নানরুটি-পরোটায় অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ইউরিয়া

অনলাইন ডেক্স । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

সকালের নাস্তায় কিংবা হালকা ক্ষুধায় রুটি কিংবা পরোটা অনেকেরই পছন্দ। দামে কম এবং সহজলভ্য হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষই অনায়াসে ঘরের কাছের দোকান থেকে নানরুটি কিংবা পরোটা দিয়ে সকাল-বিকালের নাস্তার পর্ব সেরে ফেলেন। কিন্তু এই রুটি-পরোটা এতো নরম কেন? কারণ, এতে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত অজৈব সারের এক ধরনের মিশ্রণ। হোটেল-রেস্তোরাঁয় কর্মীর ভাষায় এর নাম ‘সাল্টু’। এটি পাওয়া যায় মশলার দোকানে। অ্যামোনিয়াম সালফেট এবং ইউরিয়া সার একসঙ্গে মিশিয়ে গুঁড়ো করে এই সাল্টু বানানো হচ্ছে। সরকারি সংস্থা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এই রাসায়নিকের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে।

লবণের মতো দেখতে দানাদার এই রাসায়নিক পদার্থ নানরুটি, পরোটা, বনরুটি তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে অহরহ। সাল্টু নামক এই সার রুটি-পরোটা তৈরির আগে আটার খামিতে মিশিয়ে রাখা হয়। তারপর ভাজা হয় রুটি কিংবা পরোটা। এতে পরোটার ওপরের অংশ মচমচে হলেও ভেতরটা হয় নরম। একই উপায়ে বানানো হয় নানরুটি। রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।

বিষয়টি একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে নজরে নিয়ে আসেন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট আকরামুল হক। ফেসবুকে তিনি ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করে লেখেন, ‘নির্বাচনি কাজে কুড়িগ্রাম গিয়েছিলাম। ফেরার পথে রাজীবপুর উপজেলার বালিয়ামারী বাজারে ভোরে নাস্তা করতে গিয়ে দেখতে পাই হোটেলের পরোটা অনেক নরম। এতো নরম কেন? জিজ্ঞেস করায় হোটেলের কর্মচারীর উত্তর, “পরোটায় সাল্টু আছে।” সাল্টু কী? জিজ্ঞেস করায়, সামনে ভান্ড আনতেই দেখি তার ভেতর রয়েছে অ্যামোনিয়া সারের গুঁড়ো। ভান্ডের মুখ খুলে সামনে ধরে শ্বাস নিতে গিয়ে দেখি দম বন্ধ হয়ে আসছে। বালিয়ামারী বাজারে তিনটি হোটেলেই সাল্টু নামের অ্যামোনিয়া সারের ব্যবহার দেখেছি। কুড়িগ্রাম থেকে জামালপুর পর্যন্ত আসতে নানা হোটেলে চা পানের জন্য নেমেছি। সবখানেই সাল্টুর ব্যবহার সম্পর্কে হোটেল মালিকরা অবগত। কেউ স্বীকার করছেন, কেউ করছেন না।’

এ বিষয়ে আরও জানতে চাইলে আকরামুল হক বলেন, ‘কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে এই জিনিস দেখে, ঢাকায় ফিরে নানান হোটেলে নরম পরোটা ও তন্দুর রুটির খোঁজে নেমে দেখি কেউ সাল্টুর বিষয়টি স্বীকার করছে না। মোহাম্মদপুরে দুটি হোটেলের দুই কর্মচারী আভাসে-ইঙ্গিতে বিষয়টি স্বীকার করলেন। তাদের ভাষ্য, ‘রুটি বা পরোটা নরম চায় কাস্টমাররা, তাই অ্যামোনিয়া সারের এই সাল্টু নামের মিশ্রণের ব্যবহার চলছে। পুরনো ঢাকায়ও একই কারবার, কেউ স্বীকার করছে না। টেবিলবয়দের পটিয়ে টিপস দিয়ে জানা গেল, সাল্টুই ব্যবহার হচ্ছে পরোটা ও তন্দুরি নান নরম করতে।’

বিষয়টি জানার পর ঢাকার বিভিন্ন হোটেল ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। কয়েকটি রেস্তোরাঁর কর্মচারী মুখ খুললেও অনেকেই এ বিষয়ে কথা বলতে চায়নি। রাজধানীর রায়ের বাজার, হাজারীবাগ, লালবাগসহ রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি হোটেলের কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা মিলেছে।

লবণের মতো দেখতে দানাদার এই রাসায়নিক পদার্থ নানরুটি, পরোটা, বনরুটি তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে অহরহপুরনো ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের একটি হোটেলের রুটির কারিগর জানান, সাল্টু না দিলে কাস্টমার রুটি শক্ত কেন জানতে চায়। তারা মনে করে বাসি রুটি গরম করে দেওয়া হয়েছে। সাল্টু ব্যবহার করলে রুটি বেশি ফোলে এবং ভেতরটা নরম হয়।

রাজধানী ঘুরে আরও জানা যায়, রাস্তার পাশের খাবার হোটেলগুলোতে চিকেন বন বিক্রি করা হয়। আটার খামির ভেতর সামান্য মশলা ঢুকিয়ে দিয়ে তেলে ভেজে সাজিয়ে রাখা হয়। এই বনরুটি তৈরির খামিতেও ব্যবহার করা হয় সাল্টু। যার কারণে চিকেন বনের ভেতরটা খুব নরম হয়।

সাল্টুর বদলে ‘ব্রেড ইমপ্রুভার’ কেন ব্যবহার করা হয় না? জানতে চাইলে রায়েরবাজার এলাকার এক রেস্তোরাঁর ম্যানেজার জানান, বিদেশি জিনিসের দাম বেশি। এটি সস্তায় পাওয়া যায়, তাই সবাই এটিই ব্যবহার করে। এটা তো আজ থেকে না, অনেক দিন ধরেই সবাই ব্যবহার করে।

তবে সাল্টু নামক এই সার কোত্থেকে সংগ্রহ করা হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। তবে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারি বাজারের মশলার দোকানে খোলা পাওয়া যায়। আবার অনেক বেকারিতে স্টক করেও অ্যামোনিয়া রাখা হয়। শুধু রুটিজাতীয় খাবার নয়, বেকারির সামগ্রী, যেমন– বিস্কুটেও অ্যামোনিয়ার ব্যবহার করার সত্যতা পাওয়া গেছে।

২০১৬ সালে অ্যামোনিয়ার সবচেয়ে বড় স্টক ধরা পড়ে চট্টগ্রামের বনফুল অ্যান্ড কোম্পানির কারখানায়। তাদের তৈরি বিস্কুটে মানবস্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি পেয়েছিলেন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র‌্যাব) পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় প্রতিষ্ঠানটিকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সেই সঙ্গে বনফুলের কারখানা থেকে ৮৩ বস্তা অ্যামোনিয়া জব্দ করা হয়। প্রতি বস্তায় ২৫ কেজি অ্যামোনিয়া ছিল। পরে সেগুলোকে ধ্বংস করা হয়। এরপরও পুরান ঢাকার শহীদনগরে অনেক বেকারিতে অভিযান চালিয়ে তাদের পণ্যে অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম।

সারওয়ার আলম বলেন, ‘বেকারিতে এই অ্যামোনিয়ার ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। আমরা পুরনো ঢাকার শহীদনগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে কয়েকশ’ বস্তা বিস্কুট ধ্বংস করেছি।’

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সালে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণয়ন করে। নিরাপদ খাদ্য আইনের ৩০ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে– ‘কোনও ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনও ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, প্রবিধান দ্বারা বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনও আইনের অধীন নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত পরিমাণ কীটনাশক বা বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ পশু বা মৎস্য-রোগের ঔষধের অবশিষ্টাংশ, হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক বা বৃদ্ধি প্রবর্ধকের অবশিষ্টাংশ, দ্রাবকের অবশিষ্টাংশ, ওষুধপত্রের সক্রিয় পদার্থ, অণুজীব বা পরজীবী কোনও খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্ত করিতে পারিবেন না বা উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোনও খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ মজুদ, বিপণন বা বিক্রয় করিতে পারিবেন না।’

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবিরের কাছে রুটিতে সারের প্রয়োগ সম্পর্কে অবগত আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতটুকু শুনলাম, সাল্টু হচ্ছে অ্যামোনিয়াম সালফেট সার। অসম্ভব এসিডিক এই সার। যতটুকু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম, মনে হচ্ছে অ্যামোনিয়াম সালফেট এবং ইউরিয়া সার একসঙ্গে মিশিয়ে গুঁড়ো করে সাল্টু বানানো হচ্ছে। তার মানে আমরা সাল্টু নামে খাদ্যের সঙ্গে দুটি রাসায়নিক সার খাচ্ছি। অনেকদিন আগে সোডিয়াম সাইক্লামেট বা অবৈধ ঘন চিনি ধরতে গিয়ে বের করেছিলাম ঘন চিনির সঙ্গে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সার মিশিয়ে পুরান ঢাকা, ইসলামপুর, মৌলভী বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ফার্মগেট মৃত্তিকা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ল্যাব পরীক্ষা করে দেখেছিলাম ঘন চিনির সঙ্গে ম্যাগনেসিয়াম সার মেশানোর কাহিনী।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা আমাদের দৃষ্টিতে আছে। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। এগুলো অবৈধভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা এর বিরুদ্ধেও অভিযানে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শিগগিরই প্রত্যেককে ধরা হবে। খাবারের বিষয়ে কোনও আপস নেই। ইতোমধ্যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, পরীক্ষা করা হবে।’

পুষ্টিবিদরা বলছেন এ ধরনের রাসায়নিক সার মিশ্রিত খাবার খেয়ে প্রাথমিকভাবে পেট খারাপ হতে পারে এবং ভবিষ্যতে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ড. সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিফ কনসালটেন্ট ডায়েটিশান সুকৃতি সামিরা লেন, ‘এই ধরনের রাসায়নিক মিশ্রিত খাবার খেয়ে প্রাথমিকভাবে ডায়রিয়া হতে পারে, বমি হতে পারে কিংবা ফুড পয়জনিং। এছাড়া ক্যানসার ও চর্মরোগ হতে পারে। অনেক সময় এই খাবারগুলো লিভারকে অকার্যকর করে দেয়। আজকাল ক্যানসারটা খুব বেশি হচ্ছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষই এই ঝুঁকিতে আছে।’

তথ্যসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!