পহেলা বৈশাখ এবং বৈষম্যহীন কিছু অন্তর্নিহিত কথা!

পহেলা বৈশাখ এবং বৈষম্যহীন কিছু অন্তর্নিহিত কথা!

ভূপেন্দ্র নাথ রায়।।

বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাঙ্গালীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে রোমান, গ্রীক, মেসোপটেমিয়া, মিশরীয় সভ্যতার মতো সমৃদ্ধ কিছু পাওয়া না গেলেও মূঘল সম্রাট আকবরের যুগান্তকারী বাংলা সনের প্রচলন বাংলার ইতিহাস, সভ্যতা এবং সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক অনবদ্য সৃষ্টি। সম্রাট আকবর কৃষিকাজ, অর্থনৈতিক ও খাজনা আদায় সুবিধার্থে সৌরসনের সাথে মিল রেখে বাংলা সনের গণনা চালু করেন। সম্রাট আকবরের নির্দেশে রাজ জ্যোতিষি আমির ফতেহ উল্লা সিরাজী হিজরী সনের সাথে মিল রেখে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। প্রথম অবস্থায় তিনি এই বর্ষপঞ্জিকে “তারিখ- ই- ইলাহি” নাম করন করেন।  কৃষিকাজ এবং অার্থিক সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যেই বাংলা বর্ষপঞ্জির সীমাহীন পথচলা। অতীত ইতিহাস থেকে জানা যায়, কৃষকের ফসল ঘরে তোলার পর সম্রাজ্য উন্নয়ন ও পরিচালনার নিমিত্তে তাদের কাছে খাজনা আদায় করা হত এই  পহেলা বৈশাখে যার রীতি আজও বহমান।  পুরাতন খাতা ফেলে নতুন খাতায় হিসাব তুলতে ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করে।
শাব্দিক অর্থে হাল বলতে নতুন আর খাতা মানে খাতা। হালখাতা বলতে নতুন খাতার ব্যবহার। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পার করে আজ এটি বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকায় অধিষ্ঠিত।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা সন সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও হিন্দুয়ানী এ সন সহজে কেউ মেনে নেয়নি। পরবর্তীতে সংশোধনের প্রায় দুই যুগ পরে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার প্রধান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন বাংলা সন সরকারীভাবে পুনরায় সংস্কার করেন। কিন্তু এ দিনটি ছুটি ঘোষিত হয় অনেক পরে।
আজও অনেক ব্যবসায়ীরা এই দিনে হালখাতা করে থাকে। অন্যদিকে এই পহেলা বৈশাখ বাংলায় এনে দিয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য যা নিয়ে আমরা বাঙ্গালী হিসেবে গর্বিত। আবহমান বাংলার ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত  সর্বোপরি আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সবার মাঝে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনার জোয়ারে পুরাতন জরা-জীর্ণ, দু:খ, গ্লানি মুছে যাবে এই বিশ্বাসে নতুন দিনের শপথ নেয়। কবি গুরু যথার্থই লিখেছেন-
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনি:শ্বাসবায়ে মুমূষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।

গ্রামীণ বাঙ্গালী জীবনে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য, পোষাক-পরিচ্ছেদ, খাওয়া-দাওয়া এবং চাষাবাদে আনে বৈচিত্রতা, তেমনি শহুরে জীবনে আনে প্রাণচাঞ্চল্য, পান্তা-ইলিশের চিরায়ত পদ। এভাবেই সাম্প্রদায়ীকতার দেয়াল ভেঙ্গে সম্প্রীতির প্লাটফর্মে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন সম্পর্কের বাধনে আবিষ্ট হাজার বছরের বাঙ্গালী। ফলশ্রুতিতে রমনার বটমূল, চারুকলা, ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, রবীন্দ্র সরোবর, ভিক্টোরিয়াসহ দেশের প্রতিটি প্রান্তরে নতুন প্রাণের স্পন্দনে জেগে ওঠে সকল শ্রেণী, সকল পেশার মানুষ।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন নতুন বছরের নতুন দিন উদ্দেশ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটিসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক এবং আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয়, সেখানে বাংলাদেশে এই সুবিধাগুলো চালু করতে অনেক সময় নিয়েছে। তারপরও বর্তমান সরকার প্রশংসার দাবীদার বাংলা নববর্ষে তার অধস্তন কর্মকর্তা, কর্মচারীদের  বৈশাখী ভাতা চালু করায়। কিন্তু এদেশের বেশীরভাগ বে-সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক কর্মচারীর পহেলা বৈশাখ উৎসবের দিনটি গতনুগতিকভাবে পার করে। তারা মনে করে গোটা দেশ যখন উৎসবমুখর, ঠিক তখনি তারা বিমাতার সন্তান সদৃশ অসহায়ের মতো সরকারী কর্মচারীদের কাছে উপহাসের পাত্র। অথচ শিক্ষা বিস্তারে এসব শিক্ষক- কর্মচারীর অবদান নেহায়েত নগন্য নয়। এ যেন একই জাহাজে বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টের যাত্রীর মতো। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে যদি না প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারীকে সমান সুবিধা দেওয়া হয়। যেহেতু পহেলা বৈশাখ অসাম্প্রদায়ীকতা, বৈষম্যহীনতা কিংবা সম্প্রীতির জ্বলন্ত প্রতীক, সেহেতু সকল কর্মচারীর মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন অতীব জরুরী।

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!