নারী নির্যাতন কি তবে বৈধতা পাবে?

 

 

সিডনীর কথামালা-৫২

রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
E-mail:raneshmaitra@gmail.com

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা নারী-পুরুষের বিবাহযোগ্য ন্যূনতম বয়স যথাক্রমে ১৮ এবং ২১ নির্ধারণ করে প্রণীত আইনের একটি খসড়া অনুমোদন দিয়েছেন।

আইনটি যদি এখানেই থামতো তবে দ্বিধাহীন কণ্ঠে তা সার্বজনীন সমর্থন পেতে পারতো। সবার দাবীও ছিল তেমনই। বিশেষ করে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের প্রগতিশীল নেতৃত্বের।

কিন্তু না, খসড়া আইনটি ঐ খানেই থেমে থাকে নি। “কিন্তু”‘ আর “যদি” লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যদি তা সত্বেও কোন মেয়ে বা ছেলে নির্ধারিত বয়:সীমার কম বয়সে বিয়ে করে সেক্ষেত্রে সামাজিক বিশেষ অবস্থাকে বিবেচনায় রেখে আদালত ও অভিভাবকদের সম্মতি থাকলে ঐ বিয়ে বৈধ বলে বিবেচিত হবে। না হলে সে ক্ষেত্রে ঐ বিয়ে অবৈধ বিবেচনা করে নামকাওয়াস্তে সামান্য কিছু শান্তির বিধান রাখা হয়েছে।

এই খসড়াটি মন্ত্রীসভায় অনুমোদনের পরবর্তী ধাপ হলো খসড়াটিকে জাতীয় সংসদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে উত্থাপন করা হবে। সংসদ তাতে অধিকাংশ ভোট সমর্থন দিলে তা আইন হিসেবে পরিগণিত হবে। অবশ্য তার আগে তাতে রাষ্ট্রপ্রতির স্বাক্ষরের প্রয়োজন হবে। রাষ্ট্রপতি সংসদের পাশ করা আইনে স্বাক্ষর দিলেই তার গেজেট প্রকাশ এবং সেই সাথেই আইন প্রণয়ন ও পাশের প্রক্রিয়ার সমাপ্তি তা চূড়ান্ত হয়ে যায়।

যেহেতু আমাদের দেশের পার্লামেন্টে কোন বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই বা সংসদ-সদস্যদের নিজস্ব অভিমত অনুযায়ী ভোটদানের অধিকারেও স্বীকৃতি নেই। তাই মন্ত্রীসভা যা পাশ করে দেয় সংসদে তা হুবহু পাশ হয়ে যায়। এ যাবত ভোটে কোন আইনের খসড়া সংসদে পাশ হয়ে নি বা এমন কি, সংসদে কোন আইনের খসড়া ভোটাভূটির কবলে পড়েছে-এমন কোন নজিরও নেই। মন্ত্রীসভা যে খসড়া অনুমোদন করে দেন কণ্ঠভোটে তা সংসদে পাশ হয়ে থাকে।

আর রাষ্ট্রপতি? বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপ্রতির পদটি একটি decorative post মাত্র। তাঁর মর্য্যাদা আছে কিন্তু মন্ত্রীসভার বা সংসদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবার ক্ষমতার স্বীকৃতি নেই। তাই সংসদে পাশ হলেই তা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় এবং রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকেন। এর কোন ব্যতিক্রম কদাপি চোখে পড়ে নি। রাষ্ট্রপতির নিজস্ব মতে তিনি যে তা সংসদে পুন:র্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাবেন তারও কান নজির নেই।

এ কারণেই দেশব্যাপী নারী-বান্ধব মানুষদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। প্রত্যাশা এই যে, সংসদ অধিবেশনে পেশ করার আগেই এই আইনটির “কিন্তু”“যদি” “বিশেষ কারণ” প্রভৃতি বলে যে ভাবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ের সুযোগ বর্ণিত আইনের খসড়াটিতে রাখা হয়েছে-সেগুলি অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিয়ে ন্যূতম ১৮ বছর না হলে মেয়েরা এবং ন্যূতম ২১ বছর না হলে ছেলেরা বিয়ে করতে পারবে না মর্মে আইনে স্পষ্টভাবে লিখিত হউক।

কিন্তু যদি তেমন উদ্যোগ কোন মেয়ে ছেলে, প্রতিবেশী, ময়-মুরুব্বী বা অভিভাবক কেউ গ্রহণ করেন নাবালক আবস্থায বিয়ে করেন, বিয়ে দেন বা বিয়েতে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে উৎসাহিত করেন তবে তার ন্যূনতম ১০ বছরের জেল, তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। আইনটিতে এমন বিধান দেশের নারী পরিস্থিতির দিকে তাকালে আজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বলে সবাই মনে করেন।

‘সামাজিক বাস্তবতার বিবেচনায়’ বলে যে কথা বলতে চেয়েছেন নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী-তা আরও উদ্বেগজনক এই কারণে যে প্রকৃতই তা হলে ঐ বাস্তবতা কি, সরকার তা সম্যক উপলব্ধি করতে সম্ভবত: ব্যর্থ হয়েছেন।

একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে অজ¯্র নারী বান্ধব, নারী নির্য্যাতন বিরোধী কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু তার দ্বারাই আমরা কি দাবী করতে পারব যে বাংলাদেশ নারী-নির্য্যাতন মুক্ত? অথবা বলতে পারব যে ঐ কঠোর আইনগুলির যথাযথ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে? এমন দাবী করার কোন অবকাশই নেই বাংলাদেশ।

বরং প্রকৃত বাস্তবতা হলো এই যে আন্তর্জাতিক ভাবে নারী নির্যাতনের সূচকে দক্ষিণ এশিয় দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশ যথেষ্ট এগিয়ে এবং এর মধ্যে বাল্য-বিবাহ জনিত নির্য্যাতনই প্রধান। বেসরকারী সংস্থার তথ্যমতে ৭৬% কিশোরীই যৌন হেনস্থার শিকার। কী ভয়ংকর।

তাই দেখা যায় যে এমন কি, চার থেকে ছয় বছর বয়সী নারী শিশুও যথেষ্ট সংখ্যায় ধর্ষিত হচ্ছে কিন্তু এই ভয়াবহ পাশবিকতারও উপযুক্ত বিচার হচ্ছে না। অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রেই সরকারী দলের কোলে আশ্রিত, লালিত-পালিত হওয়ার ফলেও পুলিশ তাদেরকে বিচারামলে আনতে ভয় পেয়ে থাকে।

তাই একদিকে যেমন নারী নির্যাতন রিরোধী কঠোর আইনগুলি যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি আবার নারী নির্যাতন যাতে না ঘটে বা তা যাতে যথেষ্ট পরিমাণে কমে আসে তার জন্য প্রতিষেধকও খুঁজতে হবে।

চোখের সামনে যদি দেখি, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গ্রামীন অশিক্ষিত সমাজের শিশু-কন্যা থেকে সুরু করে শহুরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত যুবতীরা ও তাদের সহপাঠি এবং কখনও কখনও তাদের শিক্ষকদের দ্বারা, শিশু-কন্যারা যখন মাদ্রাসা ও স্কুল শিক্ষদের দ্বারা, নার্স-মেয়েরা যখন ডাক্তার কিংবা ক্লিনিকের মালিক দ্বারা, রোগিনী যখন পুরুষ নার্স বা ডাক্তার দ্বারা, নারী-কনস্টেবল যখন ঊর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা, ব্যাংকে কর্মরত মহিলা কর্মচারী কর্মকর্তারা যখন তাদের সহকমীদের দ্বারা , সরকারী-বেসরকারি অফিসগুলিতে যখন কর্মরত নারীরা তাদের ঊর্ধতন সহকমীদের দ্বারা প্রায় প্রাই ধর্ষিত – অত্যাচারিত হচ্ছেন তখনও কি আমরা একে এক মহামারী রোগ বলে ধরে নেবো না? তা দূর করতে সকল শক্তি নিয়োগ করবো না?

এমনিতেই নারীরা আমাদের দেশে এমন কি নিজ বাড়ীতেও মা-বাবার সাথে থাকাকালে এবং পরবতীর্তে পাঠ্যজীবনে এবং, অত:পর বিবাহিত জীবনেও, মা-বাবা দ্বারা, শিক্ষকদের কারও কারও দ্বারা এবং সবশেষে স্বামী, স্বশুড়-স্বাশুরড়ী-ননদদের দ্বারা অনেকেই যেভাবে অবহেলিত ও নির্যাতীত হতে থাকে জীবনের শুরু বা জন্মকাল থেকেই, তাতে সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায়, নারী নির্যাতন কমানো যেতে কিন্তু তা আমাদের সমাজদেহ থেকে নির্মূল করা সহজে যাবে না। আমাদের পারিবারিক সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় বিধি-বিধান বহু ক্ষেত্রেই যে নারী জন্য উৎপীড়ক ও বৈষম্য সৃষ্টিকারক তাতে সন্দেহ নেই। আর এই সামগ্রিক ব্যাপারগুলিকে আমলে নিয়ে তার যথাযথ এবং সাহসী সংস্কার, সংবিধান অপরিহার্য হওয়া সত্বেও সমাজপতিরা ও রাষ্ট্রনায়কেরা কেন যে এগিয়ে আসেন না-তাও ভেবে পাওয়া যায় না।

মাননীয় আইনমন্ত্রীকে , যদিও কদাপি তাঁকে একজন আধুনিক মানুষ এবং প্রাজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে জানতাম-জানতাম তাঁকে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন ও আদর্শের একজন নিষ্ঠাবান সমর্থক হিসেবে।

আজ তাঁর সম্পর্কে তেমন ধারণার অনেকটাই তিরোহিত এবং তা আবার তাঁর নিজস্ব কাজকর্ম ও বক্তব্যের কারণেই।

তাই আসলেই ভয় হয় এখন তাঁর মুখ থেকে কোন কথা শুনলে। যেমন ভয় পাই তিনি (জামায়াত নিষিদ্ধ করার হেফাজত বা ধর্ম ভিত্তিক দলকে নয়) ব্যাপারে আদালতে মামলা ঠুকে দেবেন এবং লক্ষ্যে অনেক আগেই আইন প্রণয়ন করে মন্ত্রীসভার অনুমোদনেরর জন্য পেশ করবেন-এমন কথা এক বছরেরও বেশী আগে বললেন- কিন্তু বাস্তবে তেমন কোন পদক্ষেপ আজও দৃশ্যমান নয়। কেন যে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে এবং কেনই বা ধর্মাশ্রয়ী দল গঠন বা তার কার্য্য পরিচালনা সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হবে না। তাও বোধগম্য নয়। বরং অত্যন্ত দুর্বোধ্য। কারণ মামলা ছাড়াই তা বঙ্গবন্ধু এগুলি নিষিদ্ধ করেছিলেন।

এবারে তিনি সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আইন করবেন বলাতে পুনরায় শংকিত বোধ করছি। কারণ সরকারী মন্ত্রী প্রতমিন্ত্রীরা এখনও নাসিরনগর গিয়ে বলছেন “বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নজিরবিহীন দেশ” অথচ দেশ-বিদেশে সভা-সমাবেশ চলছেই নাসিরনগর ও অন্যান্য জেলা উপজেলায় হিন্দু-নির্যাতন এবং গোবিন্দগঞ্জ সহ নানাস্থানে বর্বরোচিত ভাবে আদিবাসী সাঁওতালদের উপর অকথ্য নির্য্যাতন জমি দখল প্রভৃতির বিরুদ্ধে।

তবুও আইনের প্রসঙ্গে যখন স্বয়ং আইনমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন-আগামীতে আমি বিষটির নানাদিক নিয়ে লিখব এমন প্রত্যাশা রেখে আজকের লেখাটি নারীর বয়সের মধ্যেই সীমিত রাখছি।

মা-বাবার কাছে মেয়ে-শিশুর চাইতে পুত্র শিশু যে অনেক বেশী আদরের তা বেশীরভাগ পরিবারেই আজও দশ্যমান। ছেলেদের পোশাক বেশী দামী-ভাল খাবারটা তাদে ঘরের কাজে মেয়ে শিশুদের ব্যবহার, মেয়েদেরকে গৃহবন্দী করে রাখার প্রবণতা এবং তাদের পোশাকের উপর অভিভবক বা শিক্ষকদের অবৈধ নিয়ন্ত্রণ, নিজের রুচি অনুযায়ী পোশাক পরায় নারীর স্বাধীনতা-হীনতা, চার-চারটি বিয়ে করা যাবে-পুরুষের জন্য শুধু এমন অধিকার, বাবা বা স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়ে বা স্ত্রী অধিকারহীনতা বজায় রেখে আবার নানা তুচ্ছ অজুহাতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে-শিশুর বিবাহে বৈধতা দিয়ে সেই মধ্যযুগীয় ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে টিকিয়ে রাখা ও বৈধতা-প্রদান যে কি ভয়াবহ ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে তা কি মন্ত্রীসভা বুঝতে অক্ষম? আইনমন্ত্রী স্বয়ং তা কি উপলব্ধি করতে পারলেন না? পারলেন না মন্ত্রীসভায় অবস্থানকারী অনেক প্রবীন নারীরাও পারলেন না বামপন্থার রাজনীতিতে থেকে জীবন সুরু করে যৌবনের শেষে মন্ত্রীত্বে আসীন হওয়া বাম প্রগতিশীল মন্ত্রীরাও?

এখনও সময় আছে মাননীয় আইনমন্ত্রী ও তাঁর মাধ্যমে মন্ত্রীসভার প্রতি আহ্বান জানাই আইনটি যেভাবে মন্ত্রীসভা অনুমোদন দিয়েছে সেভাবে নয় তাকে সংশোধন করে সরাসরি লিখুন “কোন ক্রমেই ১৮ বছরের কমবয়সী কোন মেয়ের বা ২১ বছরের কম কোন ছেলের বিয়ে দেওয়া, বিয়ে করা, বিয়ে মেনে নেওয়া বা তাতে উৎসাহিত করা-তা যে কোন অজুহাতেই হোক না কেন-কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই আইন অমান্য করলে দশ বছর ন্যূনতম পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও তিন লক্ষ টাকা জরিমানা উভয় শাস্তি প্রদান করা হবে।

এই আইন আজ অপরিহার্য্য আমাদের সমাজে নারীর শিক্ষা-দীক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাইলে। আশা করি, মন্ত্রীসভার সুমতি হবে।

কোনক্রমেই যেন বর্তমানে যে রূপে মন্ত্রীসভা অনুমোদন দিয়েছেন, সেরূপে আইনটিকে সংসদে পেশ বা উত্থাপন না করা হয়।

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!