ভিখারুন্নেছা হোক শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্কুল?

দশ বছরের মাথায় শিক্ষামন্ত্রী অরিত্রী মৃত্যু ঘটনায় বেশকিছু সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাকে ধন্যবাদ। শিক্ষা দফতর সংশ্লিষ্ট ৩ শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। তাদের এমপিও বাতিল হয়েছে। পুলিশ এক শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করেছে, বাকি দুইজনকে খুঁজছে।

অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যা প্রমান করে যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা আছে এবং এর আমূল পরিবর্তন দরকার। এ মৃত্যু অনাকাঙ্খিত। এক কিশোরী কতটা অপমানিত হলে আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে, এটি ভাবতে হবে? শিক্ষার্থীরা জীবন গড়ার জন্যে স্কুলে যায়, লাশ হয়ে ঘরে ফেরার জন্যে নয়?

অরিত্রীর আত্মহত্যা জাতিকে নাড়া দিয়েছে। অরিত্রী মরে নিজের লজ্জা ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু তার মৃত্যু জাতিকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। জানা যায়, ২০১২ তে ভিখারুন্নেছার শিক্ষকদের রূঢ় মন্তব্যে চৈতি রায় নামে আর একটি বালিকা আত্মহত্যা করেছিলো।

অরিত্রীর বাবা-মা-কে স্কুল ডেকেছিলো, মেয়েকে সাথে নিয়েই তারা স্কুলে যান। সেখানে এমন কিছু ঘটেছে যাতে একটি পঞ্চদশী নাবালিকা পিতামাতা ঘরে ফেরার আগেই বাড়ী এসে আত্মহত্যা করে। নিজের বা পিতার অপমান কি এতটাই অসহ্য ছিলো যে, তাকে রাগে-অপমানে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হলো?

স্কুলে সেদিন ঠিক কি ঘটেছিলো তা জানা দরকার। স্কুলের অধ্যক্ষা বা সংশ্লিষ্টরা এর দায় এড়াতে পারেন না? অরিত্রী আত্মহত্যা করেনি, স্কুল কর্তৃপক্ষের উন্মাষিকতা তাকে আত্মহননে প্ররোচিত করেছে। আশির দশকে ভিখারুন্নেছা কলেজ সেকশনে দু’একবার এক্সটারন্যাল হিসাবে গিয়েছিলাম। তাদের উন্মাষিকতা তখনো ছিলো।

তখন ভাবতাম, স্কুলটার নাম এমন কেন? পাকিস্তানের এক প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খাঁন নুনের স্ত্রীর নামে এই স্কুল। দেশ স্বাধীন হয়েছে, দৈনিক পাকিস্তান হয়েছে দৈনিক বাংলা, পাক মোটর হয়েছে বাংলা মোটর, কিন্তু স্কুলের নামটি পরিবর্তন হয়নি? এখন হলে কেমন হয়? শহিদ জননী জাহানারা ইমাম স্কুল?

হাইকোর্ট ভিকারুন্নেছা স্কুলের ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাকে হৃদয় বিদারক বলে বর্ণনা করেছেন। রীট হয়েছে। অরিত্রীর বাবা বাদী হয়ে মামলা করেছেন। ঘটনার পর শিক্ষামন্ত্রী স্কুলে যান এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তোপের মুখে পড়েন।

স্বজনরা বলছেন, স্কুলের শিক্ষকদের কাছে বাবার অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে অরিত্রি। শিক্ষকরা বলেছেন, বাবার অপমান নয়, পরীক্ষায় নকল করে ধরা পড়ে লজ্জায় এ ঘটনা ঘটিয়েছে অরিত্রি। অধ্যক্ষ হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছেন।

অরিত্রী ও তার বাবা অধ্যক্ষার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি ক্ষমা করেননি। বরং পরদিন গিয়ে টিসি নেয়ার পরামর্শ দেন? অধ্যক্ষা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির যেই সদস্য ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন, তিনি কে এবং তার ভূমিকা জানা দরকার।

ধরে নেয়া যাক, অরিত্রী নকল করছিলো, কিন্তু এর শাস্তি তো মৃত্যু হতে পারেনা? স্কুল তো বাঁচতে শিখায়, মরতে না? অধ্যক্ষা একটি বালিকাকে ক্ষমা করতে পারেননি, সেখানে জাতি তাকে ক্ষমা করে কিভাবে? অথচ স্কুলের একটু ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গী একটি জীবন বাঁচাতে পারতো।

স্কুলে চরম অপমানের পর মেয়েকে একা বাসায় যেতে দেয়াটা ঠিক হয়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ অরিত্রীর ক্ষেত্রে ‘মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী’ দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন। অধ্যক্ষ অরিত্রীকে টিসি দিতে পারেননি, বরং অরিত্রী সমাজকে টিসি দিয়ে চলে গেছে।

অরিত্রীর বাবা স্কুলে অপমানে কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিশ্চয় স্কুলে আরো কিছু ঘটেছে যা পিতাকে কাদায়, কন্যাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়? স্কুলের অধ্যক্ষা ও উপাধ্যক্ষা কন্যার সামনেই তার বাবাকে অপমান করতে পারলেন?

এ সময় নাকি একজন শিক্ষিকা অরিত্রীর বাবাকে যাইচ্ছে তাই ভাবে অপমান করেন। ইহা কি সত্য? এটি কি চরম অবজ্ঞা নয়? একজন শিক্ষিকার কাজ কি একজন পিতাকে অপমান করা? ভিখারুন্নেছার শিক্ষকরা নিজেদের কি মনে করেন? হয়তো এ কারণে হাইকোর্ট বলেছেন, শিক্ষকদেরও মানসিক কাউন্সেলিং দরকার।

হাইকোর্টে রীট হয়েছে। কোর্ট পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্কুল তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। কেউ কেউ এটাকে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বলতে চাচ্ছেন। অধ্যক্ষাকে ‘খুনী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। স্কুলের ছাত্রীরা এবং অভিভাবকরা বিক্ষোভ করছেন।

অনেকে এটিকে ক্ষমতার দাপট হিসাবে দেখতে চাইছেন। যে যাই বলুন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থাকা চাই। শিক্ষকতা পেশা শুধু একটি পেশা নয়, এরসাথে মানবিকতা, দায়বদ্ধতা, সততা থাকতে হয়। বিশেষত: ছোট ক্লাশের শিক্ষকদের তো বাচ্চাদের বন্ধু হতে হয়?

ছাত্র জীবন হচ্ছে একজন মানুষের উৎকৃষ্ট সময়। আমেরিকায় দেখি বাচ্চারা স্কুলে যাবার জন্যে পাগল। শিক্ষকরা তাদের বন্ধু। যাহোক, অরিত্রি ঘটনার সুষ্ঠূ তদন্ত ও বিচার হওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যতে আর কোন শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যা করতে না হয়?

অরিত্রি চলে গেছে, কোন প্রতিকারই তাকে আর ফিরিয়ে আনবে না? তবু তার চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের জীবন সুন্দর হোক।

-শিতাংশু গুহ, ৫ই ডিসেম্বর ২০১৮।।


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!