রিও অলিম্পিকে ঝিনাইদহের সাঁতারু সোনিয়া

 

শনিবার জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠেছে আধুনিক অলিম্পিকের ৩১তম আসরের। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে ১৭দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই ক্রীড়াযজ্ঞে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ দলও। গলফ, সাঁতার, শ্যুটিং, অ্যাথলেটিকস ও আর্চারি এই পাঁচটি ইভেন্টে বাংলাদেশের হয়ে সাতজন ক্রীড়াবিদ নিজেদের সেরাটা দেওয়ার লড়াইয়ে নামবেন। এর মধ্যে রয়েছেন ঝিনাইদহের মেয়ে সাঁতারু সোনিয়া আক্তার।

ঝিনাইদহ শহরের হাটখোলা বাজারে পান বিক্রি করতেন আনিসুর রহমান। পানের ডালা সাজিয়ে বসে থাকতেন, মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যেত রোদ-বৃষ্টি। ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার জোগাতে কী যে কষ্ট করেছেন একসময়! এখন দিন বদলেছে। সেই হাটখোলা বাজারেই এখন বড়সড় মুদি দোকান দিয়েছেন আনিসুর রহমান। বাড়িতে উঠেছে পাকা ঘর। দুঃখ ঘুচেছে। সবই সম্ভব হয়েছে মেয়ে, সাঁতারু সোনিয়া আক্তারের সুবাদে। সোনিয়া দারিদ্র্য জয় করেছেন ‘সাঁতরে’।

মুখে সোনালি হাসি এঁকে এখন অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছেন ব্রাজিল। দারিদ্র্য আর বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে ঝিনাইদহের মেয়ে এখন রিও ডি জেনিরোতে। অলিম্পিকের ওয়াইল্ড কার্ড পাওয়ার খবরটা সোনিয়া প্রথম শোনেন গ্রামের বাড়িতে গত ঈদের ছুটি কাটাতে গিয়ে। খবরটা ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় যেন শতগুণ, ‘খবরটা শুনে ভীষণ ভালো লাগছিল। আমি ওই দিন খালাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আজই আমার ঈদ!’

sonia (1)

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিকের পুলে সাঁতরাবেন। কিন্তু অলিম্পিকটা আসলে কী সেটি বুঝতেন না ক্যারিয়ারের শুরুতে। সাঁতারে সোনিয়ার আদর্শ ডলি আক্তার। তিনবারের অলিম্পিয়ান ওই ডলি আক্তারের সুবাদেই প্রথম অলিম্পিক শব্দের সঙ্গে পরিচয় সোনিয়ার, ‘আমি ডলি আপুর ভীষণ ভক্ত। আনসারে সাঁতরানোর সময় ডলি আপু আমাকে শুধু অলিম্পিকের গল্প শোনাতেন। এসব শুনে নিজেকে নিজে বলতাম, একদিন আমিও অলিম্পিকে সাঁতরাব।’ তবে টেলিভিশনে গত লন্ডন অলিম্পিকে সতীর্থ সাঁতারু মাহফিজুর রহমানকে দেখে আগ্রহটা বেড়ে যায় ভীষণ। অবশেষে সোনিয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। সোনিয়ার মূল ইভেন্ট ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইল, আর তাতে তাঁর ক্যারিয়ার-সেরা টাইমিং ৩০.৮৬ সেকেন্ড। যেটি করেছেন গত বছর রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে। ব্রাজিলে নিজের সেরা টাইমিং করতে চান সোনিয়া, ‘যেভাবে অনুশীলন করছি তাতে আশা করি নিজের আগের সেরা টাইমিং টপকে যেতে পারব।’

বাড়ির পাশে নবগঙ্গা নদী। চাইলে সেখানে সাঁতরাতে পারতেন সোনিয়া। কিন্তু সাঁতারের শুরুতে অনুশীলনের জন্য ছুটে যেতেন মাইল খানেক দূরের ধুপাঘাটা ব্রিজের কাছে।

বড় ভাই সাঁতার শিখতেন ‘জাহিদ স্যারের’ কাছে। ছোট বোন সোনিয়াও বায়না ধরেন সাঁতার শেখার। বায়না মেটাতে ভাই বোনকে নিয়ে যান কোচের কাছে। ২০০৩ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ডের হয়ে বয়সভিত্তিক সাঁতার দিয়ে শুরু সোনিয়ার। জুনিয়রে অংশ নিয়ে ২০০৬ সালে জেতেন ১১টি সোনা, ২টি ব্রোঞ্জ। আর ২০১০ সালে ১১টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ১০টিতেই জেতেন সোনা। এর মধ্যে ৯টিতে ছিল জাতীয় রেকর্ড। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে এমন সাফল্যই তাঁকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

সোনিয়ার বাড়ি ঝিনাইদহ শহরের পাশে ভুটিয়ারগাতি গ্রামে। ওই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই রক্ষণশীল। সোনিয়া ওই গ্রামেরই মাদ্রাসায় আলিম পড়ছেন। অনুশীলনের শুরুতে ‘ইভ টিজিংয়ের’ শিকার হয়েছেন যে কত, ঠিক নেই। প্রতিবেশীরা সোনিয়ার বাবাকে ডেকে বলত, ‘মেয়ে মানুষ সাঁতার শিখে কী হবে?’ কিন্তু বাবা কখনোই মেয়েকে বাধা দেননি। ঝিনাইদহের নবগঙ্গা সাঁতরানোর পর মাতিয়েছেন মিরপুরের জাতীয় সাঁতারপুল। এত দিন বাংলাদেশ আনসারের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, এ বছর স্থায়ী চাকরি পেয়েছেন নৌবাহিনীতে।

সোনিয়া প্রথম আন্তর্জাতিক মিটে অংশ নেন সিঙ্গাপুরে ২০১০ যুব অলিম্পিক গেমসে, ২০১১-তে যুক্তরাজ্যের আইল অব ম্যানে অংশ নেন কমনওয়েলথ যুব গেমসে। এরপর সাঁতরেছেন ২০১৪ কাতার বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ ও ২০১৫ কাজান বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে। বিশ্ব ফুটবলের বড় তারকা ব্রাজিলিয়ান নেইমারকে ভীষণ পছন্দ। নেইমারের দেশে অলিম্পিকে যাওয়ার রোমাঞ্চে রাতের ঘুমই যেন চলে গেছে সোনিয়ার!

সোনিয়া আক্তার, সাঁতারু
জন্ম: ১৫ জুলাই, ১৯৯৭
জন্মস্থান: ঝিনাইদহ
সংস্থা: বাংলাদেশ নৌবাহিনী
ঘরোয়া সাফল্য : ৯৫ পদক (৬৭ সোনা, ২৩ রুপা, ৫ ব্রোঞ্জ)
আন্তর্জাতিক সাফল্য: ৭ পদক (১ সোনা, ২ রুপা, ৪ ব্রোঞ্জ)

sonia

সেরা টাইমিং: ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে ৩০.৮৬ সেকেন্ড

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!