বৃদ্ধাশ্রমে প্রেম করে ৭৫ বছর বর ৭৩ বছর কনে- বিয়ের পিড়িতে

বেশি বয়সে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ ম্যান্ডেলা, রুশদি বা রবিশঙ্করের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নন, নেহাতই আম আদমি ওরা। তবু এমন ব্যতিক্রমী বিয়ের খবর ছড়াতেই শহর ভেঙে পড়ল পাহাড়ের কোল ঘেঁষা ছাদনাতলায়। গার্হস্থ্য জীবন থেকে সন্ন্যাস নেওয়া কেউ কেউ শেষ জীবনে অনেকটা বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু, বৃদ্ধাশ্রমে প্রেমের বাঁধনে পড়ে ফের গৃহী হওয়ার ঘটনা বিরল তো বটেই।

হাইলাকান্দির শান্তনুকুমার দাস সেচ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কর্মসূত্রে অসমের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে শেষে গুয়াহাটিতে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু পত্নীবিয়োগের পর নিঃসন্তান শান্তনুবাবুকে দেখভাল করার কেউ ছিল না। তার উপর ছিল সুগার, কিডনির সমস্যা। তখনই খবর পান, বামুনিমৈদামের কাছে উৎপল হর্ষবর্ধন ও মণিকা শর্মা বৃদ্ধাশ্রম খোলার পরিকল্পনা করছেন। সেখানে হাজির হন তিনি। তাকে প্রথম আবাসিক করেই ‘মাদার ওল্ড এজ হোমের’ পথ চলা শুরু। এখন সেখানে আবাসিকের সংখ্যা ২০। তাঁদের মধ্যে শান্তনুবাবুই একমাত্র পুরুষ।

উৎপল-মণিকারা বিবাহ-বাসরে বসে শোনাচ্ছিলেন প্রবীণ প্রেমিক-প্রেমিকার প্রণয়-পর্বের শুরুর কথা। গুয়াহাটি লাল গণেশ এলাকার বাসিন্দা মঞ্জু সিংহরায় বেসরকারি সংস্থার সামান্য চাকরি করতেন। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের সংসারে থাকতেন তিনি। কিডনির অসুখে ভাইকেও জমি বিক্রি করে ভাড়া বাড়িতে চলে যেতে হয়। ভাই মারা যাওয়ার পর ভাতৃবধূ, ভাইপো মঞ্জুদেবীর দায়িত্ব নিতে চাননি। মানসিক ভারসাম্য হারান তিনি।

ঘুরতেন পথে-পথে। তখনই উৎপল-মণিকা তাকে বৃদ্ধাবাসে নিয়ে আসেন। বিনামূল্যে তাকে রাখা হয়। শুরু হয় চিকিৎসা। তবু মাঝেমধ্যেই তিনি পালিয়ে যেতেন। একা কথা বলতেন। হাসপাতালে চিকিৎসার পরে তিনি সুস্থ হন। তবে, একটি পায়ে সমস্যা এখনও রয়েছে। গত বছর অসুস্থ হয়ে পড়েন শান্তনুবাবু। তখন মঞ্জুদেবীই তাঁর শুশ্রূষা করেন। মনের মিল ছিল দু’জনের। সম্ভবত সেই থেকেই ভালবাসার সূত্রপাত।

উৎপল বলেন, ‘‘বছর খানেক তাদের প্রেম চলছিল। আমরা তা বুঝতে পেরে মাস তিনেক আগে সোজাসুজি জানতে চাই, তারা বিয়ে করবেন কি না। দু’জনই বলেন, ওঁদের হারানোর কিছু নেই। তাই, একসঙ্গে চলতে অসুবিধা কোথায়?’’

বিয়ে শেষ হয় দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ। ততক্ষণে গ্রীষ্মের দাবদাহে মণ্ডপের ভিতরে থাকা সকলেই নাজেহাল। তবে, বরের যেন যৌবন ফিরে এসেছে। মণ্ডপ থেকে ওঠার পরেই, আশপাশে জড়ো হওয়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাঁর হাত ধরে নাচ শুরু করেন। পরে, দু’জন বসেন সিংহাসনে। ততক্ষণে, নিরামিষ ভোজের শেষ পংক্তি বসেছে।

মঞ্জুদেবী বলেন, ‘‘বাবা-মা-ভাই কারও সময়ই হয়নি আমার বিয়ে দেওয়ার। নিয়তিকে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু, শেষ জীবনে এত আনন্দ লেখা ছিল, ভাবতে পারছি না। ভগবানকে ধন্যবাদ।’’ মণিকা জানান, বিয়ের পরে বৃদ্ধাবাসে নবদম্পতির জন্য পৃথক ঘরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

শান্তনুবাবু তখন বলছেন, ‘‘বিয়ে করে বেশ ভাল লাগছে। এ বার মধুচন্দ্রিমাটা ভালয় ভালয় কাটাতে হবে। হাওয়া বদলের পথিকৃত শান্তনু-মঞ্জু শেষের কবিতার পথে তাঁদের নতুন জীবনের কবিতা শুরু করতে চলেছেন। শিলং-এ হানিমুনে যাচ্ছেন তারা। হোমের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সঙ্গে কাউকে পাঠানো হবে। কিন্তু, ‘কাবাব মে হাড্ডি’র সেই প্রস্তাব নাকচ করে শান্তনুবাবু জানিয়েছেন, তিনি একাই বউকে শিলং ঘুরিয়ে আনবেন। এমন বিয়ে চাক্ষুষ করতে আসা গায়িকা জুবিলি বরুয়া বলেন, ‘‘এই সব সম্পর্ক যেন জীবনের প্রতি, ভাল থাকার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনে।’’

মণ্ডপে তখন অক্লান্ত ষাট থেকে আশির ‘তরুণ-তরুণীরা’। বাত-পিত্ত-অম্বল-হাঁপানিকে তুড়ি মেরে গোল হয়ে তাঁরা গান ধরলেন— ‘আয়ে হো মেরি জিন্দেগি মে তুম বাহার বন কে!’

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!