হাজারো এরশাদ শিকদারের একজন-যুবলীগ নেতা অমিত মুহুরী

অনলাইন ডেস্ক  কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

অমিত মুহুরী গভীর রাতে ফ্ল্যাটটি থেকে প্রায়ই কান্নার শব্দ শুনতে পেতেন প্রতিবেশীরা। লোকজনকে ধরে এনে এখানে মারধর করা হয়—এমন সন্দেহ করতেন তাঁরা। গত মে মাসে এক ব্যবসায়ীকে ওই ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। চাঁদার টাকার জন্য ওই ব্যবসায়ীকে তুলে এনে ফ্ল্যাটটিতে আটকে রাখা হয়। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর স্থানীয় লোকজনের আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়।

চট্টগ্রামের নন্দনকানন এলাকার হরিশ দত্ত লেনের ‘বেঙ্গল হোল্ডিং’ নামের একটি আবাসিক ভবনের ষষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাট গত মার্চ মাস থেকে ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফ্ল্যাটের ভাড়াটে অমিত মুহুরী পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তবে নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা থেকে এক কিলোমিটার দূরে এবং এনায়েতবাজার পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে বাড়িটির অবস্থান।

গত ৯ আগস্ট এই ফ্ল্যাটে অমিত নিজের বন্ধুকে মারধরের পর ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে চার দিন ধরে ফেলে রাখেন। এরপর লাশ ড্রামের ভেতর ঢুকিয়ে অ্যাসিড ঢালেন। পরে ইট, বালু, সিমেন্ট ও চুন দিয়ে ড্রামের মুখ ঢালাই করে ফেলে দেন আধা কিলোমিটার দূরের এক দিঘিতে। ওই বন্ধুর সঙ্গে অমিতের স্ত্রীর সম্পর্ক থাকতে পারে এমন সন্দেহের কারণে খুনের ঘটনাটি ঘটে বলে জানায় পুলিশ। গত ৩১ আগস্ট খুনের ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনের পর থেকে ‘টর্চার সেল’-এর বিষয়টি আলোচনায় আসে।

পুলিশ জানায়, অমিতের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির ১৩টি মামলা রয়েছে। পূর্বাঞ্চল রেলের কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে জোড়া খুনের মামলার আসামিও তিনি। ২০১৩ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় ওই দরপত্র নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক শিশুসহ দুজন নিহত হয়। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবরের অনুসারী অমিত। জোড়া খুনের মামলায় বাবরও আসামি।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালি অঞ্চল) জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, অমিত একজন ঠান্ডা মাথার খুনি। খুন করে চার দিন নিজের বাল্যবন্ধুকে ঘরে রেখে দেওয়া, অ্যাসিড ঢেলে লাশ বিকৃত করা সাধারণ কোনো খুনির পক্ষে সম্ভব নয়।

৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে নন্দনকাননের বেঙ্গল হোল্ডিং ভবনে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার পুরোটাই গাড়ি রাখার জায়গা। এর ওপরের প্রতিটি তলায় পাঁচটি করে ফ্ল্যাট রয়েছে। ভবনের মালিকসহ বাসিন্দাদের কেউ নাম উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে চাননি। নাম না প্রকাশের শর্তে দুটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বলেন, অমিতের কোমরে সব সময় অস্ত্র থাকত। ছয়তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তিনি একটি কুকুর নিয়ে নামতেন। প্রায়ই গভীর রাতে তাঁর ফ্ল্যাটে লোকজন আসত। কান্নার শব্দ শোনা যেত। সব মিলিয়ে ভয়ে থাকতেন তাঁরা।

গত মার্চ মাসে ২০ হাজার টাকায় ভবনের ছয়তলার একটি ফ্ল্যাটি ভাড়া নেন অমিত। ফ্ল্যাটের মালিক এক নারী। তাঁর বাবা মোহাম্মদ শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, অমিত শুধু এক মাসের ভাড়া দিয়েছেন। এরপর ভাড়া চাইতে গেলে তাঁকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাতেন। এপ্রিল মাস থেকে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিলও পরিশোধ করেননি।

ভবনের নিচে রাস্তার পাশের কয়েকজন দোকানদার বলেন, দোকান থেকে যখন যা ইচ্ছে, তা নিয়ে যেতেন অমিত। তাঁরা ভয়ে টাকা চাইতেন না। অমিতকে চাঁদা না দিয়ে কেউ নন্দনকানন এলাকায় ফ্ল্যাট কিনতে পারতেন না। নন্দনকানন ছাড়াও সিনেমা প্যালেস, লালদিঘীর পাড়, ডিসি হিল, রেয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় অমিতের লোকজন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলত। অমিতের ভয়ে পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ করার সাহস পেত না।

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বাইন্না পুকুরপাড় এলাকার অরুণ মুহুরীর দুই ছেলের মধ্যে অমিত বড়। ২০১০ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন। ২০১৩ সালে দরপত্র নিয়ে সিআরবি এলাকায় জোড়া খুনের পর অমিতের নাম আলোচনায় আসে।

সর্বশেষ বন্ধুকে খুনের ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে পালিয়ে যান অমিত। ২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে অমিত প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ইয়াবায় আসক্ত। তাঁর পাথরের ব্যবসা রয়েছে। কারও কাছ থেকে চাঁদা নেন না। রাজনীতি করায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। যুবলীগ নেতা বাবরের স্ত্রীকে তিনি মা ডাকেন বলে জানান।

এ বিষয়ে হেলাল আকবর চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অমিত একসময় তাঁর অনুসারী ছিলেন। কিন্তু ইয়াবা আসক্ত হওয়ায় এবং নানা অপরাধে জড়ানোর কারণে তাঁর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। দোষী প্রমাণিত হলে তিনিও অমিতের শাস্তি চান।

গত মে মাসে নন্দনকানন এলাকার এক ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর নিজের কেনা নতুন ফ্ল্যাট (অমিতের ভাড়া বাসার পাশের ভবন) সংস্কারের কাজ শুরু করলে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন অমিতের লোকজন। প্রথমে ভয়ে তিনি এক লাখ টাকা দেন। বাকি ১৯ লাখ টাকা না দেওয়ায় জাহাঙ্গীরের বন্ধু আবু সৈয়দকে গত ২৫ মে তুলে এনে মারধর করেন অমিত। সেদিন তিনি বন্ধু জাহাঙ্গীরের ফ্ল্যাটের সংস্কারকাজ দেখতে গিয়েছিলেন। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হলে অমিতের ফ্ল্যাট থেকে আবু সৈয়দকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় অমিতকে। মাসখানেক পর তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসীম উদ্দিন বলেন, অমিতের বাসাটি ছিল টর্চার সেল। লোকজনকে এনে টাকার জন্য নির্যাতন করা হতো। কিন্তু কেউ কোনো অভিযোগ না করায় পুলিশ খবর পেত না। অনেকে ভয়ে টাকা দিয়ে দিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!