‘সাধারণ মানুষ এগোয়, রাজনীতিকরা টেনে ধরে’-ড. আকবর আলি খান

 

ড. আকবর আলি খান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। লেখক, গবেষক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সম্প্রতি রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন, ব্যাংক ব্যবস্থা, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। দীর্ঘ আলোচনায় গুরুত্ব পায় রোহিঙ্গা ইস্যুও।

প্রশ্ন: আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আলোচনায় ফের উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। রাজনীতির সকল আলোচনা এখন নির্বাচনকে ঘিরেই। আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
ড. আকবর আলি খান: আমরা সংঘাতময় রাজনীতির মধ্যেই ছিলাম। এখনও সে পরিবেশ তিরোহিত হয়নি বলে মনে করি।
তবে বড় দু’টি দল থেকে নির্বাচনে আগ্রহ দেখানোর পর, অন্তত কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এতে উভয় তরী উপকৃত হবে বলে মনে করি। আশা জাগিয়েছে দু’দলের নির্বাচনমুখী রাজনীতি।
প্রশ্ন: সরকার পক্ষের তরী তো তীরেই আছে…
ড. আকবর আলি খান: ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং পরে স্থানীয় নির্বাচনগুলো যথেষ্ট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ওই নির্বাচনে স্বচ্ছতার অভাব আছে, তা সরকার দলও বিশ্বাস করে। এই প্রশ্ন থেকে সরকারি দল মুক্তি চায়।
অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি যে ফল ভোগ করছে, তা থেকে এ দলটিও মুক্তি চায়।
আর এমন প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতি, নির্বাচন থেকে মুক্তি চায় বলেই দুই দলই নির্বাচন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাতে চাইছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলে কি হবে, তা নিয়ে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয় বলে মনে করি। নির্বাচনের আগ মুহূর্তেও পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত রাজনীতি আশাব্যঞ্জক বলে বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন: নির্বাচন কমিশন দৃশ্যমান উদ্যোগ নিচ্ছে। সংলাপের আয়োজনও করল। এই উদ্যোগও আশাবাদীর কারণ হতে পারে কিনা?
ড. আকবর আলি খান: সরকার না চাইলে নির্বাচন কমিশন কিছুই করতে পারবে না। বাংলাদেশে সে ধরনের নির্বাচন কমিশন গঠন হয়নি।
যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন হয় এবং কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই।
প্রশ্ন: পাশের দেশ ভারতে তো নির্বাচন কমিশনেই মানুষের অধিক আস্থা…
ড. আকবর আলি খান:  সে দেশের নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। ভারতে দেশের নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা। তারা অত্যন্ত মেধাবী এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধ বলে প্রমাণিত।
ভারতের ফেডারেল সরকার নির্বাচনের জন্য বিশেষ সহায়ক। এরপর ভারতের বিচার বিভাগ কার্যকর রয়েছে। এ কারণেই ভারতে নির্বাচন নিয়ে বিশেষ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, যা বাংলাদেশে হয়নি। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন চাইলেই সব ঠিক হবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। যদি অন্যান্য উপাদান সহায়ক হিসেবে না থাকে।
প্রশ্ন: নির্বাচন কমিশন নিয়ে আশার কথাও তো আছে।  আপনারা যখন  তত্তা¡বধায়ক সরকারে ছিলেন, তখন তো গতি এসেছিল কমিশনে। মানুষ আস্থাও পেয়েছিল।
ড. আকবর আলি খান: দলীয় সরকার আর তত্ত্বাধায়কের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন যে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পেরেছে, দলীয় সরকারের অধীনে তা পারেনি কোনো নির্বাচনেই।
প্রশ্ন: তাহলে আগামী নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে?
ড. আকবর আলি খান: এমন রাজনীতি থেকে মানুষ মুক্তি চায়, এটিই আশার কথা। শেষ পর্যন্ত কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে, তা বলা যাবে না। রাজনীতি নির্বাচনমুখী হচ্ছে, তা বলা যেতেই পারে।
প্রশ্ন: সাধারণ মানুষ রাজনীতির এমন পরিস্থিতি কীভাবে দেখছে বলে মনে করেন?
ড. আকবর আলি খান: সাধারণ মানুষ রাজনীতি নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে শুধু নির্বাচন ব্যবস্থাই যথেষ্ট না।
বাংলাদেশে যে ধরনের শাসন ব্যবস্থা বিরাজমান, তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার ব্যাপার রয়েছে।
প্রশ্ন: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই তো রয়েছে বাংলাদেশে এবং সেটাই উত্তম শাসন ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়।
ড. আকবর আলি খান: বাংলাদেশে বর্তমানে পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজমান। পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জালিয়াতি বেশি হয়। নির্বাচনে কোনোভাবে একটি ভোটের ব্যবধানে একজনকে পাশ করিয়ে এনে সংসদে বসাতে পারলে, সে-ই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। এ কারণে নির্বাচনে যেতার জন্য যে কোনো পন্থাই অবলম্বন করতে চায় রাজনীতিকরা।
প্রশ্ন: আপনি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
ড. আকবর আলি খান: শাসন ব্যবস্থায় সব মানুষের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তবে সেটা গ্রিসের এথেন্স নগরেই সম্ভব ছিল। এথেন্সে অধিকাংশ মানুষই দাস ছিলেন এবং তাদের ভোটাধিকার ছিল না। যারা ভোটে অংশ নিতেন তারাই রাজ্য শাসন করতেন।
এটি তো এখন সম্ভব না। তবে কয়েকটি উপাদান যদি আমরা যুক্ত করি, তাহলে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু করা সম্ভব বলে মনে করি। এর মধ্যে গণভোট ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। গণভোট ব্যবস্থা থাকলে জনগণ যেকোনো সময় সরকারের প্রতি আস্থা-অনাস্থা প্রকাশের সুযোগ পেতে পারেন। এখনও ষাটেরও অধিক দেশে গণভোট প্রচলিত আছে। ব্রেক্সিট হলো গণভোটের মাধ্যমেই।
এরপর আমি মনে করি, নির্বাচন আনুপাতিক হারে হওয়া উচিত। এতে হয়তো কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। বাধ্য হয়ে হয়তো আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করত। এই ধরনের সরকার একবার গঠন হলে, রাজনৈতিক বিদ্বেষ অনেক কমে যাবে। ইউরোপে অনেক দেশেই কোয়ালিশন সরকার আছে।
প্রশ্ন: এমন সরকার প্রত্যাশা করা যায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে?
ড. আকবর আলি খান:  না। আপাতত এমন সরকার কোনোভাবেই প্রত্যাশা করা যায় না। কারণ বাংলাদেশের মানুষেরাই তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার না।
তবে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত। সম্প্রতি একটি বইয়ে এমন বিতর্ক নিয়ে বিস্তারিতভাবে লিখেছি। আমার যে মত সেখানে প্রকাশ করেছি এবং সেটাই যে প্রতিষ্ঠা পাবে তা নয়। তবে আমি মনে করি, এই বিতর্ক নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। আলোচনা হলেই সংস্কারের পথ বেরুবে।
সংস্কারের জন্য জনমত তৈরি করার প্রয়োজন রয়েছে এবং সেটা অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব বলেও মনে করি না।
তবে সময় লাগলেও নিরাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা টেকসই পাবে না।
প্রশ্ন: এই ভরসা পাচ্ছেন কোত্থেকে?
ড. আকবর আলি খান: বাংলাদেশের মানুষ ব্রিটিশ বা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধেই যে আন্দোলন করেছে, তা নয়। ১৩০০ বছর আগে এই বাংলায় পাল বংশের প্রথম সম্রাটকে জনগণ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ওই সময় রাজাকে বলতে হবে যে, জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছে। নির্বাচনের প্রতি ঝোঁক এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের এই ইতিহাস হাজার হাজার বছরের।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক দুর্বলতা আছে। এটি কোনো পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নয়। কিন্তু অন্যান্য শাসন ব্যবস্থা থেকে উত্তম, তা প্রমাণিত। এই জন্যই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন: আমলারা দলীয় কর্মকা-ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছেন। সম্প্রতি সরকারদলীয় একটি কর্মসূচিতে আমলারা দলবলে অংশ নেন। এটি কীভাবে দেখছেন?
ড. আকবর আলি খান: অবসরে গিয়ে আমলারা রাজনীতি করে দেশের প্রতি অবদান রাখবে, এতে আমি দোষের কিছু দেখি না।
দোষের হচ্ছে, আমলাতন্ত্রে থেকে কেউ যদি সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন, এমনকি যারা অবসরের পরপরই রাজনীতি করেন, তাদের জন্যও রাজনীতি দূষিত হয়। এই সুযোগ থাকার কারণেই অনেক আমলা রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হতে চান এবং হচ্ছেন। আর তখন আমলাতন্ত্রে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: এক্ষেত্রে আপনার পরমার্শ কী?
ড. আকবর আলি খান: আমি মনে করি, অবসরে যাওয়ার তিন বছর পর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার বিধান থাকতে হবে। কমপক্ষে তিন বছরের আগে আমলাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলে আমলাতন্ত্রে দলবাজি হবেই।
একটি ছেদের প্রয়োজন পড়ে।
প্রশ্ন: এই ছেদ আসলে কতটুকু বাস্তবসম্মত?
ড. আকবর আলি খান: রাজনীতি দূষণমুক্ত করতে হলে এই ছেদ বাস্তবসম্মত করতেই হবে। অবসরে যাওয়ার পরমুহূর্তেই যদি রাজনীতি করার সুযোগ থাকে তাহলে শেষের দিকে সরকারি কাজের চেয়ে আমলারা রাজনীতিই বেশি করে থাকেন। তখন প্রশাসনযন্ত্রকে রাজনীতির জন্য ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হয়। অনেক দেশে সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও এমন নিষেধাজ্ঞা থাকে।
গত নির্বাচনী আইনেও এই ধরনের পরিবর্তন করা হয়েছিল।
প্রশ্ন: এখন যে পরিস্থিতি দৃশ্যমান, তা নিয়ে কী বলবেন?
ড. আকবর আলি খান: আমলাদের রাজনীতির প্রতি যে আনুগত্য, তা কোনোভাবেই কাম্য না। বাধানিষেধ নেই বলেই, প্রশাসনযন্ত্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দুষ্ট হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করি। চাকরি এবং রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে বিশেষ ছেদ না থাকলে, আমলারা সরকারের আনুগত্য পেতে, যা করবার তাই করবে।
প্রশ্ন: তাহলে কী এসব প্রক্রিয়ায় সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার কাজ করে?
ড. আকবর আলি খান: সরকারের মধ্যে এমন সরকার পৃথিবীর সব দেশেই থাকে। সরকারের মধ্যকার সরকারের সঙ্গে রেষারেষিও থাকে। এসবে  অতি উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্য দেশের ভালো রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এসব বিষয় আমাদের কাছে বড় হবে না।
প্রশ্ন: খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকগুলো। খেলাপি ঋণ বাড়ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন ব্যাংকের এই পরিস্থিতি?
ড. আকবর আলি খান: খেলাপি ঋণে ব্যাংকগুলো উদ্বেগ বাড়িয়েছে। আমাদের জন্য এটি দুর্ভাগ্য বলে মনে করি। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া এবং সাইফুর রহমান খেলাপি ঋণ রোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেন। অথচ তাদের ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
ব্যাংক পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগ বাড়িয়েছে। স্পষ্টতই সরকারি ব্যাংকগুলোর যে লোকসান, তা ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
প্রশ্ন: এই পরিস্থিতির জন্য বিশেষত কোন বিষয়কে দায়ী করবেন?
ড. আকবর আলি খান: ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের যে সদস্যরা আছেন, তারা কেউই ব্যাংক পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তারা রাজনীতিবিদ। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি চাইলেই ব্যাংক পরিচালনা করতে পারেন না, যেমন একজন ব্যাংকার চাইলেই রাজনীতিতে ভালো করতে পারেন না।
প্রশ্ন: তাহলে প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনাই দায়ী?
ড. আকবর আলি খান: হ্যাঁ, রাজনীতির কারণেই ব্যাংক খাতে চরম দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। এতে করে যারা ব্যাংকে টাকা রাখছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আপামর জনসাধারণ ব্যাংক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই।
প্রশ্ন: বেসরকারি ব্যাংকগুলো তো অনেকটাই স্বাধীন। সেখানেও তো বিশৃঙ্খলা?
ড. আকবর আলি খান: রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই সরকারগুলো বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দিয়েছে। এ কারণে ব্যাংকের মালিকরাও স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সরকারের মতোই। যে কারণে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকগুলোর স্বাধীনতাও একই কারণে পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। ব্যাংকের দুর্নীতি অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।
প্রশ্ন: এ কারণেই কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব?
ড. আকবর আলি খান: ব্যাংকিং বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর তুলে দেয়া হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, সরকারের কাজ ব্যাংকিং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা নয়। ব্যাংক এবং ইন্স্যুরেন্স অথরিটি আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এই অথরিটি ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করার কথা।
ব্যাংকিং বিভাগ প্রতিষ্ঠা করাই হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংক অথরিটির ক্ষমতা খর্ব করার  জন্য। অন্যথায় এই ব্যাংকিং বিভাগের কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
প্রশ্ন: একটি কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে ব্যাংকের আরেকটি কেলেঙ্কারি ঢাকা পড়ছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের আর্থিক খাত আসলে কোথায় যাচ্ছে?
ড. আকবর আলি খান: ব্যাংকিং খাতের যে পরিস্থিতি যাচ্ছে, তাতে করে আর্থিক খাত নিয়ে আশাবাদী হওয়ার আপাতত কোনো কারণ নেই।
সব ক্ষেত্রেই তো সুশাসনের অভাব রয়েছে। সুশাসনের অভাবেই আর্থিক খাতের এমন অনিয়ম-দুর্নীতি।
দুর্নীতি হচ্ছে সর্বত্রই। হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দুর্নীতিবাজরা উধাও হচ্ছেন, অথচ বিচার হচ্ছে না, সাজা হচ্ছে না। আরও যেন চুরি করা যায়, তার জন্যই নানা আয়োজন হচ্ছে।
প্রশ্ন: এমন কাদা তো সর্বক্ষেত্রেই?
ড. আকবর আলি খান: রাষ্ট্রে মাথাভারী প্রশাসন সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিচের দিকে কর্মকর্তা-কর্মচারি নেই। অথচ উপরের দিকে অসংখ্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যাদের কোনো কাজ নেই। এ কারণে সব কর্মকর্তা যদি সৎ-ও হয়, তবুও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। আর বিলম্বিত সিদ্ধান্ত দুঃশাসনের ভালো ক্ষেত্র তৈরি করে।
একজন বিনিয়োগকারী সিঙ্গাপুরে গিয়ে দুই কি তিন দিনের মধ্যে চিঠির জবাব পান। আর আমাদের এখানে ছয় মাসেও জবাব মেলে না। বাংলাদেশে দৃঢ় সুশাসনের প্রতি কোনো অঙ্গীকার নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানা প্রশ্ন থেকে যাবে। এ কারণে যে কোনো সময় আমাদের প্রবৃদ্ধিতে ধস নামতে পারে।
প্রশ্ন: এরপরেও তো মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে?
ড. আকবর আলি খান: বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলে রয়েছে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ। মূলত তিন ধরনের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল হোতা বা নায়ক মনে করি।
যারা বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে দেশে ২০/২২ বিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছেন, তারাই হচ্ছেন অর্থনীতির মূল নায়ক। অথচ তারা কিন্তু অদক্ষ, অশিক্ষিত। দ্বিতীয়ত, অশিক্ষিত গার্মেন্ট শ্রমিক, যারা কম বেতন নিয়ে পোশাক রপ্তানিতে সহায়তা করছেন। তৃতীয়ত, অশিক্ষিত কৃষক যারা তাদের হাজারো চেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা চারগুণ বাড়িয়েছেন। এই তিন শ্রেণির মানুষই রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: এই এগিয়ে নেয়ার পেছনে রাজনীতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. আকবর আলি খান: সাধারণ মানুষ এগোয়, রাজনীতিকরা টেনে ধরে। শিক্ষিত রাজনীতিবিদরাই যদি সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করত তাহলে, আমাদের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে থাকত। যে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেটাও ধরে রাখতে পারব কিনা সন্দেহ আছে।
প্রশ্ন: কেন এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন?
ড. আকবর আলি খান: আমাদের চলমান অর্থনীতির প্রধানতম নায়ক হচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। যারা অধিকাংশই অদক্ষ এবং অশিক্ষিত। বিদেশের মাটিতে অদক্ষ শ্রমিকের বাজার সংকোচিত। মধ্যপ্রাচ্যে ইতোমধ্যেই নারী শ্রমিকদের নিয়ে নানা শঙ্কার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এই পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা থাকলে প্রবৃদ্ধি আরও কমতে পারে। যা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইতোমধ্যেই শঙ্কা প্রকাশ করেছে।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তো অর্থনীতির অনুকূলে না, যা বিশেষ মুহূর্তে মোকাবিলা করতে পারবে।
প্রশ্ন: তার মানে উন্নয়নের পথে রাজনীতিই এখন বাধা?
ড. আকবর আলি খান: রাজনীতি উন্নয়নের বাধা এটি এখন প্রমাণিত। অথচ সরকারগুলোর অর্থমন্ত্রীরা দাবি করে যে, তাদের কারণেই অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বা সরকার নায়ক না, আসল নায়ক হচ্ছেন অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশের মানুষ দেখাতে পারে যে, তারা কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন এবং বিশেষ মুহূর্তে কত শক্ত অবস্থানে থাকতে পারেন।
প্রশ্ন: রোহিঙ্গা ইস্যুতে কতটুকু শঙ্কা প্রকাশ করছেন?
ড. আকবর আলি খান:  রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমি চরম আতঙ্কিত। আলোচনা হচ্ছে। ভালো। কিন্তু এই আলোচনার সুফল আমরা পাবো কিনা সন্দেহ আছে।
প্রশ্ন: কেন এমন মনে করছেন?
ড. আকবর আলি খান: সামরিক শক্তিতে প্রভাবিত মিয়ানমারের রাজনীতি অত্যন্ত অসহিষ্ণু। উগ্র বৌদ্ধ মতালম্বী। তারা সত্যিই কোনো আপস চায় কিনা, তা এখনও পরিষ্কার না।
যদি সত্যিই তারা আপস বা শান্তি চাইত তাহলে এখনও রোহিঙ্গারা জীবনভয়ে পালিয়ে আসত না। এই সমস্যা তো পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে।
প্রশ্ন: আমাদের কী করণীয়?
ড. আকবর আলি খান: আলোচনা চলছে, চলুক। কিন্তু আমাদের অত্যন্ত সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।
প্রশ্ন: ভারত-চীনকে কাছে পেলাম না রোহিঙ্গা ইস্যুতে। সতর্ক থেকেই বা কী লাভ?
ড. আকবর আলি খান: ভারত-চীনের মদদেই রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি ঘটেছে। আমরা পাশের এই দুই দেশকে কাছে না পেলেও বিশ্বশক্তির সমর্থন পাচ্ছি। সতর্কতা এখানেই। কারণ এই সমর্থন ধরে রেখেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করতে হবে।
সরকার কীভাবে এগুচ্ছে, তার উপরেই অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দৃশ্যমান কোনো সমাধানের পথ নেই বলেই ধারণা করা যায়।
প্রশ্ন: সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটি-পদত্যাগ নানা ঘটনার জন্ম দিল। এটি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন?
ড. আকবর আলি খান: প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটি-পদত্যাগ নিয়ে যা ঘটল, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে বিচার বিভাগের বড় ক্ষতি হলো।
সরকার দাবি করছে, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পুরোপুরিভাবে স্বাধীন করার কথা বলছে। কিন্তু আমরা এস কে সিনহার ঘটনায় উদ্বিঘœ।
প্রশ্ন: আস্থা তৈরির প্রশ্নে কী বলবেন?
ড. আকবর আলি খান: সবার আগে সরকারকেই ভাবতে হবে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিচার বিভাগ। এখানে আস্থা হারালে রাষ্ট্র, সমাজের বড় ক্ষতি হবে। দীর্ঘমেয়াদি এই ক্ষতিতে রাষ্ট্রের অন্য কাঠামোও ভেঙে পড়বে। সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে যে নীতিকথা বলছে, তার সত্যিকার প্রতিফলন ঘটলেই মানুষের আস্থা ফিরবে। সংগ্রহ-সাপ্তাহিক.কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!