি। যুক্তিকে যুক্তি দিয়ে খ-ন করতে না পারলে, কু-যুক্তি দিয়ে খ-ন করা যাবে না। কু-যুক্তি দিয়ে খ-ন করতে না পেরে ‘রাজাকার’ বলাটা মানসিক রোগের পর্যায়ে চলে গেছে। ‘আমি রাজাকার’ কেন বলল, তা নিয়ে সমালোচনা করেন। ‘রাজাকার’ বলে ন্যায্য দাবি দমনকারীদের সমালোচনা তার আগে করেন।

তার চেয়ে বড় কথা, প্রজন্মের মনস্তত্ত্ব জানা-বোঝার চেষ্টা করেন। সবাইকে এভাবে উল্টো দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করবেন না।

৫.
যে কাউকে ‘রাজাকার’ বা ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলার আগে, বাস্তব বিবেচনাবোধকে কাজে লাগানো দরকার। বিএনপি যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করে। আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নেতাদের দলে টেনে পদ-পদবি দেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে তরুণদের আপনি ‘রাজাকার’ বলছেন, তার এই তথ্য অজানা নয়।

রাজাকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার নেতার সন্তান বিয়ে করছেন চিহ্নিত রাজাকারের সন্তানকে। এই তথ্যও অজানা নয়।
যিনি বিএনপিকে ‘জঙ্গি বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল’ বলেন, তারাও বিএনপি নেতার সন্তানের সঙ্গে নিজের সন্তানের বিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রজন্মের সন্তানেরা তার বাবার বা পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় হিসেবে নিয়ে প্রেম-বিয়ে করছেন না। বিয়ে-প্রেম করার সময় মুসলমান-খ্রিস্টান-হিন্দু-ইহুদি পরিচয় তাদের বিবেচনায় থাকছে না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী যেসব তরুণকে ‘রাজাকার’ বা ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলছেন- তারা এসব তথ্য জানে। কেন তাদের ‘রাজাকার’ বলছেন তারা তা বুঝতে পারছে। আপনাদের কৌশল বুঝে ক্ষুব্ধ হয়ে বলছে ‘আমি রাজাকার’। এর থেকে ফেরাতে হলে, তাদের মনস্তত্ত্বকে সম্মান-শ্রদ্ধা করতে হবে। ন্যায্যতার প্রতি সম্মান করতে হবে। দমন করা যাবে না।

গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail. com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!