পঞ্চগড়ে ঐতিহ্যবাহী ডাহুক তার জৌলুস হারিয়ে মরা খালে পরিণত

নাজমুস সাকিব মুন, পঞ্চগড় প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

পঞ্চগড়, বাংলাদেশের মানচিত্রে যার অবস্থান সর্ব উত্তরে। পাথরের খনি হিসাবে রয়েছে দেশ জুড়ে যার খ্যাতি। পাথর সহজলভ্য তাই স্বভাবতই পঞ্চগড় জুড়ে রয়েছে নদীর প্রবাহ। এ জেলার বুকে ছোট বড় অনেক নদী বয়ে গেছে তার মধ্যে  করতোয়া, মহানন্দা, ডাহুক, ভেরসা, চাওয়াই, সাও অন্যতম। পঞ্চগড়ে ৫টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাথর পাওয়া যায় তেঁতুলিয়া উপজেলায়। এই এলাকার বেশীর ভাগ মানুষ পাথরের উপর নির্ভরশীল। হাজার হাজার শ্রমিকের রুজি রুটির আশ্রয়স্থল হচ্ছে এই পাথর।

পঞ্চগড়ের যে কয়েকটি নদীতে পাথর পাওয়া যায় তারমধ্যে অন্যতম তেঁতুলিয়ার ডাহুক নদী। কিন্তু এ নদীতে সরকারী নিয়মনীতি অমান্য করে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে পঞ্চগড়ের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী প্রবাহিত ডাহুক নদী।

গভীরতম এ নদীটি আজ তার জৌলুস হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। ফলে পঞ্চগড় জেলার সীমারেখা বরাবর বয়ে চলা এ নদীটি এখন শুধু নাব্যতা সংকটেই নয়, পড়েছে চরম অস্তিত্ব সংকটে।

সরেজমিনে দেখা যায় হাইকোর্টের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারী নিয়মনীতি না মেনে অপরিকল্পিত ভাবে প্রকৃতি বিধ্বংসী অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে এ নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর গতিপথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ডাহুক নদী।

স্থানীয়রা জানান, ‘সরকারী বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, প্রশাসন ও স্থানীয় বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি সহ রাজনৈতিক বিভিন্ন নেতাকে ও কতিপয় সাংবাদিককে ম্যানেজ করে রাতের আঁধারে উপজেলাধীন শালবাহান ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, গুচ্ছ গ্রাম, লোহাকাচী, বালাবাড়ি, কালিতলা সহ কয়েক কিঃ মিঃ জুড়ে ও বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের বালাবাড়ি, কাটাপাড়া, সরকারপাড়া ও হারাদিঘী এলাকায় ডাহুক নদীতে কয়েকশ প্রকৃতি বিধব্বংসী অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করছে কিছু অসাধু পাথর ব্যাবসায়ী। ফলে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক ভাবে এ জেলার ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এলাকা মানুষ মেশিনের বিকট শব্দে ঘুমাতে পারে না।

সরেজমিনে দেখা যায় শালবাহান ইউনিয়নের রওশনপুর, কালিতলা ও বালাবাড়ি এলাকায় দিনের বেলায় প্রকাশ্যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনুমতিহীন স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে ডাহুক নদীর গতিপথ বন্ধ করে কিছু অসাধু ব্যাবসায়ী পাথর উত্তোলন করছে। ফলে ডাহুক নদীর গতিপথ নেই বললেই চলে । নদী দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা একসময় খরস্রোত নদী ছিল।

পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও নদীর গতিপথ নিশ্চিত করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন কাজ করে আসছে। তারা অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ ও নদীর গতি পথ নিশ্চিত করার দাবিতে মানববন্ধন, সচেতনমূলক মাইকিং, পোস্টার ও লিফলেট বিতরন, পথ নাটক সহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছে। কিন্তু বিভিন্ন নাটকীয়তায় এই মেশিন গুলো বন্ধ হলেও কিছুদিন পর আবারো চালু হয় বলে জানা যায়।

স্থানীয় সামাজিক সংগঠন জাগ্রত তেঁতুলিয়ার সদস্য রাব্বী ইমন জানান, ‘আমরা নদীর গতি পথ নিশ্চিত করার দাবিতে ও ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর তোলা বন্ধ করার জন্য অনেক কর্মসূচী পালন করছি কিন্তু কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবারো চালু হয় এই ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন ‘।

এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জানান, ‘আমরা ডাহুক নদীর সীমানা খুজে পাচ্ছি না ফলে আমরা অভিযান চালাতে পারছি না, পানি উন্নয়ন বোর্ড যদি নদীর নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারন করে তাহলে পরবর্তীতে নদীর গতিপথ বন্ধ করে কেউ পাথর উত্তোলন করলে আমরা ব্যবস্থা নিবো।

এদিকে পঞ্চগড় জেলা নদী সংরক্ষণ কমিটির সদস্য সচিব ও পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান জানান, ‘ পঞ্চগড়ের নদীর সীমানা চিহ্নিত করে দখলমুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে কিন্তু প্রয়োজনীয় মৌজা ম্যাপ ও জনবল সংকটের কারণে নদীর সীমানা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করতে দেরি হচ্ছে’।

উল্লেখ্য, গত বছরের জানুয়ারির দিকে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ডাহুকের করুণ অবস্থা প্রকাশিত হওয়ায় ও ভ্রাম্যমাণ আদালত সে সময় হার্ড লাইনে থাকায় স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীরা গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি এক্সেভেটর দিয়ে ডাহুক খনন শুরু করেন। এতে এলাকাবাসীর মনে আশার সঞ্চার হলেও বছর গড়াতেই সে আশায় পানি ঢেলেছেন স্থানীয় পাথর খেকো ব্যবসায়ীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!