যাঁদের রক্তে অর্জিত হয়েছে বাংলাভাষার গৌরবোজ্জল ইতিহাস

যাঁদের রক্তে অর্জিত হয়েছে বাংলাভাষার গৌরবোজ্জল ইতিহাস
-মাহবুব এইচ শাহীন

ভাষা শহীদ রফিক

ভাষা শহীদ রফিক ১৯২৬ সালের ৩০শে অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার পারিল গ্রাম বতর্মানে রফিকনগর, ইউনিয়ন-বলধারা, থানা-সিঙ্গাইরে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদ রফিকের পুরো নাম রফিক উদ্দিন আহমেদ। পিতার নাম আবদুল লতিফ মিয়া এবং মাতার নাম রাফিজা খাতুন। ভাষা শহীদ রফিক পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন। অন্য ভাইদের নাম রশিদ, মুক্তিযোদ্ধা খালেক, সালাম ও খোরশেদ আলম। শহীদ রফিক তার বাড়ী থেকে ৭ মাইল দুরে অবস্থিত বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। বাবার প্রিন্টিং ব্যবসা দেখা শুনার জন্য পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। শহীদ রফিক একই গ্রামের মেয়ে রাহেলা খাতুন পানুকে ভালবাসতো। পারিবারিক ভাবে তাদের এই ভালবাসাকে মেনে নিয়ে পরিবার থেকে বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করা হয়। সেই উপলক্ষ্যেই বিয়ের বাজার করার জন্য তিনি ঢাকায় যান। ২১শে ফেব্রুয়ারী বিয়ের শাড়ী-গহনা ও কসমেটিকস নিয়ে সন্ধ্যায় তাঁর বাড়ী ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই মহান ব্যক্তি যখন শুনতে পেলেন বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে মিছিল বের হবে তখন তিনি ছুটে যান এই মিছিলে। তৎকালিন সরকার কর্তৃক আরোপিত ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারী ছাত্র জনতার সাথে তিনিও বিক্ষোভ মিছিলে অংশ গ্রহন করেন। মিছিলে নির্বিচারে ছাত্র জনতার উপর গুলি বর্ষন শুরু হয়। একটি গুলি রফিক উদ্দিনের মাথায় বিদ্ধ হয়ে মাথা ঝাঝরা হয়ে যায় ঘটনাস্থলেই রফিক শহীদ হন। শহীদ রফিকই সম্ভবত পৃথিবীতে ভাষার জন্য প্রথম শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। তবে পাকিস্তানী হায়েনেরা তাকে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তার লাশ লুকিয়ে ফেলে এবং জনরোষের ভয়ে পরদিন সেনাদের সহযোগীতায় আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ রফিককে দাফন করা হয়। কিন্তু তাঁর কবরের কোন চিহ্ন রাখা হয়নি। ফলে আজিমপুর কবরস্থানে হাজারো কবরের মাঝে ভাষা শহীদ রফিকের কবরটি অচিহ্নিত থেকে গেল। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ সরকার শহীদ রফিককে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। এবং সরকারী ভাবে ২০০৬ সালে তারঁ “পারিল” গ্রামে ভাষা শহীদ পাঠাগার ও স্মৃতি যাদুঘর স্থাপন করা হয় শহীদ রফিকের নামে। যেখানে তার ব্যবহৃত জিনিষপত্র ও প্রচুর বই আছে। তারও আগে প্রশিকার উদ্দ্যোগে তারঁ বাড়ী সংলগ্ন একটি ছোট লাইব্রেরী গঠন করা হয়। যেখানে মূলত উনার স্মৃতি গুলো প্রথম থেকে সংরক্ষন করার ব্যবস্থা করা হয়।

ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার

ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার ১০শে অক্টোবর ১৯১৯ইং ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাছেন আলী এবং মাতার নাম সাফাতুন নেছা। তিনি ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন এবং পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া শেষ করেন। এরপর তিনি তার পিতাকে কিছু দিন কৃষি কাজে সাহায্য করেন। পরবর্তীতে আরো ভাল কিছু করার আশায় তিনি নারায়গঞ্জে চলে আসেন এবং এখানে পরিচয় হয় একজন ইংরেজ নাবিকের সাথে। তিনি আব্দুল জব্বারকে রেঙ্গুন শহরে (সাবেক দেশ বার্মা বতর্মান মায়ানমারে) একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেন। ১২ বৎসর আব্দুল জব্বার রেঙ্গুনে কাজ করেন এবং স্বাস্থ্যগত কারনে শিপে কাজ করতে না পারার দরুন পুনরায় গ্রামে ফিরে আসেন। তিনি গ্রামে ফিরে গ্রামের ছেলেদের নিয়ে একটি গ্রাম্য ডিফেন্স দল গঠন করেন যে দলের নেতৃত্বে তিনি কমান্ডার হিসাবে ছিলেন। ১৯৪৯ সালে তিনি তাঁর এক বন্ধুর বোন আমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন। ঐ সংসারে তাঁর একমাত্র ছেলে নুরুল ইসলাম বাদলের জন্ম হয়।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর ২/৩ দিন আগে তিনি তাঁর ক্যান্সার আক্রান্ত শাশুড়ীকে চিকিৎসা করাতে জনাব সিরাজুল ইসলামের সহযোগীতায় শাশুড়ীকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করান। তিনি তাঁর আত্মীয়া আয়শা খাতুন এবং পরিচিত আব্দুল হাইয়ের বাসায় ঐ সময় রাত যাপন করতেন। ঢাকা মেডিক্যালের বাইরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে ছাত্র জনতা সোচ্চার এবং শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত ঢাকার রাজপথ তখন তিনি মেডিক্যালে ভর্তি হওয়া রোগী তাঁর শাশুড়ীর শয্যা পাশে বসা থাকতেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার অল্পক্ষণ আগে সিরাজুল ইসলামের সাথে শাশুড়ীর রোগের ব্যাপারে কথা বলে তিনি মেডিক্যালের গেইটের বাইরে শাশুড়ীর জন্য কিছু ফল কিনতে গেলেন। এবং ঐ সময় তিনি দেখেন রাষ্ট্র ভাষার দাবী বেশ কিছু ছাত্র-জনতা ব্যানারসহ সমবেত হয়েছে এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে অনবরত শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। আব্দুল জব্বার আর স্থির থাকতে পারেনি তিনি অসুস্থ শাশুড়ীর জন্য ফল নেওয়ার কথা ভুলে গিয়ে ব্যানার হাতে মিছিলের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ান। ঐ সময়ে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলাগুলি শুরু হয়, এতে আব্দুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি ২১ ফেব্রুয়ারী রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শহীদ আব্দুল জব্বারকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে মরনোত্তর ২১শে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন। ঢাকার আজিমপুর পুরানো কবরস্থানের এই কবরে মহান ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন।

ভাষা শহীদ আবুল বরকত

ভাষা শহীদ আবুল বরকত ১৬ই জুন ১৯২৭ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার বাবলা নামক একটি ছোট গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতার নাম শামসুউদ্দিন। ১৯৪৫ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রামের তালিবপুর ইংলিশ হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। পরে ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। ঢাকার পুরানা পল্টনে বিষ্ণু প্রিয়া ভবনে তার মামা আব্দুল মালেকের বাড়ীতে উঠেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই বাড়িতেই ছিলেন। ঢাকায় এসে ১৯৪৮ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। ছাত্র হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী, নম্র, ভদ্র ও চরিত্রবান। ১৯৫১ সালে তিনি অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেনীতে চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং এম.এ. শেষ পর্বে ভর্তি হন। ১৯৫২ সাল ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত সমাবেশে যোগদান করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতার শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ শুরু হয় বিক্ষিপ্তভাবে। পুলিশ চেষ্টা করছিল ছাত্রদের ব্যারিকেড ভেঙ্গে হোস্টেল চত্বরে ঢুকতে। কিন্তু, ছাত্রদের শক্ত প্রতিরোধের কারনে তারা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছিল । বেলা ৩টার দিকে হোস্টেল চত্বরে ঢুকে নির্মমভাবে গুলি চালাতে থাকে পুলিশ। সেই সময় আবুল বরকত অন্য এক বন্ধুর দিকে এগিয়ে এসেছিলেন। হঠাৎ তিনি বুলেটের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। প্রথমে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি, ততক্ষনে রক্তধারা ছুটে মাটি ভিজে যাচ্ছে। তলপেটে গুলি লেগেছিল তার । পরনের নীল হাফ শার্ট, খাকি প্যান্ট ও কাবুলী স্যান্ডেল রক্তে ভিজে যাচ্ছে। দুই তিন জন ছুটে এসে সুঠামদেহী বরকতকে কাঁধে তুলে জরুরী বিভাগের দিকে দৌড়াতে থাকেন। বরকত তখন বলেছিলেন “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে হয়ত আর আমি বাঁচবনা, পুরানা পল্টনে বিষ্ণু প্রিয়া ভবনে এ খবর পৌঁছে দিবেন। ডাক্তাররা তাকে বাঁচানো জন্য আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের জন্য সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী রাত ৮টার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী ওয়ার্ডে মহান এই দেশ প্রেমিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী মোট কতজন শহীদ হন তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কারন অনেক শহীদের লাশ মর্গ হতে মিলিটারী ও পুলিশ গুম করে ফেলে। পরের দিন তাদের জানাজা হবে ছাত্ররা মাইকে এই ঘোষনা দিলে পুলিশ সে রাতেই মর্গ থেকে লাশ সরিয়ে ফেলে। আবুল বরকতের মামা আব্দুল মালেক ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ্যাসিস্ট্যান্ট একাউন্টস অফিসার এবং তার এক আত্মীয় আবুল কাসেম এস.এম.জি. বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারী ছিলেন। তারা দুজনে তদবীর করে পুলিশের কাছ থেকে আবুল বরকতের লাশ উদ্ধার করেন। ২১ ফেব্রুয়ারী রাত ১০টার দিকে পুলিশের কড়া পাহাড়ায় আজিমপুর পুরাতন গোরস্থানে আবুল বরকতের লাশ দাফন করা হয়। শহীদ আবুল বরকতকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে মরনোত্তর ২১শে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।

 

ভাষা শহীদ আবদুস সালাম

ভাষা শহীদ আবদুস সালাম ফেনী জেলার দাগনভুঁইঞা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। লক্ষণপুরের বর্তমান নাম সালাম নগর। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া এবং মাতার নাম দৌলতের নেছা। তিনি স্থানীয় মাতুভূঁইঞা করিমুল্লা জুনিয়র হাই স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। অতঃপর চাকরির সন্ধানে ঢাকায় আসেন। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগে পিয়ন হিসাবে চাকরি পান। ঢাকায় ৩৬বি, নীলক্ষেত ব্যারাকে তিনি বসবাস করতেন। ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে আবদুস সালাম ছিলেন সবার বড়। বর্তমানে জীবিত আছেন শহীদ সালামের এক ছোটভাই আবদুল করিম ও বোন বলকিয়ত নেছা। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে বাহান্নের ভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতা বাংলা ভাষার দাবীতে যে মিছিল করে আবদুস সালাম সে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ গ্রহণ করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে পড়লে মিছিলে পুলিশ নির্বাচারে গুলি চালায়। বিকেল সাড়ে তিনটায় পুলিশের বেপরোয়া গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হন অনেকে। গুরতর আহত অবস্থায় আবদুস সালামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সালামের ম্যাচের কাজের বুয়ার ছেলে তেজগাঁ নাবিস্কুতে কর্মরত সালামের ভাতিজা মকবুল আহম্মদ ধনা মিয়াকে জানান তার চাচা সালাম গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মকবুল ছুটে যান সালামের আরেক জেঠাতো ভাই হাবিব উল্যাহর কাছে। তারা দু’জনে মিলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে দেখেন, পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে সালাম সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মেডিক্যালের বারান্দায় পড়ে আছেন। তারা ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় টেলিগ্রামে সালামের বাবা ফাজিল মিয়াকে সালামের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি জানান। ফাজিল মিয়া তার অন্য এক ছেলেকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ছুটে আসেন। পর দিন সকাল ৯টার দিকে বেশ কিছু ছাত্র সালামের যথাযত চিকিৎসা না করার অভিযোগে হাসপাতালে বেশ কিছুক্ষণ হট্টগোল করেন। মকবুল ও হাবিব উল্যাহ হাসপাতালে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকলেও সংজ্ঞাহীন সালামের বিছানার পাশ থেকে তার বাবা কোথাও আর যায়নি। বাবার উপস্থিতিতে হাসপাতালেই ২৫ ফেব্রুয়ারী বেলা সাড়ে ১১টায় আবদুস সালাম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে সালামের লাশ ঢাকাস্থ আজিমপুর গোরস্থানে নেওয়া হয়। সেখানে সালামের বাবা ফাজিল মিয়া, ভাতিজা মকবুল, জেঠাতো ভাই হাবিব উল্লাহসহ শত শত ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে সালামের জানাজা শেষে দাফন করা হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাষা শহীদ আবদুস সালামকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন। একুশে পদক প্রদানকালে গেজেটে তার মৃত্যুর তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারির স্থলে ৭ এপ্রিল উল্লেখ করা হয়। সেই থেকে সালামের মৃত্যুর তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ১৯৯৯ সাল পযন্ত ভাষা শহীদ আবদুস সালামের কোন ছবি কোথাও সংরক্ষিত ছিলনা। তার কারন ৬০ এর দশকে তত্কালীন স্থানীয় সংসদ জনাব খাজা আহমদ শহীদ আবদুস সালামের পিতা ফাজিল মিয়াকে দুই হাজার টাকা দিয়ে আব্দুস সালামের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি ও তাঁর দুটি আলোকচিত্র জাতীয় জাদুঘরে দেবেন বলে নিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি ছবি এবং আবদুস সালামের রক্তাক্ত শার্টটি কি করেছেন তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে বর্তমানে ব্যবহৃত শহীদ আব্দুস সালামের ছবিটি ভাস্কর রাসা উদ্দ্যেগে শিল্পী সাহজাহান আহমেদ বিকাশের মাধ্যমে তৈরী করা হয়। এই মহতী উদ্যোগ নিতে গিয়ে ভাস্কর রাসাকে বহু প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি প্রথম জানতে পারেন ভাষা শহীদ আব্দুর সালামের কোন ছবি নেই। এ কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য শহীদ সালামের পরিবার ও সরকারী প্রতিষ্ঠানের সংগে তখন তিনি যোগাযোগ করেন। তারপর থেকে তিনি চিন্তা করতে থাকেন কিভাবে শহীদের হারানো প্রতিকৃতি উদ্ধার করা যায়। এভাবে বেশ কিছু সময় চলে যায়।
১৯৯০ সালে তাঁর ছবি জোগাড়ের চেষ্টা অর্থনৈতিক কারণে পিছিয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে একটি প্রামাণ্য চিত্রের পরিকল্পনা করে তিনি তত্কালীন সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর উৎসাহ ও অর্থায়ণে ভাস্কর রাসা “অস্তিত্বের শেকড়ে আলো” শিরোনামে প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণে এগিয়ে যান এবং এ ব্যাপারে স্থানীয় জনগণ তাঁকে সহযোগিতা করেন। এ কাজে ভাস্কর রাসার অন্যতম সহযোগী ছিলেন সহকারী পরিচালক রানা সিদ্দিকী এবং স্থানীয় প্রতিনিধি শিমুল ও সমীর। বর্তমানে ব্যবহৃত শহীদ আব্দুস সালামের ছবিটি আঁকার জন্য ১৯ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ সালে শহীদের স্বজনদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। যোগাযোগ বিষয়ক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্বপ্ন দশীর’ মাধ্যমে টি,এস,সি সুইমিং পুল এলাকায় ছবি আকার অনুমতি মিলে। ২০ ফেব্রুয়ারী সকাল ১১টায় উক্ত স্থানে শহীদের ভাই-বোনদের বর্ণনা শুনে ছবি আঁকা শুরু হয় এবং দিনব্যাপি এই ছবি আঁকা চলে। এ ধরণের কর্মসূচী বাংলাদেশে এটাই প্রথম। এই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। বোন বলকিয়ত নেছা তাঁর ভাই শহীদ সালামের চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- আমরা ভাই বোনের মধ্যে সালামের গায়ের রঙ ছিল বেশ ফর্সা। ছোট বেলায় স্থানীয় মসজিদে পড়তে গিয়ে তিনি মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলেন ফলে তাঁর কপাল কেটে গিয়েছিল। সেই কাটা দাগটি তাঁ চেহারার একটি বিশেষ চিহ্ন হিসাবে থেকে যায়। যখন আব্দুস সালাম শহীদ হন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল সাতাশ বছর। শহীদ আব্দুস সালামের ভাই বোনের বর্নণা মতে শিল্পীরা তাঁর ছবি আঁকতে থাকেন। ছবি আঁকা শেষ হলে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর শহীদের ভাই বোনেরা জনশিল্পী সাহজাহান আহমেদ বিকাশের তৈল চিত্রটিকে ভাষা শহীদ আব্দুস সালামের প্রতিকৃতি হিসেবে স্বীকৃতি দেন। মহান দেশপ্রেমে অন্তঃপ্রাণ ভাস্কর রাসা ও খন্দকার জামিল ছবিটি জাতীয় যাদুঘরে দান করেন। উক্ত ছবিটি বর্তমানে জাতীয় যাদুঘরের একুশে গ্যালারীতে শোভা পাচ্ছে।

ভাষা শহীদ শফিউর রহমান

ভাষা শহীদ শফিউর রহমান ২৪শে জানুয়ারী ১৯১৮ সালে কোননগর, হুগলী, চব্বিশ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলবী মাহবুবুর রহমান। শফিউর রহমান কলকাতা গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আই.কম. পাশ করেন। তারপর চব্বিশ পরগণার সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানির চাকুরি গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালের ২৮ মে কলকাতার তমিজউদ্দিন আহম্মেদের মেয়ে আকিলা খাতুনের সঙ্গে শফিউর রহমান পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। আকিলা খাতুনের বয়স তখন ১২ বছর। শফিউর রহমানের পিতা মাহবুবুর রহমান ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা চলে আসেন। তিনি ঢাকাতে পাকিস্তান পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ অফিসে সুপারিনটেনডেন্ট পদে চাকুরি নেন। শফিউর রহমানও তাঁর পিতার সঙ্গে ঢাকা চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি পুনরায় বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ঢাকা হাইকোর্টে হিসাবরক্ষণ শাখায় চাকরি গ্রহণ করেন।

শফিউর রহমানের পাঁচ ভাই ছিল। আসজাদুর রহমান নামে তাঁর এক ভাই সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার ছিলেন। প্রতিদিনের মতো ২২ ফেব্রুয়ারী শফিউর রহমান সকাল দশটায় অফিসে রওনা হন। সেদিন পাজামা, শার্ট, গেঞ্জি এবং কোট পরেছিলেন। পায়ে ছিল জুতা। সাইকেলে তিনি অফিসে যাতায়াত করতেন। সকাল সাড়ে দশটার দিকে রাথখোলা, নবাবপুর রোডে ২১শে ফেব্রুয়ারীতে নিহত ভাষা শহীদের স্মরণে জন সমাবেশ, গণমিছিল ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ চলছিল ঐ জনসমাবেশে শফিউর রহমান ছিলেন। বিক্ষোভরত জনতার উপর পুলিশ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করতে থাকলে এক পর্যায়ে শফিউর রহমান খোশমহল রেষ্টুরেন্টের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হন। ওখান থেকে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তাঁর অস্ত্রোপচার সফল হয়নি প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় ফলে ঐ দিন সন্ধ্যা সাতটায় হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অতি কষ্টে তাঁর লাশ হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে অনেক লাশ নিয়ে যায় এবং গুম করে ফেলে। সাহিত্যিক হাবিবুর রহমানের ছেলে মাহবুবুর রহমান (মিটফোর্ডের ছাত্র) এবং আরো কয়েকজন ছাত্র মিলে শফিউর রহমানের লাশ ঢাকা মেডিক্যালের স্টেরিলাইজ ডিপার্টম্যান্টে লুকিয়ে রেখেছিল। ২২ ফেব্রুয়ারী ছিল শুক্রবার। শুক্রবার, শনিবার এবং রবিবার এই তিন দিন লাশ তারা লুকিয়ে রেখেছিল। ঢাকা হাইকোর্ট

গ্রন্থাগারের গ্রন্থাকারিক কামালউদ্দিন ঢাকার তত্কালীন এস.ডি.ও.-র নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ থেকে লাশ বের করে আনেন। প্রথমে এস.ডি.ও অনুমতি দিতে চাননি। কারণ লাশ দেওয়া হলে ছাত্ররা লাশ নিয়ে মিছিল করবে। ২৪ ফেব্রুয়ারী রাত বারোটায় আজিমপুর গোরস্থানে শফিউর রহমানের লাশ দাফন করা হয়। তাঁর গেঞ্জি ও পাজামা রক্তে এত ভিজে গিয়েছিল যে সেগুলি আজিমপুর কবরস্থানে মাটিতে পুতে ফেলা হয়েছিল। তার স্ত্রীর জমানো একশত টাকা দিয়ে কবরের জায়গা কেনা হয়েছিল। শফিউর রহমানের রক্তমাখা শার্ট, কোট, জুতা সংরক্ষণ করা হয়। বর্তমানে এগুলো বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
শফিউর রহমানের এক মেয়ে শাহনাজ এবং এক ছেলে শফিকুর রহমান। মেয়ে শাহনাজের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। মেয়েকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় তিনি মেয়ের কথা স্মরণ করেন। আহত অবস্থায় তাঁর ডাক্তার ভাইকে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে দেখো। আমি বুঝতে পারছি আমি পরিবারের কাছে আর ফিরে যেতে পারব না’। ছেলে শফিকুর রহমান তখন মায়ের পেটে। ১৯৫২ সালের মে মাসে সে জন্ম গ্রহণ করে। শহীদ শফিউর রহমানকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর একুশে পদক (২০০৫) প্রদান করেন। শহীদ শফিউর রহমানকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪


 

09
‘আমাদের টাঙ্গাইল’ ম্যাগাজিন এ প্রকাশিত
10
‘আমাদের টাঙ্গাইল’ ম্যাগাজিন এ প্রকাশিত
11
‘আমাদের টাঙ্গাইল’ ম্যাগাজিন এ প্রকাশিত
12
‘আমাদের টাঙ্গাইল’ ম্যাগাজিন এ প্রকাশিত
01
সাপ্তাহিক ‘সামাল’ এ প্রকাশিত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!