পবিত্র ঈদুল ফিতরের মাহাত্ম্য

পবিত্র ঈদুল ফিতরের মাহাত্ম্য
— শাহীন চৌধুরী ডলি

রোজা একটি পূণ্যময় মাস। রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের পবিত্র এই মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষের মনের অভ্যন্তরের যাবতীয় লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, কাম-ক্রোধ, বিভেদের সব কালো ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। মুসলমানদের মন নির্মল আনন্দে ভরে ওঠে। সিয়ামের ত্রিশ দিন মুসলমানগণ সুবহ সাদিকের পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজের জীবন চেতনায় পরিশীলিত অনুভূতি নিয়ে আসে।

এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে পশ্চিমাকাশে এক ফালি চাঁদ উদিত হতেই সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উৎসব শুরু হয়ে যায়। এই রাতকে চাঁদরাত বলা হয়। আরবী চান্দ্রবৎসরের নবম মাস রমজান এবং দশম মাস শাওয়াল। শাওয়ালের চাঁদরাত হলো ঈদের রাত। ইসলামে যে রাতগুলো ইবাদতের জন্য এবং ফযিলতে পরিপূর্ণ – সেসবের মধ্যে ঈদুল ফিতরের রাত অত্যন্ত মহিমান্বিত এবং গুরুত্বপূর্ণ।

চাঁদরাতের প্রথম আমল চাঁদ দেখা যা একটি সুন্নত আমল। চাঁদ দেখা নিশ্চিত হলে নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করতে হয়, ” আল্লাহুমা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমান, ওয়াছ ছালামাতি ওয়াল ইসলাম ; রাব্বি ওয়া রব্বুকাল্লাহ। হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র ” অর্থ- “হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ঈমান, প্রশান্তি ও ইসলাম সহযোগে আনয়ন করুন; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এই মাস, সুপথ ও কল্যাণের।” (তিরমিজি -৩৪৫১, মুসনাদে আহমাদ-১৪০০, রিয়াদুস সালেহিন – ১২৩৬)।
চাঁদ দেখার পর ঈদের খুশিতে প্রতিটি মুসলিমের মনে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায়। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে শির নিঁচু করে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে।

রমজান শেষে ঈদুল ফিতরের রাত অত্যন্ত মহিমান্বিত। রাত জেগে নফল ইবাদত করা, নামায পড়া, কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করা, দরুদপাঠ করা, জিকির আজকার ইত্যাদি ইবাদতে মশগুল থাকা ঈদের রাতের ইবাদত।

ঈদুল আরবি শব্দ। এর অর্থ প্রত্যাবর্তন বা উপবাস ব্রত পালনের উৎসব। মুসলিমরা এই দিনে অসহায় দুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে যাকাত ফেতরা দান করে থাকে। ঈদ ধনী গরিবের বিভেদ ভুলিয়ে দেয়ার একটি দিন।

কবি নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান,”ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।” যেন বাঙালি মুসলিমদের ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় অংশ। এই গানের মর্মবাণী আমাদের বুঝিয়ে দেয় ঈদের দিনে ধনী – গরিব, বাদশা-ফকির, মালিক- শ্রমিকের মধ্যে আনন্দ উদযাপনের কোন পার্থক্য থাকে না। ঈদ সকল মুসলিমের জন্য আনন্দের বারতা নিয়ে আসে। ঈদে ত্যাগের মহিমায় নিজেকে উদ্ভাসিত করার দিন।

ঈদুল ফিতর রোযা ভাঙার দিবস। এই দিবসে আল্লাহু আকবর, আল্লাহ আকবর -লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহ আকবর, আল্লাহ আকবর -ওয়া লিল্লাহিল হামদ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় মুসলিম জাহানের আকাশ বাতাস। রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি দুই ঈদের দুই রাত নেকির আশা করে সালাতে দাঁড়াবে তার হৃদয় সেদিন মরবে না, যেদিন অনেক মানুষ মনমরা হয়ে থাকবে “( ইবনে মাজাহ, তালখীসুল হাবীব পৃঃ১৪৩)।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম দ্বিতীয় হিজরিতে ঈদুল ফিতরের নামায আদায় করেন এবং ইহজীবন ত্যাগ করা পর্যন্ত তিনি ঈদের নামায দুই রাকাত করে আদায় করেছেন ( তালখীসুল হাবীব, পৃঃ১৪২)।
রাসুলুল্লাহ সাঃ দুই ঈদের দিনে গোসল করতেন এবং সুন্দর কাপড় পরিধান করতেন। (ইবনে মাজা, পৃঃ ৯৪) প্রত্যেক ঈদে তিনি খুশবু লাগাতেন (হাকিম, ফতহুল আল্লাম ১ম খণ্ড, পৃঃ২২১)। নবীজি ঈদুল ফিতরে বেজোড় খেজুর খেয়ে ঈদুল ফিতরের নামাযের জন্য ঘর হতে বের হতেন (বুখারী, পৃঃ১৩০)।

ঈদের নামায মাঠে পড়া উত্তম এবং সুন্নত। যদি কোন বিশেষ কারণে খোলা মাঠে ঈদের নামায পড়া সম্ভব না হয় তখন মসজিদে নামায আদায় করা উচিৎ। অনেক আলিমের মতে, ঈদের নামায সুন্নতে মুয়াক্কাদা। কিন্তু বিভিন্ন হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈদের নামায ওয়াজিব। কারণ নবী করিম (সাঃ) তার পরের খোলাফায়ে রাশেদিনে ঈদের নামায পড়ার জন্য নারীদেরও বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। উনার এই নির্দেশে প্রতীয়মান হয় যে, ঈদের নামায ওয়াজিব (সুবুলুস সালাম, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৭৩)। ঈদের নামাযের সময় হলো সূর্যোদয়ের পর থেকে মধ্য দিবসের আগ পর্যন্ত। ঈদের নামাযের আগে বা পরে কোন নফল নামায পড়তে হয় না। ঈদের নামাযের জন্য আযান বা ইকামত দিতে হয় না। সাধারণত দিনের প্রথম প্রহরেই ঈদের নামায আদায় করা হয়।

ঈদ সমাজের ধনী-গবিরের ব্যবধান ভুলিয়ে দেয়ার একটি দিন, এই দিনে সবাই সমান। ঈদগাহে, মসজিদে, খোলা ময়দানে বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলিম ঈদের নামাযে মিলিত হয়ে একই কাতারে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে কোলাকুলি করে। আলিঙ্গনে বিরাজ করে সাম্যের জয়ধ্বনি। আল্লাহ ঈদের নামায আদায়কারী নেক বান্দাদের উদ্দেশ্যে ক্ষমা ঘোষণা করেন। তাদের কৃত অতীত পাপকে পূণ্যে পরিণত করেন। মুসলমানরা পূণ্যস্নাত ঈদের মধ্য দিয়ে নির্মলতার সীমানায় উত্তীর্ণ হন। ঈদ উৎসবে কে কত দামী জামা পরিধান করলো, কে কত উত্তম পানাহার করলো তা বিচার্য নয় বরং এটা বিচার্য যে মানুষ তার নিজের আত্মাকে কতটা নিষ্পাপ রাখতে পেরেছে। ঈদুল ফিতর হলো এক মাস ব্যাপী পূর্ণ সিয়ামের দাবি পূর্ণ করে নতুন অবস্থায় উপনীত হওয়ার খুশি। মহানবী (সাঃ) অত্যন্ত আনন্দের সাথে ঘোষণা করেছেন, “কুলি কাওমিন ঈদ, হাযা ঈদুনা” এর অর্থ হলো- প্রত্যেক জাতির নিজস্ব আনন্দ উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ উৎসব হচ্ছে ঈদ। (বুখারী ও মুসলিম)

হাদীস শরীফে আছে, নবীজি (সাঃ)বলেছেন – “তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো, চাঁদ দেখে রোজা ছাড়ো, ইফতার করো বা ঈদ করো।”

প্রতি বছর সার্বজনীন ঐক্য, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর। হিংসা, বিদ্বেষ, অনৈক্য, বিভাজন ও হানাহানি ভুলে মানুষ পরষ্পর জড়াজড়ি, করমর্দন ও কোলাকুলি করে। মানবিক সাম্য ও সম্প্রীতিকে উজ্জীবিত করে। ঈদকে ঘিরে মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ-বিদ্বেষ ঘুচে যায়। ধনী- গরিবের মাঝে বিদ্যমান বৈষম্য-দূরত্ব উবে গিয়ে সার্বজনীন প্রেম-ভালোবাসার সৌধ নির্মিত হয়। সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে বের হয়। সমাজের দরিদ্র লোকজনও ঈদের দিন আনন্দ আয়োজনে মিলিত হয়। তারা সেদিন পেটপুরে খেতে পায়, ধনীদের কাছ থেকে পাওয়া যাকাত ফেতরার টাকায় নতুন পোশাক এবং ভালো খাবারের আয়োজন করে। সমাজের সামর্থ্যবান ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের মাঝে নতুন পোশাক বিতরণ করে। দীর্ঘ সিয়াম সাধনার শেষে ঈদুল ফিতর পরিশুদ্ধ আত্মাকে সিরাতুল মুস্তাকিমে অবিচল রাখতে প্রেরণা যোগায় এবং দীর্ঘ তাকওয়ার প্রশিক্ষণকে বাস্তব রূপ দিতে শুরু করে।

কিন্তু বর্তমান অস্থির সময়ে ঈদের প্রকৃত চেতনা ও শিক্ষা থেকে আমরা বহুযোজন দূরে সরে যাচ্ছি। আজকালকার সময়ে ঈদ যেন কেবল আচার আচরণে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। ঈদের মূল শিক্ষা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়ে ভোগবাদী অপসংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকে ভোগসমৃদ্ধ জীবন বেছে নিচ্ছি যেখানে ঈদের তাৎপর্য্য অসহায়, দুস্থ, গরিবদের মুখে হাসি ফোটানো, ব্যথিতদের কষ্ট দূরীভূত করা সেখানে আমরা নিজেদের ভোগ বিলাসে মত্ত থেকে ঈদের মাহাত্ম্য থেকে নিজেদের বিচ্যুত করছি। গরিব প্রতিবেশী, আত্মীয়, দূরে অবস্থানরত কেউ, সকলের প্রতিই সামর্থ্যবানদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য থেকেই যায়।

মহানবী রাসুলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন, “মুমিন সমগ্র একটি দেহের ন্যায়। তার কোন একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ কষ্ট অনুভব করে।”

প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদুল ফিতর আমাদের জীবনে ফিরে এসেছে। ঈদে শান্তি ও কল্যাণের স্রোত বয়ে যাক। সত্য ও সুন্দরের পক্ষে গণজাগরণ ঘটুক। ঈদকে সামনে রেখে পরিবহনসহ বিভিন্ন সেক্টরে চাঁদাবাজি এবং অযাচিত হয়রানি বন্ধ হোক। প্রতিটি বিবেকবান মানুষ সামাজিক দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক। জনমনে শান্তি বিরাজমান হোক। পরাশক্তির হিংস্র ছোবলে ক্ষতবিক্ষত দলিত মুসলিম সমাজে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা আসুক। মুসলিম বিশ্বে অরাজকতা, বিশৃংখলা, সন্ত্রাস, জুলুম, নিপীড়নের ভেতর দিয়ে পথচলা সিরিয়া, ইয়েমেন, কাতার, ইরাক, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, লেবানন, কাশ্মিরসহ সকল অঞ্চলের মানুষ স্বাভাবিক জীবনে শান্তির জগতে ফিরে আসুক।

যারা অর্থ বিত্তে ক্ষমতাবান তাদেরকে নিরন্ন, অভাবী, দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিতে হবে। ধনী- গরীবের ব্যবধান ঘুচিয়ে পরষ্পরের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন মজবুত হোক। অহেতুক অপব্যয় কমিয়ে গরিব দু:খীদের মাঝে দান খয়অরাত বাড়িয়ে দেয়া উচিৎ। সঠিক হিসাবমতে যাকাত ফেতরা প্রদান করা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। যাকাত ও ফেতরা গরিবের হক। সঠিকভাবে যাকাত প্রদান না করলে নামায বা অন্য ইবাদত কবুল হয় না। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে একজন মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য এবং সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। পৃথিবীতে বিরাজমান সকল সন্ত্রাস, বিভীষিকা, জঙ্গিবাদ দূর হয়ে কেবলমাত্র আনন্দ বিরাজমান হোক। ঈদুল ফিতরের মাহাত্ম্য নিয়ে সবাই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক। সকলে ঈদের মর্মবাণী সঠিকভাবে উপলব্ধি করুক। আপনাদের জন্য ঈদুল ফিতরের অশেষ শুভেচ্ছা রইলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!