বিচার ও নির্বাহী বিভাগ : সংকটটা কৃত্রিম

বিচার ও নির্বাহী বিভাগ : সংকটটা কৃত্রিম

————————————রণেশ মৈত্র(সভাপতি মন্ডলীর সদস্য-ঐক্য ন্যাপ)

যখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার রায় হাইকোর্ট প্রকাশ করেন- সংকটটার সৃষ্টি প্রধানত: তখন থেকেই। সংসদে তা নিয়ে শুরু হয় উত্তপ্ত আলোচনা সমালোচনা। রায়ের সমালোচনা ছিল তীব্র। যেন বিচার বিভাগ সংসদের সাবভৌমত্ব ক্ষুন্ন করেছে তাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। সে জন্যে প্রতিপক্ষ বানানো হলো বিচার বিভাগকে। তাই সরকার পথ বেছেনিলেন সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের ঐ রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের পথ। দায়ের হলো আপীল। তার পূর্ণাঙ্গ শুনানী হলো দীর্ঘদিন ধরে। উভয় পক্ষের নিয়োগ করা আইনজীবীরা ছাড়াও এতে দশজনের ও অধিক অভিজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞকে এমিকাস কিউরী হিসাবে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আদালতকে সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিতে পরামর্শ দেওয়ার লক্ষ্যে। আদালত এই শুনানীর এবং বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে গঠন করলেন সাতজন বিচারক মিলে প্রধান বিচারপতির নেতেৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। সকল আইনজীবীর বক্তব্য এবং পরামর্শ শুনানী শেষে সর্বসম্মত রায় দিলেন তাঁরা। রায়ে হাইকোটের্র রায়কেই বহাল রাখা হলো। পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে দেরী হয়। আর এই রায় ৭৯৯ পৃষ্টার- সুতরাং দেরী তো হবারই কথা। অবশেষে ১লা আগস্ট পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হলো যা আমরা জানতে পারলাম সংবাদপত্র মারফত পরদিন। রায়ে হাইকোর্ট ইতোপূর্বে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার আদেশটি বহাল রেখে কতকগুলি মন্তব্য প্রকাশ করেন। আপাত:দৃষ্টিতে মন্তব্যগুলি রীটের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কহীন বলে মনে হয়। ঐ মন্তব্যগুলিতে দেশের বিরাজিত রাজনৈতিক, সংসদীয়, সাংস্কৃতিক নানাবিধ পরিস্থিতির উল্লেখ করা হয়েছে। শাসকদল এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে টার্গেট করেছে প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহাকে। প্রথম দিকে এই বিষয় নিয়ে সরকারী দলের কেউই মন্তব্য করেন নি বরং সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বলা হয়েছে সরকার বিষয়গুলি পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হলেই কেবল তাঁদের মতামত জানা যাবে এবং তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। এই অভিমত সুবিবেচনা প্রসূত ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে মন্ত্রীসভার প্রবীনতম সদস্য অথর্মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলে বসলেন, “ সুপ্রিম কোর্টের এ রায় আমরা মানি না-মানবো না। সংসদে আবারও আমরা ঐ সংশোধনী পাশ করবো দেখি জুডিশিয়ারীর শক্তি কত। আমরাই তো তাদের নিয়োগ দেই।”
অথর্মন্ত্রীর এই মন্তব্য অত্যন্ত অনাকাংখিত এবং সকল প্রকার শালীনতা বর্জিত। তাঁর মত সিনিয়র এবং দায়িত্বশীল মন্ত্রী এবং প্রবীন রাজনীতিকের কাছ থেকে এ জাতীয় অশোভন বক্তব্য কেউ আশা করেনি। কিন্তু সরকারী দল যেন এতে আরও অনেক বেশী উৎসাহিত হলো এবং তার পরে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যাপক আলোচনার পর সকলে সাধ্যমত বক্তব্য দিয়ে ঐ রায়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হলো। শুরু হলো একতরফা যুদ্ধ-বাজতে থাকলো তার দামামা। মন্ত্রীসভার ছাড়পত্র পাওয়ার পর থেকে ক্রমাগতভাবে বিভিন্ন মন্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে রায়, আদালত ও বিচারকদের, বিশেষ করে প্রধান বিচারকের বিরুদ্ধে তীব্র বিশোদগার করে যাচ্ছেন যা অনভিপ্রেতই নয় শুধু রাজনৈতিক আকাশে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও রুচিবোধে তা মারাত্ত্বকভাবে আঘাত হেনে চলেছে। অপরপক্ষে বিএনপি এই রায়কে আওয়ামীলীগ বা সরকার বিরোধী প্রচারণার এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে যার ফলে সরকারী মহলে তা আরও অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। সরকার পক্ষের এ ব্যাপারে দুটি মন্তব্য চোখে পড়েছে। প্রথমত: যেহেতু বিএনপি রায়ের মন্তব্য অংশ অতি উৎসাহ দেখিয়ে আওয়ামীলীগের সরকারে থাকার নৈতিক অধিকার নেই বলে বলছে তাই তারা ইংগিতে প্রধান বিচারককে বিএনপি জামাত সমর্থক (উনি কাদের লোক তা আমরা জানি”) বলে ইঙ্গিত করতে দ্বিধান্বিত বোধ করছেন না। দ্বিতীয়ত: বিএনপিকে লক্ষ্য করে সরকার পক্ষ বলছেন, আদালত বা কোন অদৃশ্য শক্তি এসে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে এমন আশা যেন তারা না করে। তাই রাজনীতির বাজার অকর্স্মাৎ এর রায়কে কেন্দ্র করে অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বুঝতেই পারছে না সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অনুকুলে বা প্রতিকুলে যে দিকেই হোক আওয়ামীলীগ বা বিএনপি কেউই লাভবান হবে না ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গণতন্ত্র বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে আমাদের লুপ্ত প্রায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবশেষ টুকুও। তদুপরি, উভয় পক্ষে এহেন বাক বিতন্ডায় আদালতের ক্ষতি যে অশ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটছে-তাতে আদালতের ভাবমুর্তিও ক্ষুন্ন হতে চলেছে। এর পরিণতি কারও জন্যই শুভ হতে পারে না। এমন কি আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের জন্যও এহেন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি মারাত্বক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। সুতরাং সাধু সাবধান। কিন্তু এহেন ক্ষতিকর পরিস্থিতি দিব্যি এড়ানো যেত যদি সকলেই আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নীরবে রায়টি বাস্তবায়ন করতেন ও সেই লক্ষ্যে বিএনপি ও চুপচাপ থাকতো। কিন্তু এই দুটি দলের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এতটাই তীব্র যা সকল রুচি ও সংস্কৃতি বা নিষ্টাচারের পরিপন্থী। জনমতকে বিভক্ত করতে, মানুষকে দল বাজি করাতে উসকানি দিতে এবং জাতিকে অনৈক্যের আঘাতে দুর্বল করতে এরা বড্ড বেশী সেয়ানা। মানুষের মধ্যে যদি এভাবে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব ও বিচার বিভাগ সম্পর্কে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি হয় তা যে কোন তৃতীয় অরাজনৈতিক অণ্দাকরের শক্তিকে ডেকে
আনার পথকে প্রশস্ত করতে এবং গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে রুদ্ধ করে দিতে পারে সেই চেতনা বোধও যেন তাঁরা হারাতে বসেছেন। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলিকে দিব্যি ভুলে গেলেন তাঁরা। কিন্তু বিচার বিভাগের সাথে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব বস্তুত: ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে এমনও নয়। মাসদার হোসেন মোর্কমার রায়ে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভর করার যে চূড়ান্ত ও আবশ্য পালনীয় নির্দেশিকা দেওয়া হয় কার্যত: আজতক তার মৌলিক বিষয়গুলি সরকার কার্য্যকর করে নি। কিন্তু বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন এই কথা কটি বলার ব্যাপারে সরকার ও সরকারী দল সর্বদাই উচ্চকণ্ঠ। তদুপরি অধ:স্তন বিচারকদের (বিভিন্ন আদালতের) নিয়োগ, বদলি, বেতন ভাতা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা সরকার তার হাতে রাখতে সর্বপ্রযত্বে সচেষ্ট। এবং সে কারণেই-এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশের বিষয়টির কিছুতেই নিষ্পত্তি হচ্ছে না। অন্তত: দুটি বছর ধরে এ ব্যাপারে সরকার পক্ষ নানা অজুহাতে সময় নিয়ে চলছেন। সর্বশেষ তাঁরা ছয় সপ্তাহের লম্বা সময় পেয়েছেন। এই সময়েও কাজটি হবে কিনা তা নিয়ে সকল মহলেই বিস্তর সংশয় রয়েছে। এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি এবং এটর্নী জেনারেলের মধ্যে বাক বিতন্ডা সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। বিচারবিভাগের জন্য পৃথক সেক্রেটারিয়েট গঠন আজও সুদূর পরাহত। বিচার বিভাগ পরিচালনায় স্বার্বিক বিষয়টিকে গন্য করে খো হচ্ছে। এ বাবদ বাজেট বরাদ্দ প্রতি বছরই কমানো হচ্ছে- যদিও তা বিপুলভাবে বৃদ্ধি করা দরকার। লক্ষ লক্ষ মামলার জট সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্য্যন্ত এক মারাত্বক সমস্যা হিসেবে বিরাজ করলেও এ সমস্যা সমাধানের জন্য যে সর্বস্তরের আদাল গুলিতেই বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশী করা প্রয়োজন তা জেনেও সরকার বিষয়টিকে অবহেলার চোখেই দেখে চলেছেন। আইন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধত্বের পরিচয় দিয়ে মামলার জটের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষের সমস্যা বাড়িয়েই চলেছে। সুপ্রিম কোর্ট ভবনসহ দেশের প্রায় সকল আদালতের জন্যেই নতুন নতুন ভবন নির্মাণ ও পুরাতনভবনগুলির প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়টি ও অবহেলিত। আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে এবং উপযুক্ত বাজেট বরাদ্দ পাওনা গেলে প্রধান বিচারপতি এবং সংশ্লিষ্টরা দিব্যি এ সকল বিষয়ের সুরাহা করতে পারতেন অনেক আগেই কিন্তু তা না করে তাঁকে অনেকটা ঠুঁটো জগন্নাত করে রাখা হয়েছে যা পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশেই দেখা যায় না। বিচার বিভাগের চাওয়াটা এক কথায় কি ? নির্মোহ চিত্তে বিষয়টি সকলকে ভাবতে অনুরোধ জানাবো। বিচার বিভাগ চাটছে এবং বিচারকেরা বারংবার নানাভাবে বলে চলেছেন তাঁরা চান বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ এবং অথর্বহ স্বাধীনতা। তাই তাঁরা যেমন তাঁদের বিচারকার্য্যে অন্য কারও বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ চাল না (যা আমাদের বহু সাংসদ ও তাঁদের অনুগ্রহ ভাজনের নিজ
নিজ এলাকায় হামেশাই ঘটিয়ে থাকেন), তেমনি বিচার বিভাগের নিয়োগ, বদলি, শাস্তি, প্রমোশন, বেতন স্কেলের হ্রাস-বৃদ্ধি, বিচারালয় সমূহের আধুনিকীকরণ, উর্ধ ও অধ:স্তন বিচারকদের প্রশিক্ষণ প্রভৃতি পরিচালনার পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব। কারণ এ ক্ষমতাগুলি না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ক্রমাগত বাজেট বরাদ্দ হ্রাস, বিচারকের নিয়োগ ঝুলিয়ে রেখে অহেতুক মামলাজট আরও বৃদ্ধি করা, সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয় প্রতিষ্ঠা না করা-ইত্যাদির দ্বারা সরকার বুঝাচ্ছেন তাঁরা ও গুলি করতে আগ্রহী নন। কেন ? বিচার বিভাগকেও তাঁরা ঊীবপঁঃরাব এবং ……… বিভাগ দুটির অধিনস্থ করে রাখতেই চান সংসদের সার্বভৌমত্বের নামে এবং বিচার বিভাগের জবাবাদিহিতার প্রতিষ্ঠার নামে। অপরদিকে বিচার বিভাগ কিন্তু শিক্ষা বিভাগের, প্রশাসন বিভাগের, কৃষি বিভাগের শিল্প বাণিজ্য বিভাগের বা অপর কোন বিভাগের উপর বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করেন না বা করতে চান ও না। শুধুমাত্র যে কোন মহল আইন ও সংবিধান বিরোধী কোন কিছু করলে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে অভিযুক্তের আতœপক্ষ সমর্থনের পরিপূর্ণ সুযোগ দিয়ে অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হলে তখনই মাত্র আইনগত ভাবে হস্তক্ষেপ করে যাকেন। যেমন তাঁরা করেছেন দু’জন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। কিন্তু সংসদ ঐ মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয় নি যদিও সবাই স্বীকার করেন যে আদালত কাউকে শাস্তি দিলে তারা আর মন্ত্রীত্বে থাকার বা তাকে মন্ত্রীপদে রাখার কোন নৈতিক অধিকার থাকে না। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো সংসদ বা মন্ত্রীসভা সেজন্য ঐ দুজন মন্ত্রীকে সামান্যতম দু:খ প্রকাশ করে নি। তাদেরকে দিব্যি আশ্রয় দিয়ে রাখা হয়েছে পূর্ণ মর্যাদায় আমাদের মন্ত্রীসভায়। আমরা দেখি ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচন দিব্যি আইনগত ও নীতিগত বৈধতা পেয়ে গেল। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী ঐ নির্বাচন অবশ্যই বাধ্যতামূলক ছিল কিন্তু বিএনপিসহ বহু বিরোধীদল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতিরেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না এমন বক্তব্য দিয়ে নির্বাচন বর্জন করায় তাদেরকে বাদ দিয়ে নির্বাচন যথাসময়ে করা হয়েছে। এটাও মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু সেই নির্বাচনের পর সরকারীভাবে বলা হলো যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য অন্যদেরকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে হয়েছে তবে শীঘ্রই এ সংসদ বাতিল করে নতুন নির্বাচন দেওয় হবে কিন্তু তা আজও দেওয়া হয় নি। ফলে ১৫৪ জন সাংসদ নজীরবিহীনভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও এবং অপর আসনগুলিতেও অতি সামান্য সংখ্যক ভোট পড়লেও দিব্যি ঐ সংসদকে পূর্ণ মেয়াদে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে ও বহাল রাখা হচ্ছে। নির্বাচন ও নৈতিকতার এ সকল নমুনা দেখে আমাদের সম্পর্কে আমাদের গণতন্ত্র সম্পর্কে দেশ-বিদেশের ক্ষতি নিয়ে কি আমাদের সরকার অনুকূলে ? বিচার বিভাগ এ নিয়ে মন্তব্য করায় তার দায়িত্ব পালিত হয়েছে মাত্র। তেমনই তাঁরা অতীতের নির্বাচন কমিশনগুলির মেরুদন্ডহীনতার দিকে অঙ্গুলি হেলন করেও যথার্থ কাজই করেছেন-এমনটা বলতে আপত্তি কেন? কারণ নির্বাচন যদি একতরফা হয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা তাতে শুদ্ধ হয়ে যায়-এটিই হলো সর্বজন গৃহীত মত। কারণ যে বনগণের রাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং যে জনগণ রাষ্ট্রটির মালিক নিশ্চিতভাবেই নির্বাচনে সেই জনগণকে প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক নির্বাচন উপহার দিতে হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্য থেকে স্বাধীনভাবে তাঁদের একজন নিরাপদে নির্বিঘেœ ভোট প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধান ও এমন নির্বাচনের বাধ্যবাধকাত নিশ্চিত করতে চায়। তবে একটি অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বঅচন অনুষ্ঠিত হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো এমন ভাবনাও সঠিক নয়। গণতন্ত্র একটি ব্যাপক বিষয় নির্বাচনের মাধ্যমে যার প্রারম্ভিক সূচনা মাত্র। অথর্বহ গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচিত সাংসদদের মূখ থেকে অবাধে জনগণের কথা চিন্তা ও দাবীসমূহ প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে এবং সে কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ যে ভয়াবহ বাধা সৃষ্টি করেছে তা সঠিকভাবেই রায়ের পর্য্যবেক্ষণে বিচারকবৃন্দ তুলে ধরেছেন। জনগণের সার্বভৌমত্বে বিশ্ববাসী হলে সরকার অত:পর নিদ্বিধায় ঐ বিধানটি তুলে দেবেন এমন প্রত্যাশা নেহায়েতই যৌক্তিক। সার্বভৌমত্ব সংসগের নয় জনগণের। মাননীয় প্রধান বিচারকের চাকুরীর মেয়াদ সম্ভবত: আর মাত্র ছয় মাস সম্ভবত: ২০১৮ সালের জানুয়ারী অথবা ফেব্রুয়ারিতেই তিনি অবসরকালীন ছুটিতে যাবেন। প্রকাশের কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পর থেকে এ যাবত যে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ দেখা যাচ্ছে ঐ রায় ও তার পর্য্যবেক্ষণগুলিকে কেন্দ্র করে তাতে ভয় হয় তিনি অপসারিত না হলেও হয়তো তিনি পদত্যাগ করে চলে যাবেন এমন ঘটনা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিরই সৃষ্টি করা হচ্ছে যেন। বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ এর সম্পর্কের নজীর বিহীন টানা পোড়েন আজ এতটাই নগ্ন ভাবে দৃশ্যমান তাতে ভয় হয় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সুদীর্ঘ লড়াই ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হতে চলেছে কি? সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক তাঁর দলীয় মনোভাব অবহিত করতে সংবিধানের দুই অভিভাবক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির কাছে যাবেন এবং প্রধান বিচারপতি তাঁর সাথে প্রায় দুই ঘন্টা ব্যাপী আলাপ আলোচনা করবেন এবং তিনি প্রধান বিচারপতিকে দলীয় অভিমত অবহিত করার পর নৈশভোজে আপ্যায়িত হবেন এমনটা কদাপি প্রত্যাশিত ছিল না কদাপি এমনটি ঘটতে অতীতে দেখাও যায় নি। এটি সম্পূর্ণ নজিরবিহীন। কিন্তু তার পরেও একের পর এক মন্ত্রীরা ঐ রায় ও পর্য্যবেক্ষণ সম্পর্কে প্রকাশ্যে যে ভাবে বিরতিহীনভাবে বিরূপ মন্তব্য করে চলেছেন আইনের শাসনে বিবেকবান মানুষমাত্রই তাতে সংকিত বোধ করছেন। সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির সাথে বঙ্গভবনে গিয়ে সাক্ষাত করলেন প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও এটর্নী জেনারেল এক সঙ্গে এটা ঐ রায় ও তার পর্য্যবেক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করলেন এতে আতংকই আরও বৃদ্ধি পায় মাত্র। কারণ এমনটা কদাচি ঘটতে দেখা যায় নি। আইনমন্ত্রী আবার বলেই ফেললেন প্রধান বিচারকে অসদাচরণ করেছেন কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অপর আইন কমিশনের চেয়ারম্যানও মাঠে নামলেন ঐ রায়, তার পর্যবেক্ষণ এবং প্রধান বিচারকের প্রতি অসম্মান সূচক মন্তব্য করতে। যদিও তিনি বলেছেন একমত না হলেও আমরা সবাই এ রায় মানতে বাধ্য। কিন্তু যখন তিনি রায়ের ও পর্য্যবেক্ষনের ভাষাকে বিচারিক ভাবে নয় বলে মন্তব্য করেন তখন প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। ততোধিক মারাতœক কথা তিনি বলেলেন দ্বিধাহীনভাবে যে “রায়টি বিদ্বেষ প্রসুত হলে তা শপথ ভঙ্গ করার সামিল হবে। তাই এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার”। ইঙ্গিতটি তাহলে কি এমন নয়- যে বিদ্বেষপ্রসূত রায়” বলে দাঁড় করাতে পারলে সে রায় বাতিল এবং প্রধান বিচারকের অপসারণ উভয় ব্যবস্থাই নেওয়া যেতে পারে অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারার পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু এগুলি কি আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের আওতাধীন বক্তব্য ? সাধারণ জ্ঞানে বুঝি সচেতন এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে তিনি আদালত অবমাননা করে চলেছেন এবং তা করছেন বিদ্বেষ প্রসূতভাবে ও মহল বিশেষকে মুষ্ট করার অসৎ অভিপ্রায়ে। আবার খাদ্য মন্ত্রী বলে বসলেন, এস.কে সিনহাকে “রাজনৈতিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন করতে কৌতুহল জাগে কোন দলের সরকার এমন কাজটি করেছিল? যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তিনি কি সেই দলের সদস্য ছিলেন ? নিয়োগের উদ্দেশ্য কি ছিল যে তিনি ঐ দলের নির্দেশ অনুযায়ী বিচার কাজ পরিচালনা করবেন ? সাক্ষতেও কি তাই ছিল? ষোড়ষ সংশোধনী বাতিলের রায়ে তিনি কি তাঁর সেই অঙ্গীকার পূরণ করেছেন না কি সেই অঙ্গীকার পালন না করে নৈতিক অপরাধ করে বসেছেন ? মন্ত্র মহোদয় বিষয়গুলি স্পষ্ট করে জনগণকে জানালে কৃতার্থ হবো। না কি তিনি তাঁকে প্রদত্ত শাস্তির (এবং আরও একজন মন্ত্রীর) বিরুদ্ধে সুযোগ বুঝে ঝাল ঝাড়লেন? এবারে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে আসি। এটিই সমালোচকদের আর একটি মোক্ষম অস্ত্র বলে মনে হচ্ছে। রায়ের পর্য্যবেক্ষণটি পূবাপর পাঠ করা প্রয়োজন। অকস্মাৎ একটি ক্ষুদ্র বাক্য বা তার বাছাই করা কয়েকটি শব্দ তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা করা হয়েছে জাতীয় গুরুতর অভিযোগ আমলে তাকে কেউই সঠিক মনে করতে পারেন না ধোপেও টিকবে না তেমন অবাস্তাব অভিযোগ। সাময়িকভাবে মানুষের মনে কিছুটা আবেগ ও কিছুটা উম্মাদনা সৃষ্টি করা যেতে পারে। আখেরে তাতে কারও কোন লাভ হয় না। বিচার বিভাগ বা প্রধান বিচারক সম্পর্কে খানিকটা বিভ্রান্তি বাড়ানো যেতে পারে মাত্র। মুক্তিযুদ্ধ কার্যত: বঙ্গবন্ধুর আহবানে, তাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে, অপর সামরিক বেসামরিক নেতৃত্বের সক্রিয় পরিশ্রমে ও অংশগ্রহণে, কোটি কোটি বাঙালির মরণপণ লড়াইয়ে এবং দেশী বিদেশী বহু রাষ্ট্রের নৈতিক ও বৈষয়িক সহযোগিতায় সংঘটিত হয়। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বস্তুত:ই একক কারও দ্বারা সম্পন্ন হয় নি কোথাও তা বাস্তবে হতেও পারে না। তবে বঙ্গবন্ধুর বীরত্বপূর্ণ আহবান মানুষকে আলোড়িত করেছিল আন্দোলিত করেছিল গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং তাঁর অন্যান্য অবদান প্রশ্নাতীত। কেউ তা নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলেন ও নি। জনগণের ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রতিও রায়ে প্রপ্রভাবান্তরে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এখানে কেউ ভুল ব্যাখ্যা করলে বা এতে কেউ বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার অভিযোগ তুললে তা হবে নিতান্তই উদ্দেশ্যমূলক। ক্ষমতাসীন অনেকে আরও বলছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে অতীতের সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের বে-আইনী সংশোধনী পুন:স্থাপন করে গণতান্ত্রিক বিধানটির অমর্য্যাদা করা হয়েছে। এখানে সাম্প্রতিক অতীতের কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। হাইকোর্ট একটি রিটের রায়ে জিয়ার পঞ্চম সংশোধনী এবং এরশাদের অষ্টম সংশোধনী বাতিল করলেন। অষ্টম হলো সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট হাইকোটের্র রায় বহাল রাখলেন। ফলে বিসমিল্লাহ ও জামায়াতসহ ধর্মাশয়্রী দলগুলি চিরতরে বে-আইনী হলো এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বে-আইনী ঘোষিত হলো। জিয়া এরশাদের ক্ষমতা দখল সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষিত হলো। জনগণ এই ঐতিহাসিক রায়কে অভিনন্দন জানালেন। রায়ে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানকে একমাত্র বৈধ সংবিধান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার পুনরুজ্জীবন ঘটালো। এরপর সরকার কি করলো? সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগটির অপব্যবহার করে সংবিধানের কুখ্যাত পঞ্চদশ সংশোধনী এনে ঐ রায় উপেক্ষা করে জিয়ার বিসমিল্লাহ পুন:স্থাপন, জামায়াত ও ধর্মাশয়্রী দলগুলি ও তাদের রাজনীতিকে বৈধতা প্রদান ও এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকেও পুন:স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের চেনা ও বঙ্গবন্ধুর আদলের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন ও জিয়া এরশাদের ক্রিয়াকলাপকে মহিমাম্বিত করা হলো। আজও তা অব্যাহত। তদুপরি বে-আইনী ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদকে রাষ্ট্রীয় পদ প্রদান ও তার দলকে সরকারি দলের সঙ্গী বানিয়ে সংসদ ও মন্ত্রীসভায় মর্য্যাদা কর স্থান দেওয়া হলো। এই ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে সরকার এক আদৌ সামরিক শাসকদের প্রতি মর্য্যাদা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শদ্ধ্রাশীলতা প্রদশর্ন করলেন?


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!