নায়িকা থেকে মুখ্যমন্ত্রী, রূপকথার একজীবন

 

সেলিনা জাহান প্রিয়া

সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক।

রূপকথার মতোই বর্ণাঢ্য একজীবন কাটিয়ে পরলোক চলে গেলেন তামিলনাড়ুর প্রাণের মানুষ ‘আম্মা’। ভারতের তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতাকে তার লাখ লাখ ভক্ত আম্মা বলেই ডাকতেন। অভিনেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ভারতের এই জননেত্রী ৬৮ বছর বয়সে দুনিয়া ছাড়লেন। জয়ললিতার পরলোকগমনে শোকের কালো চাদরে ঢেকেছে গোটা তামিলনাড়ু।

জয়ললিতা জয়রাম সকলের কাছে পরিচিত জে জয়ললিতা, কুমারী জয়ললিতা, জয়া, পুতরাচি থালাইভিসহ নানা নামে। তবে যে ভালোবাসার নামটিতে তিনি সবচেয়ে খ্যাত তা হল ‘আম্মা’। গোটা দক্ষিণ ভারতেই তিনি আম্মা নামে সকলের কাছে পরিচিত। আর তামিলনাড়ুতে তাঁকে নিয়ে যে ধরনের উন্মাদনা ও উচ্ছ্বাস তা দেশের আর কোনও রাজ্যের নেতা-নেত্রীর রয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

ভারতের রাজনীতিতে অন্যতম কুশলি কিং মেকারের পাশাপাশি জয়ললিতা একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। একসময় এমজি রামচন্দ্রনের নায়িকা হিসাবে একের পর এক সুপারহিট ছবিতে অভিনয় করেছেন। রাজনীতিতে তিনিই জয়ললিতার গুরু। জয়ললিতা দক্ষিণ ভারতের সেই অভিনেত্রীর যিনি ছবিতে প্রথম স্কার্ট পরেছিলেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত জয়ললিতা বেশিরভাগ এমজি রামচন্দ্রনের সঙ্গে ছবি করেছেন। এরপর ১৯৮২ সাল থেকে এমজিআরের হাত ধরেই রাজনীতিতে পা রাখেন আম্মা. হাল ধরেন আন্না দ্রাবিড় মুনিত্রা কাঝাগম -এআইএডিএম দলের। জয়ললিতার দূরদর্শী নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত দলেকে বসায় তামিলনাড়ুর মসনদে। মাঝে ষড়যন্ত্রীদের ওঠানো দূনীর্তির অভিযোগ তাকে ঠেলে দিয়েছিল কারাগারের প্রকোষ্ঠে। সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করেই বিপুল বিক্রমে ২০১১ সালে তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হন জয়ললিতা।

রূপকথার মতোই জীবন কাটিয়ে যাওয়া ‘আম্মা’ জয়ললিতার জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মহীশূরের (বর্তমানে কর্ণাটক) মাণ্ড্য জেলার পাণ্ডবপুরা তালুকে। তাঁর বাবার নাম জয়রাম ও মায়ের নাম বেদবল্লী। বাড়িতে জয়ললিতাকে সবাই জয়া নামেই ডাকতো। জয়ার জন্মের দুই বছর পরই বাবা জয়রাম মারা যান। এরপরই সংসার চালাতে কাজে নামতে হয় জয়ার মা বেদবল্লীকে। বিধবা বেদবল্লী বোন অম্বুজাবল্লীর সঙ্গে চলে আসেন মাদ্রাজে। জয়া থেকে যান মহীশূরে। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি কর্ণাটকেই দাদু-দিদার কাছেই ছিলেন।

জয়া মা বেদবল্লী একসময় শখের নাটকে অভিনয় করতেন।চেন্নাইয়ে সেই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে উপার্জনে জন্য তামিল সিনেমায় ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। পর্দায় তাঁর নাম ছিল সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে তামিল ছবিতে সন্ধ্যার ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অার্থিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়। ১৯৫৮ সালে জয়াকে তিনি চেন্নাইয়ে নিয়ে আসেন। সেখানকার চার্জ পার্ক কনভেন্ট কলেজেই গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন মেধাবী জয়লতিতা। তবে তার অাগেই লাবণ্যময়ী মেয়েটি অভিষেক হয়ে যায় রূপালী পর্দায়।

মায়ের সঙ্গে ছবির শুটিং দেখতে গিয়েই জয়ললিতা চেন্নাইয়ের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের চোখে পড়ে যান। ১৯৬১ সালে মাত্র মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি তামিল ছবি নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। তবে সাফল্য ধরা দেয় ওই সময়ের তামিল সুপারস্টার এমজি রামচন্দ্রনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করে। ১৯৬১ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ১৪০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন জয়ললিতা। তামিল সিনেমার অন্যতম কিংবদন্তি অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। তামিল ছাড়াও তেলুগু কন্নড় সিনেমায় তিনি সমান দক্ষতায় কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি নৃত্যশিল্পী হিসাবেও অসম্ভব দক্ষ ছিলেন। জয়াকে তামিল সিনেমার ‘কুইন’ বলেও ডাকা হত।

১৯৮২ সালে অভিনেতা তথা তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এমজি রামচন্দ্রণের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন জয়ললিতা। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভায় সাংসদ হিসাবে কাজ করেন তিনি। ১৯৮৭ সালে রামচন্দ্রণ প্রয়াত হলে দলে বিভাজন তৈরি হয়। একদল ছিলেন এমজিআরের স্ত্রী জানকি রামচন্দ্রণের দিকে আর একদল ছিলেন জয়ললিতার সঙ্গে। তবে অভিনেত্রী থেকে রাজনীতিক হওয়া ‘আম্মা’র দূরদর্শী নেতৃত্বে আন্না দ্রাবিড় মুনিত্রা কাঝাগম -এআইএডিএম দলের মূলধার হয়ে ওঠেন তিনি। এর দুই বছর পরই ১৯৯১ সালে বিপুল ভোটে জিতে প্রথমবার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন জয়া। তিনিই তামিলনাড়ুর প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী৷ এরপর ধীরে ধীরে রাজ্য তথা ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে মহীরূহ হয়ে ওঠেন।।

তবে এরই মধ্যে ষড়যন্ত্রীরা তার পিছু ছাড়েনি। হিসাববহির্ভূত সম্পত্তির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে চার বছর কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। জয়ললিতার ঠাই হয় কারাগারে। পরে উচ্চ আদালতে আপিল করে তিনি মুক্তি পান। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন৷ ২০১১ সালে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন। শেষবার বিধানসভা ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হন ২০১৬ সালের মে মাসে।

সোমবার (৫ ডিসেম্বর) সোমবার সন্ধ্যা থেকেই চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জয়ললিতার মৃত্যুর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে হাসপাতালের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করে বলা হয়, তিনি লাইফসাপোর্টে আছেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতাল কতৃপক্ষ আম্মা মারা গেছেন বলে ঘোষণা দেয়। জয়ললিতার মৃত্যুতে সমর্থকেরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ভারতের শীর্ষ রাজনীতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জয়ললিতার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন। ‘আম্মার’ মৃত্যুতে রাজ্যে সাত দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে মঙ্গলবার রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন।

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!