গৌঢ়বে আওয়ামী লীগ তার উত্থান পতনের বৈচিত্র

 

 

 

 

গৌঢ়বে আওয়ামী লীগ তার উত্থান পতনের বৈচিত্র
রণেশ মৈত্র

 

২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। আওয়ামী লীগের বললে ভূল হবে, আওয়ামী মুসলিম লীগের। ২০১৭ সালের ২৩ জুনে এসে দলটি ৬৯ বছরে পদার্পন করলো। ইতোমধ্যে, প্রতিষ্ঠার ৭/৮ বছর পরেই দলটি তার নামের পরিবর্তন ঘটায়-আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ। দলটির প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের মধ্যে অনেকেই আজ জীবিত নেই। যেমন: মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষানী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজ উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরূল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং আরও অনেকে। মওলানা ভাসানী ও শামসুল হক বাদে প্রধান প্রধান নেতাদেরকে যাঁদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও তাতে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ও ৩রা নভেম্বরে দেশের সামরিক বেসামরিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের বিদেশী দোশরদের সাথে এক জোট হয়ে নির্মমভাবে রাতের অন্ধকারে হত্যা করে। তাই তাঁরা আজ নেই। বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বের কেউই আজ বেঁচে নেই।
কিন্তু আওয়ামী লীগ আছে এবং শুধু তাই নয় ক্ষমতায় আছে। ৪৬ বছরের বাংলাদেশের সাড়ে আঠার বছর আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলো-তবে এ যাবত ১৭ বছর অতিক্রম করলো। আরও দেড় বছর থাকবে-অত:পর সাধারন নির্বাচনে জনগণ স্থির করবেন নতুন করে কারা ক্ষমতায় আসবে। যদি ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আর এক দফা জিতে আসতে পারে তবে এ দেশের রাজনীতিতে তা হবে এক ইতিহাস। কারণ তারা সাড়ে ২৩ বছর দেশ শাসন করার সুযোগ পাবেন যার মধ্যে ২০ বছরই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশ শাসনের ক্ষমতা পাবেন। পাকিস্তানেরও বাংলাদেশের এত দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার সুযোগ অতীতে কোন দল বা নেতাই পান নি।
কিন্তু এগুলি আসলে বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, কিভাবে আওয়ামী লীগ এতটা শক্তি অর্জন করতে পারলো যার ফলে দলটি বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে পারলো-পারলো দফায় দফায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে?
এক কথায় যদি বলা যায় তবে বলতে হবে দলটির বিশাল এক ঐতিহ্য রয়েছে গণ আন্দোলন করার এবং তাতে নেতৃত্ব দিয়ে সফলতা অর্জন করার। কিন্তু সর্বাধিক সাফল্য দলটির এসেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে যাঁর অসাধারণ যোগ্যতায় এবং অসম সাহশিকতা সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল।
কিন্তু এ দল সম্পর্কে বাঙালির মনে শুধুমাত্র শক্তিশালী প্রচারের মাধ্যমে এবং জাতির চেতনায় ইতিহাস নিষ্ঠতার অভাবে অনেক মিথ্যা বা কল্প কাহিনীরও সৃষ্টি করা হয়েছে বাস্তবে যার অনেকটাই অসত্য বা অর্ধসত্য। যেমন ভাষা আন্দোলনের সমগ্রটাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘটার কাহিনী।
১৯৪৮ সালের মার্চে ভাষা আন্দোলনের শুরু। কিন্তু তখন তো আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী মুসলিম লীগ কোনটারই জন্ম হয় নি। তবু এ আন্দোলনের সৃষ্টি হলো যুব সমাজের নেতৃত্বে। এই যুব সমাজের প্রধান শক্তি ছিল পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বে-আইনী ঘোষিত কমিউনিষ্ট পার্টির উদ্যোগে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নেতৃত্বে। এই যুবলীগটি আজকের যুবলীগ নয়। যে টি আওয়ামী লীগের অঙ্গ বা সহযোগি সংগঠন। এটির জন্মও তখন হয় নি।
১৯৪৮ সালেই পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ গঠিত হয় বামপন্থীদের উদ্যোগে শত পুলিশী বাধা-বিপত্তির মুখে গোপনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে। এই সংগঠন যাঁরা গড়ে তোলেন তাঁদের অনেকেই ঐ বছরের এবং বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃত নেতা। যেমন, গাজীউল হক, আবদুল মতিন, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, রাজশাহীর আতাউর রহমান, পাবনার কে.জি মুস্তফা, আমিনুল ইসলাম বাদশা প্রমুখ। এখন এঁরা কেউই বেঁচে নেই তবে পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক বর্তমানের প্রফেসর এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আজও বেঁচে আছেন। যুবলীগের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা সম্ভবত: তাঁর পক্ষেই এখন সম্ভব। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী যুবলীগকে আজ দু:খজনকভাবে পর্দার আড়ালে ঠেলে দেওয়া হয়েছে যা সত্যকেও আড়াল করছে।
তবে মানতেই হবে সাধারণ যুবসমাজের ভূমিকা ছিল ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে অসাধারণ। একদিকে সরকারীর বেসরকারী বাধা নিষেধ, দমন পীড়নকে উপেক্ষা করে এবং গোপন ও প্রকাশ্য কাজের অপূর্ব সমন্বয় সাধন করে তাঁরা দেশের ভাষা-সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারা এবং গণতান্ত্রিক চেতনা পুনরূদ্ধারে অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন।
আমি ও বর্তমানে দুরারোগ্য রোগে সাভারে সয্যাশায়ী জয়নুল আবেদীন খান পাবনাতে যুবলীগে যোগ দিয়েছিলাম। আমি ছিলাম আহবায়ক কিন্তু বেশী দিন কাজ করার সুযোগ পাই নি কারণ প্রাধান্য দিয়েছিলাম ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলা ও ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে।
মনে করতে পারেন কেউ কেউ আমি “ধান ভানতে শিবের গীত” গাইছি। না, আদৌ তা নয়। ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়ে ক্ষদ্র এক অংশ প্রয়োজনীয় বিবেচনায় সংক্ষেপে তা তুলে ধরলাম মাত্র।
আওয়ামী মুসলিম লীগ-তাবৎ গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ পর্য্যন্ত সন্দেহ নেই কারণ তখন মুসলিম লীগ ছাড়া কার্যত: আর কোন দলের অস্তিত্বই ছিল না। প্রবল সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কবলে পড়ে হিন্দুদের ব্যাপক দেশত্যাগের পরিণতিতে বিভাগ-পূর্ব আসাম্প্রদায়িক দলগুলির কাজের ক্ষেত্রে সৃষ্ট ভয়াবহ পূর্ণতার প্রেক্ষিতেই আওয়ামী লীগকে এ দায়িত্ব পালন করতে হয় যদিও যথেষ্ট পরিমাণে সেই সাংগঠনিক শক্তি তখন পর্যন্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের গড়ে ওঠে নি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ছিল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন। তাদেরকে নিয়েই আন্দোলনে যেতে হতো।
কিন্তু বাহান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠার পরে একদিকে যেমন মুসলিম ছাত্র লীগের আবেদন ছাত্র সমাজের কাছে হ্রাস পেয়েছিল তেমনি ভাষা আন্দোলনের প্রধান প্রধান নেতারাই ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলায় তার আবেদন দ্রুতই ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রদেশ ব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। তদুপরি বামধারার চেতনায় নতুন নেতা কর্মীও ঝুঁকে ঝুঁকে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেওয়ায় প্রচন্ড গতিবেগ সৃষ্টি হয় তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনে।
কিন্তু প্রকাশ্যে ছাত্র ইউনিয়নের অভিভাবক বা তার প্রতি বন্ধু সুলভ কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে ছাত্র ও গণ আন্দোলনের অধিকতর বিস্তৃতি ঘটানোর লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়নও হয়ে পড়ে ছাত্র লীগের সাথে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বিশ্বস্ত সহযাত্রী। এভাবে তখন থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগ যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নব উন্মেষ ঘটাতে সচেষ্ট ছিল তা সহজতর হয় ছাত্র ইউনিয়নের ঐ ভূমিকার ফলে। ফলে ঘটতে থাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে বামপন্থা উপাদানের অবিস্মরনীয় সম্মিলন। এটা আমাদের দেশের ক্রমবিকাশমান গণ-আন্দোলনের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য যার অস্তিত্ব বজায় ছিল নব্বই এর দশক অবধি মূলত:। এবং ঐ পর্য্যন্ত সকল বাধা-বিপত্তিকে পেছনে ঠেলে গণ-ঐক্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছিল। অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীতে ঐ গতি স্বভাবত:ই মন্থর হয়ে এসেছিল। সে সংকট নব্বই পরবর্তীতে দিনে দিনে আরও তীব্র হয়ে উঠছে।
যা হোক আওয়ামী লীগের সর্বাধিক বড় অবদান গণতন্ত্রের সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪র নির্বাচনের ঐতিহাসকি বিজয়। ১৯৬৬ তে ছয় দফা আন্দোলন এবং সব শেষে ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান। আবার লক্ষ্যনীয় যে এ পর্য্যন্ত তাবৎ আন্দোলনে এক অসাধারণ সংশ্লেষ ঘটেছিল জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের সাথে বামপন্থী শক্তির। ফলে উভয়েই লাভবান হচ্ছিল দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল প্রতিক্রিয়ায় শক্তিগুলি পিছু হটছিল।
আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করা বা দলটির অসাম্প্রদায়িকী করণ করার ক্ষেত্রে যেমন অবদান ছিল শেখ মুজিবর রহমানের তেমনই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন মওলানা ভাষানী ও দেশের বামপন্থীরা। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে “মুসলিম” শব্দটি তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়।
ঐ একই বছরে আতাউর রহমান খানের পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার এবং কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মাত্র ১২ জন দলীয় সাংসদ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান দলের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। পর্ব-বাংলার সরকারের সাথে গণতন্ত্রী দলের মাধ্যমে বাম-প্রগতিশীল শক্তির সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ফলে বাংলাদেশ (ঐ দলগুলির নিরন্তর প্রচেষ্টায়) অত্যন্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে গন্তব্য পথ নির্ধারণ করে নিতে পেরেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনাত্তর চার রাষ্ট্রীয় মৌল নীতি ও সেভাবেই চূড়ান্তরূপে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যার দালিলিক প্রমান দলগুলির মেনিফেষ্টোতে, একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ঘোষিত দিক নির্দেশনায় এবং বাহাত্তরের সংবিধানে বিধৃত হয়। গৌরবের চূড়ান্ত শিখরে আরোহন করলো বাংলাদেশ ও তার নেতৃত্ব।
নেতৃত্বের ব্যপারটা বাস্তবতার নিরীখে আমাদের চিন্তা-চেতনায় থাকা দরকার। শৈশবে আওয়ামী মুসলিম লীগের যে বিকাশ ঘটাছিল তাতে বিশাল অবদান ছিল দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। তাঁর সাম্প্রদায়িক চেতনা। দরিদ্র-শোষিত মানুষের বিশেষত কৃষকের স্বার্থের অনুকূলে দৃঢ় ভূমিকা এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষন নি:সন্দেহে আওয়ামী লীগ জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু ১৯৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী কেন্দ্রে প্রধান মন্ত্রী হিসেবে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করায় মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরস্থ ও বাহিরে অবস্থানকারী বন্ধুসুলভ বামপন্থী শক্তিসমূহ ঐ নীতির তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন এবং এরই এক পর্য্যায়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বহু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী দল থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত “নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী “পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)” নামে সারা পাকিস্তানব্যাপী বামধারার একটি প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক দলের জন্ম হয়। একমাত্র এই দলটিরই পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশেই শাখা প্রকাশনার বিস্তার ঘটেছিল মুসলিম লীগ ছাড়া। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শক্তিশালী দল হলেও তার বিস্তৃতি প্রথম থেকে শেষ পর্য্যন্ত পূর্ব বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ কথার সত্যতা ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে যথার্থভাবে প্রমাণিত হয়েছিল।
১৯৭০ এর নির্বাচনে পূর্ববাংলার প্রায় সব ক‘টি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তান একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের কোনটাতেও একটি আসনও পায় নি।
অথচ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি খান আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে যথাক্রমে গাউস বখশ বেজেঞ্জোর নেতৃত্বে আফগানিস্তানে এবং খান আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ন্যাপের সরকারও গঠন করেছিল। ওয়ালী ন্যাপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সমর্থন দিয়েছিল এবং সে কারণে সেখানকার অনেক নেতাকে ইয়হিয়া সরকার কারারুদ্ধও করেছিল।
এভাবে নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্যে দিয়ে চললেও, পূর্বেই বলেছি, নব্বই এর দশক পর্য্যন্ত আওয়ামী লীগ আদর্শিক চেতনায় দৃঢ় ছিল-জনতার ঐক্যও অটুট ছিল। বামপন্থীদের নীতিনিষ্ঠ অবস্থান এ কাজে আওয়ামী লীগের প্রচন্ড এক সহায়ক শক্তি হিসেবেও বিরাজ করছিল।
কিন্তু ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ও রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আদর্শগত ভয়ানক মতানৈক্যের সৃষ্টি হওয়ায় তার অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মত বাংলাদেশের সদ্য বিকাশমান বামপন্থী আন্দোলনেও মারাত্মক বিভক্তি ঘটে। এর ফলে দ্বিখন্ডিত হয় ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি প্রভৃতি। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বামপন্থী শক্তিগুলি ঐ বিভক্তিজনিত দুর্বলতা বহুলাংশে কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হলেও তা প্রয়োজনমত শক্তি সংগ্রহ করে আর দাঁড়াতে পারে নি।
এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ প্রধানতম ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যালীলার পর একদিকে যেমন দলটি আদর্শিক বিপর্য্যয়ের মুখে পড়ে যায় তেমনই তারা একটানা একুশ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে লিপ্ত থাকলেও তার আদর্শিক অবস্থান ক্রমাগতই দুর্বল হতে থাকে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। নতুন করে ক্ষমতায় এসে পাঁচ বছরের মেয়াদ কালে ক্ষমতায় দলটি নতুন করে আসা এবং দীর্ঘদিনের ক্ষমতা-বহির্ভূত থাকাজনিত প্রশাসন কেন্দ্রের সমস্যা সমূহ, তার নানান জটিলতাকে অনভিজ্ঞ চিত্তে দূর করার কাজে ব্যাপৃত থাকতে হয়। ঐ সময়ে সৃষ্ট আরও নানা জটিলতা দলটিকে নানা বিপর্য্যয় ও তা সাধ্যমত প্রতিরোধের কাজে নিয়োজিত থাকতে ও বিএনপি জামাতের মত শক্তিকে প্রতিরোধের কাজেই বেশী লিপ্ত থাকতে হয়েছে। আবার আদর্শিক পদসম্মানের শরু হয়।
যেমন, স্বৈরাচার পতনের পর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এরশাদের বিরুদ্ধে আনীত বহু দুর্নীতি মামলা বিচারাধীন থাকা সত্বেও একটি মামলায় তিনি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী হিসেবে থাকাবস্থায় বেশ কয়েকটি মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া এবং সাজা শেষ হতেই এরশাদকে আর বেশ কিছু মামলায় বিচারধীন থাকা সত্বেও তাঁকে জামিনে মুক্তি প্রদান করে জাতীয় পার্টিকে মিত্র দল হিসেবে দাঁড় করানো।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় বিরোধী দলীয় অবস্থানে গেলে ক্ষমতাসীন বি এন পিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে দিব্যি জামায়াতের সাথে হাত মিলিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়ে আওয়ামী লীগ। সেই আন্দোলন দীর্ঘ মেয়াদী হরতাল, সংসদ বর্জনেরও রূপ নেয়। দেশ জুড়ে জামায়াতের সাথে যৌথ সমন্বয় কমিটি গঠন করে আন্দোলনও করে। এভাবেই দলটি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ক্রমাশ:ই আদর্শচ্যুতির শিকারে পরিণত হতে থাকে।
এর পর জরুরী অবস্থার কারণে বা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক সৃষ্ট পরিস্থিতির নানাবিদ ধকল কাটিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আশাতীত বিজয় অর্জন, দুই-তৃতীয়ংশের চাইতে অনেক বেশী আসনের জিতে আসার কারণে প্রচন্ড আশাবাদের সৃষ্টি হয় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মনে। ধারণা করা হলো আওয়ামী লীগ এখন নিজ শক্তিবলে বলীয়ান হওয়ার ফলে তার প্রতিশ্রুতি এবং বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি যা ১৯৭২ সালে প্রণীত ও গৃহীত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সংসদে-বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সংসদে তা পুনরায় সংবিধান সংশোধনী এনে অবিকল পুন:স্থাপন করা হবে। কারণ মাঝখানে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথমে জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনী এনে “বিসমিল্লাহ” সংযোজন করেন, জামায়াতে ইসলামী সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলকে বৈধতা প্রদান করেন, অবৈধভাবে পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আজমকে বাংলাদেশে থাকার সুযোগ প্রদান করেন এবং অত:পর হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, অষ্টম সংশোধনী এনে “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজিত করে বাহাত্তরের সংবিধানকে কলংকিত, কলুষিত ও তার পাকিস্তানীকরণ করেছিলেন, ২০০৮ এর সংসদে তা সহজেই বাতিল করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে আসার পথটা সহজ হলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথে হাটলো না।
অত:পর ভিন্ন এক মোকর্দমার রায়ে হাইকোর্ট জিয়ার পঞ্চম ও এরশাদের অষ্টম সংশোধনী বাতিল ও বে-আইনী ঘোষণা করলে এবং এর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আপীল সুপ্রিম কোর্টও ঐ রায় বহাল রেখে রায় দিলে সে রায় মোতাবেক ঐ জিয়া এরশাদের আবর্জনা বাতিল হয়ে গেলে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাদ বাকী সবাই তাকে অভিন্দন জানালো।
কিন্তু আওয়ামী লীগ? তারা ঐ রায়ের ভিত্তিতে কোন গেজেট প্রকাশ না করে উল্টো পঞ্চদশ সংশোধনী নামক কুখ্যাত সংশোধনী এনে দিব্যি জিয়া এরশাদের সংশোধনীগুলি সংবিধানে পূর্নবহাল করে বাহাত্তরের চার রাষ্ট্রীয় মূল নীতি ও নামকা-ওয়াস্তে এবং লোকের সামনে নিজেরা ধর্মনিরপেক্ষতা সহ বাহাত্তরের মূল সংবিধানে শ্রদ্ধাশীল এমনটি বুঝানোর সুযোগ তৈরী করলেন। কিন্তু কারও কি বুঝতে বাকী থাকলো যে সংবিধান ও রাষ্ট্রের ইসলামীকরণ পাকিস্তানীকরণ দিব্যি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শুরু করা হলো?
আজকের আওয়ামী লীগ যে কোন মতেই বঙ্গবন্ধুর ও মুক্তিযুদ্ধের নীতি আদর্শকে সমুন্নত রেখে চলার আওয়ামী লীগ নয় বরং তা আওয়ামী মুসলিম লীগের বা এমন কি, মুসলিম লীগের চাইতেও আর্দশগতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল তা দিব্যি বহুবিধ কাজে প্রমাণিত হচ্ছে ।
হ্যাঁ, এই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু/চারটি দু:সাহসী কাজও করে নি:সন্দেহে প্রসংসার পাত্র হয়েছেন। যেমন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও তার রায় বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচার ও তাদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায় বাস্তবায়ন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি পদ্মাসেতু প্রকল্পের টাকা দিতে অস্বীকার করলে নিজস্ব অর্থে তা নির্মানের প্রত্যয় ঘোষনা এবং ইতোমধ্যেই সেতুটির নির্মান কাজের প্রায় ৪০ ভাগ সম্পাদন উল্লেখ যোগ্য।
কিন্তু এতে যা অর্জিত হবে গোলাম সেই ধান পোকায় খেয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও তো পাকাপাকি করা হচ্ছে। উগ্র ধর্মান্ধ হেফাজতে ইসলামীর দাবী মোতাবেক পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকী করণের লক্ষ্যে তাদের নির্দেশিত পাঠ্যক্রম চালু করা, কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মাষ্টার্স ডিগ্রীর মর্যাদা প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মত এক মুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবী ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে মাদ্রাসা শিক্ষাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে তাদের সিলেবাস প্রণয়নে সরকার আদৌ হাত খেলাবে না হেফাজতের এই দাবীর কাছেও নীতি স্বীকার করে। পরিণতি বাংলাদেশর জন্য যে কত ভয়াবহ রূপ নেবে তা বুঝতে আরও ১০ থেকে ২০ বছর লেগে যেতে পারে। কিন্তু তখন আর শোধরার সুযোগ পাওয়া যাবে না।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে ভাস্কর্য্য অপসারণ সংক্রান্ত হেফাজতের দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন জেনেও তাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্য্যায় থেকে তা সরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে যে বাঙালী সংস্কৃতিকে কুঠারাঘাতও করা হলো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনাশ্রয়ীরা যে তার বিরোধিতা করলেন তা আমলে বিন্দুমাত্র না নিয়ে ভবিষ্যত বাংলাদেশের যে রূপরেখা আওয়ামী লীগ হাজির করছে তা রীতিমত ভয়ংকর। যেন তাদের কমিটমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নয় তা বরং জামায়াত হেফাজত জিয়া এরশাদের প্রতি।
তাই ৬৮ বছরে এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামক ঐতিহ্যবাহী বৃহৎদলটি আজ দ্রুত পেছন দিকে ধাবমান। বাঙালীর, মুক্তিযুুদ্ধের, বঙ্গবন্ধুর , চার জাতীয় নেতার লালিত স্বত্তাকে আজ এক মারাত্মক বিপর্য্যয়ের মুখে পরিকল্পিত ভাবেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন।
মূলত: প্রবাসী মুষ্টিমেয় কয়েকজন কলাম লেখক এই প্রক্রিয়াকে প্রকারান্তরে সমর্থন দিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আঘাত হানছেন। যত সত্বর তাঁরা যত সত্তর বুঝবেন ততই মঙ্গল। শত্রুর নাকি আদর্শের সাথে অহেতুক আপোষ, এবং তা শুধুমাত্র ভোটের আস্তির ও নিন্দনীয় প্রত্যাশায়, কদাপি দেশ ও জাতির মঙ্গল ডেকে আনে না, আনে নি কোনদিন, আনবেও না আগামী দিনগুলিতে। এই সনামধন্য লেখকদের লেখায় শেখ হাসিনা নন-অন্য মন্ত্রী.এম.পি রাই এগুলি ঘটাচ্ছেন এবং প্রধান মন্ত্রী একা তার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এমন উক্তি দেখে সম্ভবত: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিস্মিত বোধ করছেন।
যা হোক, আওয়ামী লীগকে গ্রহণযোগ্য করে রাখতে হলে আপোষকামিতা ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর পথে প্রগতির শক্তিগুলির সাথে একত্রে লড়াইয়ে নামতে হবে সাম্প্রদায়িকীকরণ পাকিস্তানীকরণ প্রতিরোধে। এ এক ধর্ম যুদ্ধতুল্য- যাতে আপোষের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আশা করি দলটির নেতাদের এবং কর্মীদের শীঘ্রই বোধোদয় হবে। আত্মহনননের পথ থেকেও আওয়ামী লীগ হয়তো সরে আসবে। বাংলাদেশ অত্যাসন্ন ভয়াবহ বিপর্য্যয় থেকেও হয়তো রক্ষা পাবে।


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!