পাঠ্যসূচির সম্ভাব্য পরিবর্তন প্রসঙ্গে

 

 

 

পাঠ্যসূচির সম্ভাব্য পরিবর্তন প্রসঙ্গে
রণেশ মৈত্র

 

বিগত বছরের (প্রকৃত পক্ষে বর্তমান বছরের) শিশু কিশোরদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকগুলিতে সুবোধ বালকের মতো আমাদের সরকার তাঁদের হাল আমলের পরম বন্ধু (!) হেফাজতে ইসলামের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী যে পরিবর্তন এনেছিলেন, কোন কোন মিডিয়ার খবরের কঠোর সমালোচনার কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য যে পাঠ্যবইগুলি ছাপানো হবে তাতে সংশোধনী আনতে যাচ্ছেন।
যতটুকু জানা যায়, হেফাজতের নির্দেশে পাঠ্যসূচি বা পাঠ্যবইতে যে গল্প কবিতা প্রবন্ধগুলি বাদ দেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের পাঠ্যবইতে আগামী বছরের পাঠ্যবইগুলিতে সেগুলি পুন:সংযোজন করতে যাচ্ছেন সরকার।
এছাড়া আর যে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে তাতেও ২০১৭ সালের বইতে যে অজস্র বানান ভূল ছিল এবার সেগুলিরও সংশোধন করে নির্ভূল বানান সম্বলিত বই ছাপানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এইটুকু গুনলে গতবারের বিক্ষুব্ধ বিপুল সংখ্যক পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই আনন্দিত হবেন ভাববেন যা হোক, অবশেষে সরকার আমাদের দাবীতো মেনে নিলেন অর্থাৎ সবাই যেন এ খবরে স্বস্তির নি:স্বাস ফেলবেন।
আরও স্বস্তি পেতে পারেন এটা জেনে গতবারের বইতে “ও” তে “ওড়না চাই” লেখা হয়েছিল এবং এ জাতীয় আরও অনেক কিছু লেখা হয়েছিল যার বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে বাঙালি সমাজ তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছিলেন এবার সেখানেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পরিবর্তে লেখা হচ্ছে “ও” তে “ওজন”। এতে হয়তো আমরা খুশীতে আরও ডগমগ হয়ে উঠবো।
যদিও এবারের সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে সরকারের সংশি−ষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে জনগণকে এখনও স্পষ্টভাবে কিছই জানানো হয় নি এবং সে কারণে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক বা অনলাইন মিডিয়াগুলিও তার বিস্তারিত তথ্য আজও প্রকাশ করতে পারেন নি।
তবে নানা অনুসন্ধানে যেটুকু এখন পর্য্যন্ত জেনেছি বা বুঝেছি তাতে এবারের নতুন পাঠ্যক্রমে সরকার গতবার যে সকল কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি বাদ দিয়েছিলো সেগুলি সংযোজিত হতে চলেছে তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐ ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতটাকে বিবেচনায় রেখে।
কিন্তু এর মধ্যে এক বিশাল ‘কিন্তু’ নিহিত থাকছে আর তা হলো কুখ্যাত হেফাজতে ইসলামের দাবী মোতাবেক যেগুলি গতবারের পাট্যপুস্তকে বাদ দেওয়া হয়েছিল নতুন করে সেগুলি সংযোজন করা হলেও যেগুলি গতবার ঐ মহলের দাবী অনুযায়ী সংযোজন করা হয়েছিল সেগুলি কিন্তু এবারের নতুন বইতেও থেকে যাবে অক্ষত অবস্থায়। সেগুলিকে বাদ দেওয়া হচ্ছে না বা এখন পর্য্যন্ত সেগুলি বাদ দেওয়ার কথা সরকার ভাবছেনও না।
তাহলে কি দাঁড়ায়?
বাল্যকালে অনেকের কাছে যেমন শুনতাম, “ডুডও খাব-তামাক খাব” সরকার এ ব্যাপারে যেন তেমন সিদ্ধান্তই নিতে চলেছেন। সরকারের হাল আমলের বিশ্বস্ত মিত্র হেফাজত ইসলামকে ও সন্তুষ্ট রাখা যাবে আবার গতবারের পরিবর্তনের কঠোর সমালোচক সকল দেশ প্রেমিক অসাম্প্রদায়িক মহলের মনের ক্ষোভও মেটানো যাবে।
একই ধরণের ঘটনা বর্তমান সরকার শুধু পাঠ্যবই-পাঠ্যসূচী নিয়ে করলেন বা করছেন তা নয়-দীর্ঘ দিনের অর্থাৎ বিগত ৭/৮ টি বছর ধরেই এমন এক কৌশলর(?) রাজনীতি করেই চলেছেন তাঁরা। যেমন তাঁরা সর্বপ্রযতেœ খুশী রাখতে চাইছেন দেশের ভয়াবহ উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামী জামায়াতে ইসলামী প্রমুখকে নানা ভাবে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল দাবী-দাওয়াগুলি মেনে নিতে-তেমনই আবার একই সাথে কিছু কিছু কথা ও কাজের দ্বারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষীয় ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুেিকও। লক্ষ্য হলো উভয় পক্ষের ভোট নিয়ে “নৌকা”কে বা নৌকার বাক্স ভরে তোলা নির্বাচনের সময়ে। এখন তা আরও জোরদার হয়েছে সম্ভবত: এই ভেবে যে তাঁরা মনে করছেন আগ্রামী নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলই অংশ গ্রহণ করবে। ২০১৪ সালের প্রার্থী বিহীন, ভোটার বিহীন, নজীর বিহীন, প্রতিদ্বন্দিতা বিহীন, নির্বাচন এবারে আর হবে না।
তথাকথিত কৌশলের স্পষ্ট নাম হলো আপোষ। চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ শক্তির সাথে মুক্তিযুদ্ধের তথা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের আপোষ। এমন আপোষের কথা বঙ্গবন্ধু তাঁরা জীবদ্দশায় মুহুর্তের জন্যেও ভাবতে পারেন নি বা ভাবেন নি। তাঁর কাছে জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান জিনিষটাই ছিল আদর্শ যার জন্য তিনি চরমতম ঝুঁকি নিয়ে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে গড়তে ডাক দিয়েছিলেন “যার যা আছে তাই-ই নিয়ে।”
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা যার জন্য পাকিস্তানকে সম্মিলিত কণ্ঠে “না” বলে ৩০ লক্ষ বাঙালির জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পতন করা বা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য্য হয়ে পড়েছিলো। আর ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যতিরেকে গণতন্ত্র হতে পারে না জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রও না। এখানেই ধর্মনিরপেক্ষতার সর্বাধিক তাৎপর্য্য ও গুরুত্ব।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা-বিরোধী দুটি ধর্মান্ধ দলের আচরণে খুব কি মৌলিক পার্থক্য আছে? জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামীর মধ্যে? একটি ১৯৭১ এ পাকিস্তান রক্ষা করতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট প্রভৃতি করেছিলো আর অপরটি অর্থাৎ হেফাজতে ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশেকে পুনরায় পাকিস্তান বানানোর লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে ধ্বংস করে পাকিস্তানী ভাবধারায় প্রসার ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষানীতি বদলানো পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন সাধান, নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তির প্রতিরোধ, বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতা করে তাকে অন্ত:সারশূণ্য করার লক্ষ্যে হাইকোর্ট প্রাঙ্গন, বিমানবন্দর এলাকা থেকে ভাস্কর্য্য অপসারণ ও মেষে দেশের সকল ভাস্কর্য্য ভেঙে ফেলার দাবী জানায় কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার কোনভাবেই সর্বকারী হস্তক্ষেপ মানবে না বলে জানায় আবার ঐ শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টার্স ডিগ্রীর সমতুল্য বলে ঘোষণা দিতে সরকারকে চাপ দেয় এবং সুকৌশলে তাতে সফলও হয়।
এভাবেই এবং আরও নানাবিধ উপায়ে তারা বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই চেষ্টার অপর বহি:প্রকাশ ঘটে প্রগতিমনা চিন্তক-লেখকদেরকে “নাস্তিক” আখ্যায় আখ্যায়িত করে তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশ্য রাস্তায় বা জনসমাবেশ ঘটা এলাকায় ধারালো চাপাতি বা তজ্জাতীয় অস্ত্র দিয়ে একের পর এক খুন করা। যেন আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার তাদের আছে। এভাবে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বেশ কিছু সংখ্যক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে ঐ পাকিস্তানপন্থী হেফাজতীদের বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে এবং আমরা তাদেরকে হারিয়েছি।
বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার বলে সর্বত্র পরিচিত বটে। আগেই বলেছি তাঁদের কতিপয় কথাও কাজ তার অনুকূলেও ঘটেছে কিন্তু ভোট প্রাপ্তির কৌশল বা ভোটবৃদ্ধির কৌশল হিসেবে যে সকল কাজ কয়েক বছর ধরে করে চলেছেন তাতে এই সরকার নিজেই নিজের মূল অহংকারের জায়গা থেকে দ্রুত সরে এসে পাকিস্তান পন্থীদের অঘোষিত প্রশ্রয়দাতায় পরিণত হচ্ছেন। জাতিকেও ফেলছেন এক ভয়াবহ বিপর্য্যয়ের মুখে।
আরও একটি দু:জনক অভিজ্ঞতা এই জাতিকে অর্জন করতে হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীকে ও তার সাথে সকল ধর্মাশ্রয়ীদলকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরকার টালবাহানা করছেন। বহু আগেই দফায় দফায় তাঁরা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামকে দল হিসেবে বিচার করে শাস্তি হিসেবে তাকে আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন সম্পন্ন হয়েছে এবং তা শীঘ্রই মন্ত্রীসভার অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীসভা বৈঠকে পেশ করা হবে। মন্ত্রীসভা অনুমাদন দিলেই তা সংসদে উত্থাপন ও পাশ করা হলেই সেই আইনে মামলাটি দায়ের করা হবে। এই কথা বলার পর আজ প্রায় দু’বছর অতিক্রান্ত হলো কিন্তু অগ্রগতি?
প্রতি সোমবারে মন্ত্রীসভার বৈঠক যেহেতু অনুষ্ঠিত হয় তাই ঐ উক্তির পর এযাবত কমপক্ষে ১০০ টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে মন্ত্রীসভার। কিন্তু ঐ আইন পাস হলো কি না তা আর জানা গেল না। মাননীয় আইনমন্ত্রী এর কোন জবাব দেবেন কি? উক্তিটি তো আপনারই।
এই বিষয়ে বহুবার লিখেছি অতীতে। কিন্তু তা যেন অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। তবুও পুনরায় বলি, এ জাতীয় আদৌ কোন আইন বা মোর্কদ্দমারও প্রয়োজন নেই। একটি সংবিধান সংশোধনী আনুন। তাতে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করুন দল দুটির যাদের বিরুদ্ধে নাশকতা ও অপরাপর অভিযোগে মামলা দায়ের করা আছে সেগুলিকে সক্রিয় করে বিচার করে তাদের সকলকে কঠোর শাস্তি প্রদান করুন। বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের সংবিধানে কোন মামলা না করে সংবিধানে এ জাতীয় বিধান সন্নিবেশিত করার মাধ্যমেই জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছিলেন এবং সেই পথই হলো এ ব্যাপারে সর্বোত্তম পথ। আশা করি এই পথে আগামী ১৫ আগষ্টের আগেই এ জাতীয় সংশোধনী এসে তা সংসদে অনুমোদন করা হবে জাতির দীর্ঘদিনের আকাংখা এবং সরকারের প্রতিশ্রুতি এভাবেই সম্বর পূরণ করা হবে।
আবারও ফিরে আসি পাঠ্যপুস্তকের সম্ভাব্য পরিবর্তন প্রসঙ্গে।
যত দ্রুত সম্ভব ঐ পরিবর্তন তথা গত বছর যেগুলি বাদ দেওয়া হয়েছিল সেগুলি সব যথাযথভাবে পুন: সংযোজন এবং হেফাজতের দাবীতে সেগুলি গতবছর নতুন করে সংযোগন করা হয়েছিল সেগুলিকে এবার স্থায়ীভাবে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত অতি সত্বর ঘোষণা করুন।
দ্বিতীয়ত: কওমী মাদ্রাসাগুলিকে সার্বিকভাবে সরকারী আওতায় এনে তাতে বাংলা ও বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষা প্রচলন করা হোক।
তৃতীয়ত: কওমরি সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে এখনই নয় যখন তারা সার্বিকভাবে সরকারী আওতায় এসে বাংলা ভাষা ও বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর অতিক্রম করবে এবং পর্য্যালোচনা করে যদি দেখা যায় ঐ শিক্ষা মাষ্টার্স শিক্ষার প্রকৃতই সমতুল্যতা অর্জন করেছে তখন মাষ্টার্স ডিগ্রীর সমতুল্য বলে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হোক;
চতুর্থত: অপসারিত সকল ভাস্কর্য্য যথাস্থানে অবিলম্বে পুন:স্থাপন এবং নতুন নতুন ভাস্কর্য্যও শিল্পকর্ম নানাবিধ প্রনোদনা ও ইতিহাসের স্মারক হিসেবে নির্মাণ ও দেশব্যাপী স্থাপন প্রয়োজন। সাথে সাথে অবিকল বাহাত্তরের সংবিধান পুনরুজ্জীবন কল্পে পঞ্চদশ সংশোধনীর সংশ্লিষ্ট অংশগুলিও বাতিল করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারে অপরিহার্য্য।

লেখক
রণেশ মৈত্র
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ঐক্য ন্যাপ।


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

  • কাগজটুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!