বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে

বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে
রণেশ মৈত্র

সে আজ প্রায় ৬২ বছরেরও বেশী আগের কথা। ১৯৫৩ সালের। বয়সে আমি তখন তরুণ। সবে ভাষা আন্দোলনের পালা শেষ করে প্রচন্ড আশাবাদকে হৃদয়ে ধারণ করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্র সংগঠন সমকালীন বন্ধু স্থানীয় ছাত্ররা মিলে গঠন করেছি- যার পাবনা জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম আমি। এটা তো ১৯৫২ সালের শেষ দিকে।

১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি (সম্ভবত:) আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে দলীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমানসহ পাবনা সফরে আসেন। করবেন কর্মী ও জনসভা। ছাত্র ইউনিয়ন কোন দলের সহযোগি বা অঙ্গ সংগঠন ছিল না। ছিল যথার্থ অর্থে একটি ছাত্র গণসংগঠন। তাই আওয়ামীলীগের ঐ কর্মী সভায় যাওয়া আমরা সমীচীন বোধ করলাম না- আহ্বান ও পাইনি। কিন্তু দেশের একমাত্র বিরোধী দলের (তৎকালীন সময়ের) দুই শীর্ষ ও জনপ্রিয় নেতার পাবনা আগমনকে কেন্দ্র করে আমরা মন থেকে তাঁদের সাথে সাক্ষাত করে ১৯৫৪ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক নির্বাচনে খুনী নূরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে মুসলিমলীগ বিরোধী এক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অপরাপর দলকে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের অনুরোধ জানানোর তাঁদের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের এক প্রতিনিধিদলসহ দেখা করতে গেলাম আনুমানিক সকাল নয়টার দিকে। আসলে আওয়ামীলীগ তখনও গঠন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারে নি-তাই যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তি ও অর্জন করতে পারে নি।
যাহোক গিয়ে মুজিব ভাইকে পেয়ে গেলাম-পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত জননেতা আবদুর রব বগা মিয়ার শালগাড়িয়াস্থ বাসভবনে যেমন বগা মিয়াকে বগা ভাই বলে ডাকতাম তেমনই শেখ মুজিবকে (তখন তিনি তরুণ) মুজিব ভাই বলেই সম্বোধন করে আমাদের সবার পরিচয় তাঁকে জানালাম। তিনি করমর্দনের জন্য হাত এগিয়ে দিলেন। পরে হেসে বললেন, তবে তো সবাই কমরেড। ছাত্র ইউনিয়ন তো কমিউনিষ্ট। হেসে আমিও জবাব দিলাম, খুব অল্প সংখ্যক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা-কর্মী কমিউনিস্ট- বাকী বৃহত্তর অংশ অকমিউনিস্ট তবে কেউই এ্যান্টি কমিউনিস্ট নয়। ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে বিস্তর আওয়ামীলীগ সমর্থক ও থাকার কথা ছিল- কিন্তু আপনাদের দলের নামের সাথে তো সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আছে- “ আওয়ামী মুসলিম লীগ” হওয়াতে। ছাত্র ইউনিয়ন পূরোদস্তুর সাম্প্রদায়িকাত বিরোধী।

মুজিব ভাই হেসে বললেন, না, আওয়ামীলীগ ও অসাম্প্রদায়িক দল কদাপি সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করে না যদিও দলের নাম দেখে তেমন ধারণার সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। আগামী নির্বাচনের পরে সুবিধাজনক কোন এক সময়ে আমরা দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দ তুলে দেবো।

মুজিব ভাই নিজেই কথা প্রসঙ্গে নির্বাচনের কথা উত্থাপন করায় আমাদের কিছুটা সুবিধা হলো। বললাম, “মুজিব ভাই, আমরা পাবনার ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে আগামী বছরের শুরুতে (১৯৫৪ সালে) অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার জন্যই এসেছি। সম্মতি জানালে বললাম মওলানা সাহেবও থাকলে ভাল হতো- আপনাদের দুজনের সাথে একবারেই কথা হয়ে যেত। মুজিব ভাই জানালেন, মওলানা সাহেবের শরীরটা কিছুটা অসুস্থ- বিকেলে আবার জনসভা কিছুক্ষণ পর কর্মী সভাতেও তাঁকে বলতে হবে। তাই আমাকেই বল।

বলে উঠলাম, যাতে ঐ নির্বাচনে কোন ক্রমেই মুসলিম লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন না করতে পারে সেজন্য আমরা আপনাদের কাছে আবেদন জানাই মুসলিমলীগ বিরোধী সকল রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি ব্যাপক ভিত্তিক যুক্তফ্রন্ট গঠন করে মিলিতভাবে বাছাই করে প্রতি আসনে সর্বসম্মত প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচনে যেতে আমরা আপনাদেরকে নেতৃত্ব নিতে অনুরোধ জানাই। এটি আমাদের এবং মানুষের কাছে জীবনমরণ প্রশ্ন।

মুজিব ভাই সাথে সাথে সায় দিয়ে প্রশ্ন করলেন, এ ব্যাপারে পাবনা ছাত্র সমাজ এবং সমগ্র ছাত্র ইউনিয়ন কি একমত ? আমরা হ্যাঁ বলাতে তিনি বললেন ছাত্রলীগ তো তেমন একটা কিছু বলে না। তবে শুনেছি এ দাবী তাদের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে উভয় ধরণের মতই আছে। তবে তারা চেষ্টা করছে ঐক্যের-অর্থাৎ যুক্তফ্রন্টের ব্যাপারে একমত হতে। মুজিব ভাই আরও বললেন, আওয়ামীলীগে মওলানা সাহেব (তিনি হুজুর বলতেন) ও আমি একমত। উভয়ে মিলে এ প্রশ্নে গোটা আওয়ামীলীগকে প্রায় একমত করে এনেছি-শীঘ্রই একমতে সবাই আসবে। তবে সোহরাওয়ার্দী সাহেব কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন। তবে আমরা তাঁকে রাজী করাতে পারব। তবে হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক পার্টি এখনও দ্বিমত পোষণ করছে। তাই তোমরা বাংলাকে রাজী করাতে পারলে সুবিধা হবে আমরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বললাম, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতারা সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদি উনি পাবনা আসেন তবে আমরাও তাঁর কাছে দাবীটা অবশ্যই তুলে ধরবো। তবে তাঁর কোন সংগঠন আজও পাবনাতে গড়ে ওঠে নি-তাই তাঁর পাবনা সফরে আসার সম্ভাবনা আমরা আপাতত: দেখছি না।

সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে তাই মুজিব ভাইকে বললাম, আমাদের কিন্তু আরও একটা দাবী আছে আপনাদের কাছে। প্রস্তাবিত যুক্তফ্রন্টে কমিউনিস্ট পার্টিকেও অন্তর্ভূক্ত করবেন- তাহলে ফ্রন্ট জোরদার হবে। কারণ ছাত্র ইউনিয়ন তখন সকল শক্তি নিয়ে নামতে উৎসাহী হবে কৃষক সংগঠনও তাই- শ্রমিক ইউনিয়নগুলিও। মুজিব ভাই বললেন, কমিউনিস্ট পার্টি কার্যত বে-আইনী থাকায় এবং প্রায় সবাই আতœগোপনে থাকায় তারা কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন ? দ্বিতীয়ত: মওলানা সাহেবের ও আমার দ্বিমত না থাকলেও শহীদ সাহেব, হক সাহেব, নেজামে ইসলামী রাজী হবেন না। তাই এটা অনিশ্চিত। তবে আমরা দুজন সাধ্যমত চেষ্টা করবো।

খুশী মনে আমরা ফিরে এলাম। তারপরও ঐ বছরে আরও দু’একবার তিনি পাবনা এসেছেন। এলেই আমরা যেতাম মুজিব ভাই এর সাথে দেখা ও আলাপ করতে।

যাহোক, অবশেষে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলো হক-ভাষানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। কমিউনিস্ট পার্টিকে যুক্তফ্রন্টে নেওয়া সম্ভব হলো না। তবে পার্টির পক্ষ থেকে পৃথকভাবে প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো নিদিষ্ট কয়েকটি আসনে। বাকী সকল আসনে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাহীনভাবে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদেরকে সমর্থন দেবে-পার্টি এ সিদ্ধান্ত যুক্তফ্রন্টকে জানিয়ে দিলো। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ১০টি আসন বাদে বাকী সকল আসনে বিজয়ী হলো-কমিউনিস্ট পার্টি পেল ৪টি আসন। তবে যুক্তফ্রন্ট তাদের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানায় নি।

শেরে বাংলার নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক ভাবে জন সমর্থিত যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলেও মিথ্যা অজুহাতে কেন্দ্রীয় মুসলিমলীগ সরকার মাত্র ৫৮ দিনের মাথায় তৎকালীন ৯২(ক) ধারার ক্ষমতাবলে পূর্ববাংলা মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে গভর্ণরী শাসন কায়েম করে হাজার হাজার আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী, ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে বিনাবিচারে আটক করে জন নিরাপত্তা আইনে। আমরাও বাদ পড়ি না। মুক্তি পাই ১৩ মাস পরে। তখন শেরে বাংলা এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মুসলিমলীগ সরকারের মন্ত্রীত্বে অধিষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানী ৯২(ক) ধারা জারীর আগে থেকেই ষ্টকহোমে বিশ্ব শান্তি পরিষদের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে ষ্টকহোমে-তবে দেশে ফিরলেই তাঁকে গ্রেফতারের হুমকি দিলো কেন্দ্রীয় সরকার।

এ প্রসঙ্গে আর নায়। এবারে ষাটের দশকের প্রসঙ্গে আসি। তখন আইউবের সামরিক শাসন চলছে। ১৯৬৬ সালের কথা। তার আগে ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকিস্তান পরাজিত হয়। লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় সম্মেলন। মুজিব ভাই তাঁর দলীয় নেতাদের সহ ঐ সম্মেলনে গিয়ে ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পেশ করা মাত্র সম্মেলন আহবানকারী ও অংশগ্রহণকারী ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল মহলগুলি ঐ কর্মসূচীকে অনুমোদন করা দূরের কথা- তার মধ্যে খুঁজে পেলেন বিচ্ছিন্নতাবাদের ষড়যন্ত্র-পাকিস্তান ভাঙ্গার চক্রান্ত এবং দেশ দ্রোহীতার অপরাধ। বিরোধী দলীয় সম্মেলন হলে কি হবে-সেখান থেকে দাবী উঠলো দেশদ্রোহীতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রচারক হিসেবে শেখ মুজিবকে অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক। পশ্চিম পাকিস্তানের সকল সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্টায় ব্যানার হেডিং এ ঐ চক্রান্তের খবর রং চড়িয়ে ফলাও করে প্রচার করা হয়-শেখ মুজিবের গ্রেফতারের দাবীও জানান হয়। সদলবলে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন ঢাকায়। সেখানে সাংবাদিক সম্মেলন করে পুনরায় ছয় দফা কর্মসূচী ও তার সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন সবিস্তারে। তবু তিনিসহ কয়েকজন প্রথম সারির আওয়ামীলীগ নেতা গ্রেফতার হন ঢাকা থেকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেতৃবৃন্দকে এনে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়ানী ওয়ার্ডে রেখে বাকী সবাইকে যথা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমূখকে ভিন্ন ভিন্ন জেলে বদলি করে দেওয়া হয়। রচনা করা হয় এক ভীতিকর পরিবেশ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে।

আমি যুদ্ধ শুরু হওয়ার থেকেই গ্রেফতার হই ১৯৬৫ সালে। আওয়ামীলীগ নেতাদের গ্রেফতারের সময়েও মুক্তি পাই নি। আটক রয়েছি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে বিনাবিচারে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আই.জি প্রিজনস এর অনুমতি পেয়েছি কারাভ্যন্তরে থেকেই এলএলবি ফাইন্যাল পরীক্ষা দেওয়ার। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে বদলি করে দেওয়া হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারণ আটক বন্দীদের মধ্যে যারাই পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক তাদের সবার পরীক্ষার কেন্দ্র ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাকে সেখানকার পুরাতন ২০ সেলের স্থান দেওয়া হলো। ঐ সেলে ঢুকিয়ে প্রধান দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দিয়ে বলা হলো সেলের অভ্যন্তরেই আমার গতিবিধি সীমাবদ্ধ থাকবে। আমিও পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পড়াশুনার অনুকুল পরিবেশের জন্য নিরিবিলিই থাকতে চেয়েছিলাম। তাই সেলে রাখার জন্য আমার দিক থেকে কোন অভিযোগ ছিল না। আমাকে যখন আটকে রেখে ডেপুটি জেলার চলে যান তখন আনুমানিক বেলা ১২টা । খানিক পর সেলের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়-বইপত্র গুছিয়ে রেখে ঘাটে শুয়ে বিশ্রাম করে স্নানের জল চলে এলা। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে দেখি টেবিলে খাবার রেখে গেছে খাবারের দায়িত্বে থাকা কয়েদীরা। খেয়ে নিয়ে বেলা দুটোর দিকে বিছানায় শুয়ে দিব্যি একটা ঘুম দিলাম। রাজশাহী থেকে রাত জেগে ঢাকা আসায় (ট্রেনে) তখন খুব ঘুম পাচ্ছিল। টানা ঘুম শেষে জেগে দেখি প্রায় পাঁচটা। হুড়মুড় করে উঠে চোখ মুখ ধুয়ে এক পেয়ালা চা খেয়ে আবারও যেন ঘুম ঘুম বোধ করছিলাম। হঠাৎ দেখি মেইন দরোজা খুলে হেড ওয়ার্ডার এসে হাজির। বললেন একটু সামনে এসে দেখুন, এক ভদ্রলোক আপনাকে ডাকছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কে ? ইন্টারভিউ নাকি ? তিনি হেসে বললেন, বাইরে বেরোলেই দেখতে পাবেন- সেলের সামনেই আছেন তিনি।

বেরিয়ে বিষ্মিত নয়নে দেখি বিশাল বপু এবং সাহসদীপ্ত জননেতা শেখ মুজিবর রহমান- আমাদের মুজিব ভাই। তিনি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন- গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন। অত:পর কুশলাদি বিনিময়। মুজিব ভাই বললেন ছয় দফা ঘোষণা করেই তো কারাগারে এসে স্থান নিয়েছি। বাইরে জনগণ কি ভাবছে তার খবর তেমন একটা জানি না। আপনি সদ্য বাইরে থেকে এলেন- টাটকা খবর বলুন। এই প্রথম মুজিব ভাই আপনি বলে সম্বোধন করলেন।

যাহোক বললাম, টাটকা খবর তো নেই মুজিব ভাই আমি তো আপনার বহু আগে থেকেই আটক। তা বছর খানেক তো হবেই। তবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সিরাজগঞ্জ জগন্নাথগঞ্জ ঘাট দিয়ে ঢাকা আসতে যে প্রায় ২৪ ঘন্টা বাইরে ছিলাম ট্রেণে ও ষ্টীমারে সেই সময় যাত্রীদের মধ্যেকার কথাবার্তা থেকে বুঝছি আগে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছিলেন ছয় দফা কর্মসূচী প্রকাশিত হওয়ার পর। ধীরে ধীরে তা কেটে যাচ্ছে এবং ছয় দফার প্রতি দেশবাসীর সমর্থন প্রতিদিনই বাড়ছে। আমার দলের নেতারাও তো জেলে তবুও বাইরে যোগযোগ করে যতটুকু যখন জানতে পারব-বলবো আপনাকে।

মুজিব ভাই বললেন, বাইরে যোগাযোগের জন্য চিঠি লিখে আমার কাছে ও দিতে পারেন-যাঁকে দিতে বলেন তাঁর কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালনে আমি রাজী আছি। আমরা অনেক চ্যানেল আছে। ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম তার সম্ভবত: দরকার হবে না। আমাদের দলীয় চ্যানেল আছে সেই চ্যানেলে মাঝে মাঝে তাঁরাই গুরুত্বপূর্ণ খবরাদি জানাবেন। তবে প্রয়োজন হলে আপনাকেও বলবো।

মুজিব ভাই কথাগুলি বলছিলেন হাঁটতে হাঁটতে। আমাকে বললেন, যতদিন এই সেলে থাকেন সকালে এক ঘন্টা বিকেলে এক ঘন্টা দু’জনে হাঁটাহাঁটি করবো-কথাবর্তা বলবো-খবরাদি আদান প্রদান করবো। বললাম আমাকে ডেপুটি জেলার বলে গেছেন অন্য কথা। মুজিব ভাই বললেন, ওরা বলবেই- কারণ আমার সাথে কারো যেন যোগাযোগ যেন না হয় তেমন অর্ডার উপর মহল থেকে আছেন। তবে আপনার আসার খবর পেয়ে আমি তাদের সাথে কথা বলে এই ব্যবস্থা করেছি। সুতরাং অসুবিধে হবে না। তবে জেলার ঢুকলে সেলে চলে যাবেন। হেড ওয়ার্ডার এসে আগেই খবর দিয়ে যাবে।

বস্তুত: মুজিব ভাই তো যে কোন কারাগারে মুকুটহীন সম্রাট। তাঁর কথা কে না শোনে ? তাই এক মস্ত সুযোগ পাওয়া গেল হাঁটাহাঁটি এবং কথাবার্তার। নইলে লেখাপড়ার সময়টুকু বাদে একাকীত্বের যন্ত্রনায়ও ভুগতে হতো বাকী সময় টুকু। অবশ্য দীর্ঘ কারাজীবনে অভ্যস্ত হওয়ায় এগুলি সবই গা-সহা হয়েছে অনেক আগেই। তাই বেশ নির্বিঘেœই হাঁটতাম-বেড়াতাম-কথাবার্তা বলতাম প্রতিদিন সকাল-বিকেল এক ঘন্টা করে দু’ঘন্টা। সংবাদপত্রের খবরগুলিও আমাদের বিষয়বস্ত হতো আলোচনার।
একদিন বললেন, মাঝে মধ্যে উদ্বিগ্ন বোধ করি, ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণার পর আওয়ামীলীগ তো একা হয়ে গেছে কোন দলই এই কর্মসূচীর পক্ষে সমর্থন জানায়নি। আপনাদের ন্যাপ তো এটাকে সি,আই এর কর্মসূচী-বিচ্ছিন্নতাবাদের কর্মসূচী বলে অভিহিত করেছে। প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম মুজিব ভাই আপনি কি খবর রাখেন না- ন্যাপের চীনাপন্থীরা এ কথা বলে আমরা যারা রুশ পন্থী বলে পরিচিত তারা তো বিবৃতি দিয়েই ছয় দফা কর্মসূচীকে সমর্থন দিয়েছে। আমিও তো সেই দলেই। মুজিব ভাই বললেন, সৈয়দ আলতাফ অন্যান্যরা তো ? বললাম হ্যাঁ। মুজিব ভাই বললেন হ্যা আপনারা সমর্থন জানিয়েছেন ঠিকই। দেখা যাক শেষ পর্য্যন্ত কোথায় দিয়ে দাঁড়ায়।

বঙ্গবন্ধুর এই সান্নিধ্য বস্তুত:ই এক ঐতিহাসিক মুহুর্তে পেয়েছিলাম-বলা চলে ঐ দিনগুলি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের নবোত্থানের উত্তাল দিন। সন্ধ্যায় যখন মুজিব ভাই তাঁর কক্ষে, আমি আমার সেলে তালাবদ্ধ হতাম- তার কিছুক্ষণ পরেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের শক্ত সুউচ্চ প্রাচীর ভেদ করে বিশাল বিশাল মশাল মিছিলের শ্লোগানের আওয়াজ ভেসে আসতো, “জয় বাংলা” জেলের তালা ভাঙ্গবো- রাজবন্দীদের আনবো, “ছয়দফা-এগার দফা-মানতে হবে, মানতে হবে”- তখন মনে হতো মিছিলকারীদের পদভারে বিশাল ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারের দেওয়ালগুলির প্রতিটি ইট কেঁপে কেঁপে উঠছে-আমাদের ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে বেরিয়ে ঐ মিছিলে যোগ দিই। আর ও দিকে মুজিব ভাই জেলপুলিশ পাঠিয়ে জানতে চাইতেন- মিছিলের আওয়াজ শুনেছি কিনা। সেই মুহুর্তগুলি ছিল যথার্থই-রোমাঞ্চকর।

অত:পর কোন একদিনের (তারিখটা মনে নেই) বিকেলে সেলে বসে আছি। হঠাৎ হেড ওয়ার্ডার শ্লিপ নিয়ে এসে হাজির। তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে-ইন্টারভিউ আছে-এই খবর নিয়ে। ইন্টারভিউ এর খবর পেয়ে অবাক হলাম। আমি তো কারও ইন্টারভিউ চেয়ে কৃর্তৃপক্ষের কাছে কোন আবেদন জানাই নি। তবু কাপড় চোপড় পরে রেডি হয়ে গেলাম রাজবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট লম্বা ইন্টারভিউ রুমে। হাতে ডিটেনশন অর্ডারটা। ঢুকতেই দেখি মুজিব ভাই বসা। সামনে বসে আছেন এক বয়স্ক মহিলা- সাথে এক কিশোরী কন্যা। তাঁদের কাউকে চিনতাম না। আর অপর প্রান্তে বসে আছেন আমার বাল্যবন্ধু ব্যারিষ্টার আমীর উল-ইসলাম। তিনিই এসেছেন নিজ উদ্যোগে আমার সাথে দেখা করতে। তাঁর দিকে পা বাড়াতেই মুজিব ভাই একটু দাঁড়াতে বলে ভাবীর দিকে ঈশারা করে বললেন, “আপনার ভাবী”। আমি তাঁকে সশ্রদ্ধ সালাম জানালাম। আর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইনি তোমার চাচা রণেশ মৈত্র। পাবনার ন্যাপের গণতাস্ত্রিক আন্দোলনের নেতা। বয়সে আমার জুনিয়র হলেও আমার অত্যান্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। সালাম কর।” হাসিনা এগিয়ে আসতে নিলে বললাম, না, তোমাকে আসতে হবে না, তুমি অনেক বড় নেতার মেয়ে, নিজেও ভবিষ্যতে বড় কিছু একটা হবে আশা করি। সেই ভাবে নিজেকে গড়ে তোল। হাসিনা কপালের দিকে হাত তুলে সালাম জানালেন।

অত:পর ব্যারিষ্টার আমীর-উল-ইসলামের সামনে গিয়ে পৃথক চেয়ার টেবিলে বসলাম। তিনি আমার আটকাদেশ বে-আইনী এবং অবৈধ দাবী করে আমার মুক্তির নির্দেশ প্রার্থনা করে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করতে চান। এ ব্যাপারে আমার সম্মতি চাইলে দিলাম। আটকাদেশটি চাইলে ডেপুটি জেলারের মাধ্যমে ব্যারিষ্টার আমীরকে তা দিলাম। বাইরের কিছু খবরা খবরও আকারে ইঙ্গিতে শুনলাম। মুজিব ভাই হঠাৎ আমীর-উল-ইসলামকে লক্ষ্য করে বললেন, “শোন আমীরুল, টাকা যা লাগে আমি দেব। তুমি রীটটা ভাল করে করবে। রণেশ বাবু বাইরে গেলে অনেক কাজ হবে। হেসে আমীরুল বললেন, “না টাকা লাগবে না। রণেশ আমার বাল্যবন্ধু- ওর সাথে আমিও জেল খেটেছি অতীতে। ওর কেস অবশ্যই ভালভাবে করবো। বলেই ওকালতনামাতে আমার সই নিয়ে ডেপুটি জেলারকে দিয়ে তা ধঃঃবংঃবফ করিয়ে নিলেন। আসলেই তিনি একটি পয়সাও না নিয়ে খেটে খুটে রীটটি করে কয়েক মাসের মধ্যেই উচ্চ আদালতের নির্দেশে আমাকে মুক্ত করলেন। তৎকালীন রাজবন্দীদের আরও অনেকের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে একই ভাবে তাদেরকেও মুক্ত করেছেন। আমীরুল ঐ সময়ে রীটগুলির মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় আইনজীবী হিসেবে আতœপ্রকাশ করেন।

ঐ দিন ইন্টারভিউ শেষে ফিরে এসে আর হাঁটার সময় পাওয়া গেল না। মুজিব ভাই ও পান নি।
রাতের বেলায় দেখি নানাবিধ পদে সমৃদ্ধ উচ্চমানের খাবার দাবার বঙ্গবন্ধু পাঠিয়েছেন। ভাবী নিজ হাতে রান্না করে এনেছিলেন। তার মধ্যে বিশেষ করে মনে আছে সুস্বাদু ইলিশ মাছের পাতুরী। অপূর্ব ! আজও যেন তা আমার জিভে লেগে আছে। আম, লিচু প্রভৃতি নানাবিধ ফলও সেই সাথে। অসাধারণ তৃপ্তির সাথে কারাগারে বসে নৈশভোজ সেরেছিলাম সেদিন। আগেই বলেছি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে বদলি করা হয়েছিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। এল.এল.বি ফাইন্যাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। সেই পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে হতোমধ্যে এবং দু’তিনটা পেপারের পরীক্ষা সিউিউল মোতাবেক দিয়েছিও। সামনে ৭ জুন আর একটি পরীক্ষা। তার দু’তিন দিন আগে থেকে দেশ রাজনৈতিক উত্তেজনায় কেঁপে উঠেছিল। ঘোষণা করা হয়েছে ঐ দিন ছয় দফা বাস্তবায়নের এবং রাজন্দীদের মুক্তির দাবীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেছে আওয়ামীলীগ। ন্যাপের মস্কোপস্থী অংশ সমর্থন জানিয়েছে। মিছিলের পর মিছিল ঢাকায়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠছে কারাগারও।

এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলাম ঐদিনকার পরীক্ষা বর্জন করবো। হেড ওয়ার্ডারকে দিয়ে অফিস থেকে দরখাস্তের কাগজ আনিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলার অব এগজামিনেশনস বরাবর দরখাস্ত লিখলাম-সাধারণ হরতাল আহুত হওয়ায় তার সমর্থনে এবং তার প্রতি সংহতি জানাতে আমি ঐদিনকার পরীক্ষা বর্জন করলাম। দরখাস্তটি নিয়ে অফিস যাবার পথে হেড ওয়ার্ডার মুজিব ভাই এর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি ওনার হাত থেকে কাগজটি কেড়ে নিয়ে পড়ে হেডওয়ার্ডারকে বললেন আমাকে জানাতে যে আমি যেন দরখাস্ত প্রত্যাহার করে নিয়ে ঐদিন পরীক্ষায় বসি। কারণ পরীক্ষাটার সাথে ক্যারিয়ারের প্রশ্ন জড়িত। হেড ওয়ার্ডার আমাকে এসে জানালো আমি বিনীতভাবে মুজিবভাই এর প্রস্তাব বা পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে ওটা অফিসে দ্রুত জমা দিতে বললাম। অফিস থেকে ওটা পাঠিয়েও দেওয়া হলো যথাস্থানে। নির্দিষ্ট তারিখে সকালে খবরের কাগজ এলে দেখি পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হরতালের কারণে স্থগিত ঘোষণা করেছেন। ব্যাপারটা জেনে মুজিব ভাই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

৭ জুনের সকালে হাঁটতে হাঁটতে মুজিব ভাই একদিকে যেমন হরতালের সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত বলে বলছেন অপরদিকে সরকারী মহল কতদূর এগুবে ভেবে উদ্বেগ ও প্রকাশ করছিলেন। কারণ ইতোমধ্যে ১৪৫ ধারা জারী করা হয়েছে এবং তা অমান্য করেই মিছিল চলছে জনসভার প্রস্তুতিও চলছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলে ওঠেন আদতে আমার ছয় দফা এক দফা। স্বাধীন বাংলা।

বললাম মুজিব ভাই পারবেন না। কারণ আপনার কেবলা তো আমেরিকা- ওরা বিরোধীতা করবে- মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ কোন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থন করেন। মুজিব ভাই বললেন, আমেরিকা ঠিকই তবে ভায়া ইন্ডিয়া। বললাম তবুও হবে না। লাগবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন- সেখানে তো আপনি যান নি। মুজিব ভাই কললেন, তবু হবে। আমি বললাম, কিছুতেই না দেখবেন।

ঐ শেষ কথাবার্তা ঢাকা গেলো। তারপর পরীক্ষা শেষ হলে আমাকে অন্য ওয়ার্ডে স্থানাস্তর করা হয়। মুজিব ভাই এর সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়।

১৯৭২ এর ফেব্র“য়ারী। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম পাবনা সফরে আসছেন। আমরা স্টেডিয়াম মাঠে কয়েকটা লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছি তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে। রুশ হেলিকপ্টার থেকে তিনি নামলেন। গার্ডস অব অনারের পর তিনি লাইনগুলিতে এসে সবার সাথে হাত মেলাচ্ছেন। আমি তৃতীয় লাইনে অপেক্ষামান। প্রথম লাইনে জনা বিশেকের সাথে করমর্দন করতেই তাঁর চোখ পড়লো আমার দিকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, কি রণেশ বাবু, বলেছিলাম না, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। হলো তো ? জবাবে হাসতে হাসতে বললাম, হ্যাঁ মুজিব ভাই, হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু আপনার কেবলায় নয়- আমার বলা কেবলায়।

বঙ্গবন্ধু বললেন, সেই পাঁচ বছর আগের কথা- তাও জেল খানায়। আজও মনে আছে ? আবারও কোলাকুলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!