মোটা দাগে লোন চাইঃ ঋণ খেলাপি হবো

মোটা দাগে লোন চাইঃ ঋণ খেলাপি হবো
রণেশ মৈত্র (একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্যন্যাপ

ভাঙাচোরা একটি বাড়ীতে বাস করি ত্রিশ বছরেরও অধিককাল যাবত। বাড়ীটি পাবনা শহরের বেলতলা রোডে অবস্থিত। অর্পিত সম্পত্তি তালিকায় (ক) তফশীলভূক্ত একচালা টিনের ঘর। শতদীর্ণ। শতাধিক বছর আগে নির্মিত। বাড়ীটি লিজ নিয়ে বাস করছি। বছর বছর লিজের টাকাও পরিশোধ করি।

বাড়ীটি এমনই যে বৃষ্টি নামার আগেই রান্নাঘর, স্নানঘর, টয়লেটসহ তিনটি বেড রুমেই (দু’দিকের দুটি বারান্দাসহ) ঝম ঝম করে জল পড়তে শুরু করে। বিছানাগুলিকেও ভিজিয়ে দেয়। সংবাদপত্র, বই পত্রের নিরাপত্তা বিধানও দুরুহ হয়ে পড়ে। ঐ সুযোগে ঘরগুলো স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ায় উই জাতীয় কাগজপত্র বাই ও কাপড় চোপড়ের বিধ্বংসী শত্রু সব কিছু কাটতে শুরু করে। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মত কোন ঔষুধপত্রও বাজারে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আবার বেশী পরিমাণ বৃষ্টি হলে বাড়ীর দুটি আঙ্গিনাসহ প্রতিটি ঘরে হাঁটু পরিমাণ জল ঢুকে পড়ে। তার সাথে অবধারিত ভাবেই চলে আসে ব্যাঙ, সাপ ও অন্যবিধ পোকা মাকড়। নিরুপায় হয়ে তখন স্বামী স্ত্রী উভয়কেই খাটের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হয়। এর পর যখন বিদ্যুত চলে যায় তখন ঐ সাপ-পোকা মাকড়ের ভয়টা অন্ধকারে আরও বেড়ে যায়। হাতে রাখি টর্চলাইট। এভাবে কয়েকঘন্টা সময় কাটাতে হয় কারণ ড্রেন নামক এক আইলের অস্তিত্ব বাসার সামনে থাকলেও জল বেরুনোর মত কোন আউটলেট নাই। ফলে জলটা নামতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়।

এমনতরো যন্ত্রণার কারণে বাধ্য হয়ে একদিন জেলা প্রশাসককে বললাম, বাড়ীটা আপনারা লিজ দিয়েছেন ৩২/৩৩ বছর আগে। সেই থেকে এ যাবত বাড়ীটার কোন মেরামত করে দেননি ফলে এখন বাড়ীটা বাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য। বর্ষাকাল এসে গেল। বাসায় তো ঐ সমস্যায় আবারও পড়তে হবে। কিছু একটা করুন যাতে এই সংকটের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বাসাটা আইনত: আমার হাতে সমর্পণ করা কথা কিন্তু সরকারের কাছে আবেদন করেও কিছু হচ্ছে না। জেলা প্রশাসক বললেন, একটা দরখাস্ত দিন আমি আশা করি কর্তৃপক্ষ এ বাবদে কিছু মঞ্জুর করবেন। উত্তরে বললাম দরখাস্ত তো আপনি উপরের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবেন-তার জবাব কখন বা কতদিন পরে পাওয়া যাবে-তা তো কেউই বলতে পারেন না। কিন্তু ততদিন বাস করি কিভাবে। বাড়ীর মেরামত কাজ কি শুরু করবো ? উনি অনুমতি দিলেন আমিও দরখাস্ত দিয়ে ভালভাবে মেরামতের কাজ হাতে নিলাম। সে আজ প্রায় আড়াই মাস আগের কথা আজ ২২ মে পর্যন্ত কাজ চলছে। অনুমান করি শেষ হতে আরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগবে। আমার এক ছেলে, সহধর্মিনী ও আমার পুঁজি পাট্রা যা ছিল সব শেষ। কিন্তু সরকারি কোন মঞ্জুরী আজও আসেনি।

কী করি ? এখন তো কাজ বন্ধ করতে হয় টাকা পয়সার অপ্রতুলতার জন্যে। ধার দেনা যতটা সম্ভব তাও করেছি কিন্তু তাতেও পার পাওয়া যায় নি।

ইতোমধ্যে অনুজপ্রতিম এক মুক্তিযোদ্ধা জানালেন, সোনালী ব্যাংক থেকে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লাখ তিনেক টাকা লোন পাবেন। উনিও নিয়েছেন। ভাবলাম মন্দ কি ? ঐ টাকা পেলে মেরামত কাজ সেরে ফেলতে পারবেন তাই খোঁজ নিতে সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে গিয়ে বলতেই তাঁরা এক মস্ত ফিরিস্তি দিয়ে বললেন এগুলি সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট কর্মে আবেদন করুণ হয়ে যাবে।

ফিরিস্তিটা দেখে আমার চক্ষু চরক গাছ। প্রধানমন্ত্রীর সার্টিফিকেট মুক্তিযোদ্ধা সনদ, লালমুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়ে থাকলে তার অনুলিপিসহ গেজেট, জাতীয় পরিচয় পত্রের অনুলিপি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রাপ্তির ব্যাংক প্রদত্ত বই, ছবি প্রভৃতি জমা দিতে হবে। বললাম, আমি শুধুমাত্র গেজেটে, জাতীয় পরিচয় পত্র, ফটো আর ব্যাংকের ভাতা প্রাপ্তির বই দিতে পারব। আমি যে সরকারিভাবে স্বীকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধা-তা প্রমাণের জন্যে তো ওগুলিই যথেষ্ট। ওনারা এর পরেও লোন দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করে জানালেন-তাঁদের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশ, সমস্তগুলি ডকুমেন্ট না পেলে যেন আমরা মুক্তিযোদ্ধাকে ঋণ না দেই।

এমন একটি জবাবের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম। তাই নীরবেই বেরিয়ে এলাম।
পরদিন সকালে সংবাদপত্র যেই মাত্র হকার আমার বাসায় পৌছে দিলো-দেখি বাংলাদেশ ব্যাংক বড় বড় ঋণ খেলাপিদের নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে আইন পাশ করে প্রজ্ঞাপন জারী করেছেন। ঐ সুযোগ সুবিধার খবর পেয়ে ঋণ খেরাপিরা সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। জানাবেনই বা না কেন ? ঐ ঋণ খেলাপিদের তো থাকার কথা ছিল জেলা খানায় কারণ ঋণ খেলাপি হওয়ায় প্রবণতার অপরাধ। অর্থ ঋণ আদালত, দু’দক-সবাই কঠোর সাজা দেবেন যদি মামলা রুজু করে। কিন্তু তাঁরা সে পথে না গিয়ে খেলাপিদের নতুন করে আর্থিক প্রণোদনা দিলেন-যার অর্থ তাঁদেরকে যেন কর্তৃপক্ষ অভিনন্দন জানালেন। নতুন করে ঋণ পাওয়ার সুযোগও আইনে থাকলো।

আর যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিয়মিত পরিশোধ করে আসছেন-তাঁরা সরকারের কাছে থেকে মূলত অভিনন্দন পত্র পাবেন-কোন আর্থিক প্রণোদনা নয়। সার্টিফিকেট মূল্যহীন নয় তবে তাতে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। দুষ্টু লোকেরা, অর্থনীতিবিদেরা এবং একজন এম.পি. (সাবেক মন্ত্রী) বললেন এতে দেশের ক্ষতি হবে এবং ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে যাবে ব্যাংকগুলিও নতুন করে সংকটের মুখোমুখি হবে। এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক লা জওয়াব। অর্থাৎ তাঁরা বড় বড় ঋণখেলাপিদের নতুন নতুন সুযোগ সুবিধা দিয়ে যেতেই থাকবেন। উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে তা অবশ্য আপাতত: বন্ধ আছে।
অপরদিকে আমি বৃহত্তম সরকারি ব্যাংক (সোনালী ব্যাংক) এ গিয়েছিলাম মাত্র তিনলাখ টাকার লোন পাওয়ার জন্য। পেলাম না। কারণ নিশ্চয়ই এই যে ওটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র লোন। তার জন্যে আইন তো কঠোর হতেই হবে। সে ক্ষুদ্র লোন মুক্তিযোদ্ধাা-অমুক্তিযোদ্ধা যিনিই চান না কেন-তাঁদেরকে অবশ্যই কঠোর নিয়মের আওতায় চলতেই হবে।

খালি চোখে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, ঋণখেলাপি হয়েও আইনের মারপ্যাচে কতজন এম.পি., কতজন মন্ত্রী, কতজন উপদেষ্টা হয়ে আছেন। তাঁরাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছের আদরের পাত্র শ্রদ্ধার পাত্র।
ভাবতে চেষ্টা করলাম, দেশের সংবাদপত্রগুলিতে তো বহু সংখ্যক ঋণ জালিয়াতির এবং অর্থ পাচারের খবর প্রকাশিত হতে দেখি-কিন্তু কে, তাদের বিরুদ্ধে তো কোন শাস্তির বা মামলা দায়েরর কথা তাদের কারও জেলা-জরিমানা হওয়ার খবর তো আজতক আমার চোখে পড়ে না।

সুতরাং অনেক ভেবে চিন্তে স্থির করলাম, বড় বড় লোন নেব। এবং সে লোনের পরিমাণ কমপক্ষে দশ হাজার কোটি টাকা। এটাই সম্ভবত: বৃহৎ লোনের ক্ষুদ্রতম লোন। তাই ক্ষুদ্র দিয়েই শুরু করতে চাই। চাইলেই পাব কিনা তা অবশ্য এখনও জানি না কারণ এ যাবত কোনদিন ঋণ নেই নি-ঋণখেলাপিও হইনি। তবুও শুনি ব্যবস্থা করতে পারলে না কি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ লোন মঞ্জুর করে থাকেন।

তো ‘ব্যবস্থা’ কথাটা যতই অস্পষ্ট হোক-তার অর্থ তো দেশের সবাই জানেন। ‘ব্যবস্থা’ করা মানে সহজ কথায় ‘ম্যানেজ’ করা। সেই যোগ্যতা ও না থাকার কথা কারণ ঐ ‘ম্যানেজ’ করার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে উদ্দেশ্যটা যখন ঋণ শোধ না করা বা ঋণখেলাপি হওয়া-এবং সেটা যখন গোপন না রেখে সাহস করে প্রকাশ্যেই বলে ফেললাম-তখান হয়ত কর্তৃপক্ষ ঐ দশ হাজার কোটি টাকা লোন আমাকে নিশ্চই মঞ্জুর করতে উৎসাহী হবেন। অভিজ্ঞতা না থাকলেও চারিদিকে চোখ মেলে তাকিয়ে যা দেখছি তাতে এমনটাই আমার ধারণায় হয়েছে।

অবশ্য সহজতর পদ্ধতি হতো যদি আমি কোন ব্যাংকের মালিক বা পরিচালক বা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতাম। তা হলে তো সেই ব্যাংক থেকে বড় সড় লোন নিয়ে সেই টাকা দিয়ে নতুন একটা ব্যাংক স্থাপন করে আবার সেখান থেকে মোটা দাগে লোন নিতে পারতাম (সেই নতুন ব্যাংক থেকে)। এবং পরিচালক বা ডাইরেক্টার হলে সেই সুবাদে অপরাপর অনেক ব্যাংক থেকেই এমন ধরণের বৃহৎ লোন নিয়ে এবং কোনটাই পরিশোধ না করে দিব্যি টাকা বিদেশে পাচার করতে পারতাম, দেশ বিদেশ ঘুরতে পারতাম, তার আগে বহুতল বিশিষ্ট বাড়ী, দামী দামী গাড়ির মালিকানা অর্জন ও তীর্থ ভ্রমণ করে পূণ্য অর্জন করতে পারতাম। কিন্তু ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুযোগ ঘটে নি- তাই এতগুলি ‘বৈধ’ সুযোগের একটি ও পেতে আমি অধিকারী হইনি।
কিন্তু লোন না পেলে তো চলছেই না। ডাইরেক্টার ফাইরেক্টার যখান নই তখন “ব্যবস্থা” বা “ম্যানেজ” করে লোন নেওয়া ছাড়া গত্যান্তরও নেই।

তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সকল ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন, মাত্র তিন লাখ টাকার ক্ষুদ্র ঋণ যখন দেওয়া গেলই না বা আমি পেলামই না- তখন বাধ্য হয়েই আমি বৃহৎ বা দশ হাজার কোটি টাকার লোন চাই। “ব্যবস্থা” “ম্যানেজ” করা কোন কঠিন কিছু হবে না। কথা দিচ্ছি, দশ হাজার কোটি টাকা লোন মঞ্জুর হলো আমি ৯০০০ কোটি টাকা নিয়ে “দশ হাজার কোটি টাকা বুঝিয়া পাইলাম” বলে স্পষ্টাক্ষরে লিখে দেব। আর ঐ ৯০০০ কোটি টাকা, আমি ওয়াদা করছি, কোন দিনই পরিশোধ না করে ঋণখেলাপি হবো। ঋণখেলাপি হয়ে অর্ধেক টাকা অর্থাৎ ৪৫০০ বা ৫০০০ কোটি টাকা হুন্ডি মারফত বা অন্য যে কোন পথে বিদেশেও পাচার করবো। কারণ দেখছি যে বিদেশে অনেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন কিন্তু সে কারণে কারও শাস্তি হয় নি। সুতরাং তারাও সরকার ও ব্যাংকের কাছে নিশ্চয়ই “দেশপ্রেমিক-ভালো মানুষ” বলে পরিগণিত হয়ে থাকে। তাই ঐ পথেও হাঁটার অঙ্গীকার করছি।

বাদ-বাকী ৪০০০/৪৫০০ কোটি টাকার অংশ বিশেষ দিয়ে বহুতল বিশিষ্ট দালান কোঠা, জমি, দামী গাড়ী কিনবো এবং অংশ বিশেষ দিয়ে সন্ত্রাসী, তীর্থ ও দেশ বিদেশ ভ্রমণ করবো। দু’একটা স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ‘শিক্ষানুরাগী’ হব এবং আর কিছু অংশ দিয়ে মন্দির, এতিমখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে “ধার্মিক” ও হয়ে যাব।
এই মহান কাজগুলি করার সুযোগ চাই মাননীয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকবৃন্দ। আবারও কথা দিচ্ছি আমি ঋণ খেলাপি হবো কদাপি তা পরিশোধ করবো না- কখনও না।

আমি নিশ্চিত হতে চাই, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিন লাখ টাকার ক্ষুদ্র ঋণ নয় হাজার টাকার মাঝারি লোনই অতি দ্রুত আমার নামে মঞ্জুর করা হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!