টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা

অনলাইন ডেস্ক  কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার তারিখ বাতিলের ঘোষনা দেন। এই ঘোষনার সাথে সাথে সমগ্র বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে; টাঙ্গাইলেও শুরু হয় জঙ্গী মিছিল। মিছিলের স্লোগান ছিল ‘‘ইয়াহিয়ার ঘোষনা বাঙ্গালীরা মানবে না’’, ‘‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, আমরা গড়ব নতুন দেশ নাম হবে তার বাংলাদেশ’’। ছাত্র যুবক জনতার নেতৃত্বে টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন থানা ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রামগঞ্জে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্ত্ততিমূলক সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এই সকল সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন প্রধানতঃ সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যবৃন্দ। এই ধারাবাহিকতায় মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজে ক্যাডেট কোরের ড্যামি রাইফেল দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

টাঙ্গাইল শহরে বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে উল্লেখ থাকে যে, জনাব এনায়েত করিম ও কাদের সিদ্দিকী দুজনেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একসময় কর্মরত ছিলেন। উক্ত কুচকাওয়াজে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দপ্তর সম্পাদক জনাব আব্দুর রশীদ সালাম গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ঢাকায় নীরিহ-নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালায়।

২৬ মার্চ টাঙ্গাইল থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্ত্ততি। তৎকালীন এমপিএ জেলা আওয়ামীলীগ নেতা বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয় হাই কমান্ড। হাই কমান্ডের সদস্য ছিলেন টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত সকল এম.এন.এ ও এম.পি.এ এবং এডভোকেট নূরুল ইসলাম। শ্রমিক নেতা হাবিবুর রহমান খান প্রমূখ। উক্ত হাই কমান্ডের ‘কমান্ডার ইন চীফ’ এর দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা এমপিএ আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। এডভোকেট নূরুল ইসলামের পূর্ব আদালতপাড়াস্থ বাসভবনে অনুষ্ঠিত একসভায় এই হাই কমান্ড গঠিত হয়।

২৭ মার্চ বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত এক জনসভার মাধ্যমে হাই কমান্ডের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং হাই কমান্ড টাঙ্গাইলের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তৎকালীন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা খন্দকার আসাদুজ্জামান সিএসপি টাঙ্গাইল এসে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন ঘোষনা করেন এবং তাকে হাই কমান্ডের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। টাঙ্গাইলের তৎকালীন জেলা পরিষদ কার্যালয় (পুরাতন ফৌজদারী ভবন) হাই কমান্ডের কার্যালয় করা হয়। হাই কমান্ডের অফিস সেক্রেটারীর দায়িত্বে ছিলেন নৈয়ম উদ্দিন আহমেদ মুক্তার। হাই কমান্ডের সর্বাধিনায়ক জনাব আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু হয় এবং বিভিন্ন স্কুল কলেজের ল্যাবরেটরী থেকে এসিড সংগ্রহ করে হাত বোমা ও মলোটন্ড ককটেল তৈরী করা শুরু হয়। এই কাজে বামপন্থী ছাত্রনেতা বুলবুল খান মাহবুব, শ্রমিক নেতা সৈয়দ আব্দুল মতিন প্রমূখ সক্রীয় ভূমিকা রাখেন। ঐ সময় টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি অবস্থান করছিল।

২৭ মার্চ ভোরে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ছাত্র যুবসমাজ তাদেরকে ঘিরে ফেলে। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈন্যরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বেরিয়ে আসে। কোম্পানি কমান্ডার মেজর কাজেম কামালসহ পাকিস্তানী ২ জন অফিসারকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মেজর শফি উল্লাহ এসে তাদের হত্যা করেন। এক পর্যায়ে মার্চ মাসের শেষেরদিকে মেজর শফি উল্লাহর নেতৃত্বে জয়দেবপুর থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈন্যরা অস্ত্র গোলাবারুদ ও সামরিক যানসহ টাঙ্গাইলে আসেন। হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে তাদেরকে টাঙ্গাইলে সন্বর্ধনা দেয়া হয়। পরে তারা ময়মনসিংহ এর দিকে চলে যান।

মির্জাপুর থানার গুড়ান সাটিয়াচড়া নামক স্থানে ছাত্রজনতা ও ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরী করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন এমপিএ ফজলুর রহমান ফারুক। ৩ এপ্রিল পাকবাহিনী টাঙ্গাইলে প্রবেশ পথে গুড়ান সাটিয়াচড়া নামক স্থানে এসে পৌঁছলে তুমুল প্রররোধের সম্মুখীন হয়। কয়েক ঘন্টা যুদ্ধের পর ছাত্র যুবক ও ইপিআরের প্রতিরোধ বুহ্য ভেঙ্গে পড়ে। ৬ জন ইপিআর ও ছাত্রলীগ নেতা জুমরাতসহ ৩৩৭ জনকে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে এবং গুড়ান সাটিয়াচড়া গ্রাম ২টি আগুনে ভস্মীভূত করে। পরে তারা ঐদিনই বিকেলের দিকে টাঙ্গাইলে প্রবেশ করে।

পাকবাহিনী টাঙ্গাইলে প্রবেশের সময় যে মর্টারসেল নিক্ষেপ করেছিল সেই মর্টারসেলের আঘাতে শহরের পাড়দিঘুলীয়া গ্রামের শাহাবুদ্দীন মাস্টার, তার পুত্র ছাত্রলীগ নেতা ছানোয়ার হোসেন অনু এবং যুবক আব্দুল কদ্দুস শাহাদত বরণ করেন।

পাকবাহিনী টাঙ্গাইলে আসার ঘোষনা বামপন্থী শ্রমিক নেতা সৈয়দ আব্দুল মতিন সকল ভয়ভীতি উপক্ষো করে শহরে প্রচার করেন। পাকবাহিনী শহরে প্রবেশ করে খন্দকার আসাদুজ্জামানের বাড়ী, বদিউজ্জামান খানের বাড়ী, এডভোকেট নূরুল ইসলামের বাড়ী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং জনাব আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর বাড়ী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পাক বাহিনী টাঙ্গাইলে প্রবেশের পূর্ব মূহুর্তে খন্দকার আসাদুজ্জামানের সহায়তায় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ফারুক আহমদ, মোঃ সরওয়ার্দী, এনএ খান আজাদ, মিন্টু খান, সুখন, কালা ফারুক প্রমুখ টাঙ্গাইল ট্রেজারি থেকে পুলিশের সকল রাইফেল, গোলাবারুদ ২টি ট্রাকে করে নিয়ে প্রথমে ঘারিন্দা ও পরে বিভিন্নভাবে টাঙ্গাইলের পাহাড়ী এলাকা বর্তমান সখিপুর উপজেলাধীন মরিচা নামক স্থানে নিয়ে যান। পরবর্তীতে কাদেরীয়া বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে এই অস্ত্রগুলো একটি সহায়ক শক্তি হিসাবে পরিগণিত হয়।

টাঙ্গাইল হাই কমান্ডের সর্বাধিনায়ক আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ইপিআরের একটি বাহিনী নিয়ে ঘাটাইল কালিহাতীর হামিদপুর বেতড়ুবা নামক স্থানে প্রতিরোধ বুহ্য রচনা করেন। কাদের সিদ্দিকীসহ ছাত্র যুবকেরাও এই প্রতিরোধে অংশ নিয়েছিল। ঐ স্থানে পাক বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হতে থাকে। শওকত মোমেন শাজাহান, হামিদুল হক, ইদ্রিস আলী প্রমুখের নেতৃত্বে পাহাড়ী এলাকায়, আনোয়ারুল আলম শহীদ, মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী, নূরুন্নবী, আজীজ বাঙ্গাল, সৈয়দ জিয়া আব্দুল আলীম, আবুল কালাম আজাদ, আঃ কদ্দুস, এনায়েত করিম, সোহরাব আলী খান আরজু, খোদা বক্স,আমানউল্লাহ বুলা, সৈয়দ শাজাহান প্রমুখের নেতৃত্বে ভূঞাপুর এলাকায়, সৈয়দ নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে গোলড়া এলাকায় এবং খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে নাগরপুর এলাকায় মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হতে থাকে। পরবর্তীতে আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে সর্বাধিনায়ক স্বীকার করে খন্দকার আব্দুল বাতেন ছাড়া সকলেই তার নেতৃত্ব মেনে নেয়। এইভাবে গড়ে উঠে টাঙ্গাইলের বিশাল কাদেরীয়া বাহিনী। কাদেরীয়া বাহিনী গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে ফারুক আহমদ সার্বক্ষনিকভাবে তার সাথে থেকে এই বাহিনী গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে মে মাসের দিকে নাট্যকার মামুনুর রশিদ, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, কবি রফিক আজাদ, কবি মাহবুব সাদিক প্রমুখ কাদেরীয়া বাহিনীতে যোগ দেন।

মে মাসে সখিপুরের মহানন্দপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। আনোয়ারুল আলম শহীদকে বেসামরিক প্রধান ও হামিদুল হককে উপ-প্রধান নিয়োগ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি সাপ্তাহিক মুখপাত্র‘‘রণাঙ্গন’’ প্রকাশিত হতে থাকে। এর সম্পাদক ছিলেন রনদূত (আনোয়ারুল আলম শহীদ), সহ-সম্পাদক ফারুক আহমদ ও সৈয়দ নূরুল ইসলাম। বেসামরিক প্রধানকে সহায়তা করার জন্য সৈয়দ নূরুল ইসলাম,ফারুক আহমদ ও আব্দুল্লাহ কে বেসামরিক প্রধানে বিশেষ সহকারী নিয়োগ করা হয়। আব্দুল আওয়াল সিদ্দিকী ও সরু আলী আজগরকে গণ সংযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়। মোয়াজ্জেম হোসেন খান, এনায়েত করিম,আব্দুল আলীম, সৈয়দ জিয়া, আব্দুল হামিদ ভোলা ও খন্দকার নূরুল ইসলামকে আঞ্চলিক বেসামরিক প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিশাল কাদেরীয়া বাহিনীকে প্রায় ৯৭টি কোম্পানিতে ভাগ করা হয়।

মুক্তিবাহিনীর প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টার ছিল সখিপুরের বহেড়াতলীতে। মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টার থেকে রণাঙ্গন পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন দলিল স্ট্যাম্প, বিয়ের কাবিন নামা ও বিভিন্ন ফরম ছাপানো হতো। কাদেরীয়া বাহিনী প্রধান লিঁয়াজো অফিসার ছিলেন মোহাম্মদ নূরুন্নবী (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) এবং লিয়াজো অফিসার ছিলেন নূরুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও এ এম এনায়েত করিম। পরবর্তীতে এ এম এনায়েত করিমকে কাদেরীয়া বাহিনীর প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। কাদেরীয়া বাহিনী ছোট বড় অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রতিটি যুদ্ধে অসাধারণ নৈপূণ্য প্রদর্শন করে হানাদার বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পর্যদস্ত করেছে। কাদের সিদ্দিকী এবং কাদেরীয়া বাহিনীর নাম মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই ছিল পাকহানাদার বাহিনীর জন্য চরম আতংকের। কাদেরীয়া বাহিনী একই সঙ্গে হিট এন্ড রান গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি এবং মুক্তাঞ্চল তৈরি করে সম্মুখ যুদ্ধের রণনীতি ও রণ কৌশল ব্যবহার করেছে। টাঙ্গাইলের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলোর মধ্যে গোড়ান-সাটিয়াবাড়ীর যুদ্ধ, কালিহাতী ও বল্লার যুদ্ধ, কামুটিয়ার যুদ্ধ, যমুনা নদীর সারিয়াকান্দী মাটিকাটার বিখ্যাত জাহাজ মারার যুদ্ধ, ধলাপাড়ার (মাকরাই) যুদ্ধ, নখিরপুরের যুদ্ধ সহ অসংখ্য ছোট বড় যুদ্ধ। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরীয়া বাহিনীর দামাল যোদ্ধারাই ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে প্রথম ঢাকা শহর দখল করে পল্টনে প্রথম জনসভা করে।

কাদেরীয়া বাহিনীতে পাঁচটি সেক্টরের অধীনে ৯৭টি কোম্পানী ছিল। কোম্পানী প্রধানদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে ছিলঃ-

১। কাদেরীয়া বাহিনীর অর্ন্তভূক্ত সমস্ত এলাকা দ্রুততার সাথে পরিভ্রমণ করা।

২। স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে উৎসাহ দান।

৩। প্রয়োজনবোধে রাস্তা-ঘাট ভেঙ্গে দেয়া (হানাদারদের চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য)।

৪। চুরি-ডাকাতি নিবারণ। কুখ্যাত চোর ডাকাতদের স্থানীয় জনসাধারণের পরমর্শ নিয়ে শাস্তি বিধান করা।

এছাড়া ২৩ নং ইঞ্জিনিয়ারি ও সিগনাল প্লাটুনের উপর দায়িত্ব ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সদস্যদের খবরা-খবর সম্ভলিত একটি নিখুঁত তালিক প্রণয়ন করে ১৫ দিনের মধ্যে অধিনায়কের নিকট পেশ করা বিভিন্ন জায়গা থেকে টেলিফোনের তার এনে এলাকার দূর্গোম স্থান সমূহের সাথে প্রধান কার্যালয়ের সংযোগ স্থাপন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কাদেরীয়া বাহিনীর কমান্ডারদেরকে কঠোরভাবে যেসব নীতিমালা মেনে চলার জন্য নির্দেশ দেন, তা হলোঃ

১। কোন কোম্পানী কমান্ডার কোন লোককে কোনও অপরাধের জন্য একক ক্ষমতাবলে মৃত্যুদন্ড দিতে পারবে না।

২। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে সম্ভব হলে তাকে বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীর নিকট প্রেরণ করতে হবে।

৩। সাধারণ ছোট খাটো ব্যপারে স্থানীয় অবস্থার উপর দৃষ্টি রেখে মীমাংসা করতে হবে।

৪। খুন ও নারী ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্তকে কোন কোম্পানী কমান্ডার নিজ ক্ষমতাবলে মুক্তি দিতে পারবে না।

৫। খুন ও ধর্ষণের চেয়ে কম অপরাধমূলক যেকোন ঘটনার বিচার কমান্ডাররা করতে পারবে। প্রতিটি বিচার সালিশের রেকর্ড সদর দপ্তরে পাঠাতে হবে।

৬। কোন বিচার এককভাবে করা যাবে না। কমপক্ষে দু’জন সহযোদ্ধা ও একজন স্থানীয় ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করে সম্পন্ন করতে হবে।

৭। বিশেষ অপরাধের (যেমন- খুন, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ) বিচারের জন্য অভিযুক্ত কেউ সদর দপ্তরে পাঠানো অনেক সম্ভব নাও হতে পারে। এমতাবস্থায়, কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার, একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও ৩জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত একটি ‘বিচার সভা’ অপরাধীকে চরমদন্ড প্রদান করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৪ জনকে একমত হতে হবে।

৮। যুদ্ধে ধৃত কোন ব্যক্তির সাথে অসদাচরণ করতে পারবে না। খবর সংগ্রহের জন্য যদি কিছু করার প্রয়োজন হয়ে পরে সেটা ব্যতিক্রম। কোন সশস্ত্র সৈন্যও যদি অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পন করতে চায় বা করে তাহলে তার প্রতি ন্যায় বিচার করতে হবে।

৯। কোন অপরাধের সন্দেহে ধরে আনা কোন লোক সত্যিকারভাবে অপরাধী প্রমাণীত হলেও তার আত্মীয় স্বজন, পিতা-মাতা বা পুত্র কন্যার সাথে অসম্মানজনক ব্যবহার করা চলবে না।

১০। কোন ব্যাপারে সকলে একমত হতে না পারলেও সংখ্যা গুরুর রায়কে সঠিক বলে মেনে নিতে হবে।

এসব নীতিমালা প্রণয়নের পর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর প্রধানত দু’টি দায়িত্ব অর্পন করা হয়। এলাকার শান্তি শৃংখলা রক্ষা ও শত্রুর মোকাবেলা করা। কোম্পানী কমান্ডারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শওকত মোমেন,ফজলুর রহমান, নবী নেওয়াজ, লোকমান হোসেন, আবদুল হাকিম, আলী হোসেন লাল্টু, সরোয়ার হোসেন, মনিরুল ইসলাম, আফসার উদ্দিন আহমেদ, হাবিবুর রহমান (শহীদ), হাবিবুর রহমান, মোকাদ্দেস আলী খান,আবদুল গফুর, খোরশেদ আলম তালুকদার, খোরদেশ আলম, রেজাউল করিম, আশরাফ হুমায়ুন, আমানুল্লাহ, মতিউর রহমান, গোলাম মোস্তফা, আব্দুর রাজ্জাক, লুৎফর রহমান, আনিছ, আনসারী আলী, আব্দুল কদ্দুছ (ইদ্রিস আলী), ফেরদৌস আলম, আরজু, হাবিবুল হক বেনু, আজাদ কামাল, মইন উদ্দিন আহমেদ, আঙ্গুর তালুকদার, রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার প্রমুখ। মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য গ্রামে গ্রামে স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী গঠন করা হয়। এরপর শুরু হয় সুপরিকল্পিত উপায়ে মুক্তিযুদ্ধ। উল্লেখ্য ৩ মে ১৯৭১ সখিপুরের বাঘেরবাড়ীর পাশে মরিচাতে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধের টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীদের প্রথম শিবির স্থাপিত হয়। এখান থেকে কয়েকটি দলে ভাগ করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের এলাকার সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গৃহীত হয়।

মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিত ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে ১১ টি সেক্টর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তাছাড়াও অতিরিক্ত একটি সেক্টর বেসামরিক প্রক্রিয়ায় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে। টাঙ্গাইল জেলা (আরিচা নগরবাড়ী থেকে ফুলছড়ি বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত নদীর সর্বত্র), জামালপুর, নেত্রকোণার অংশ বিশেষ, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ জেলার ব্যাপক অংশ এবং গাজীপুর ও ঢাকা জেলার উত্তরাঞ্চল এই বাহিনীর যুদ্ধাঞ্চল ছিল। ইতোমধ্যে হানাদার বাহিনী জেলার সর্বত্র নিরীহ জনগণের উপর অমানুষিক নির্যাতন, অত্যাচার শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও একের পর এক হানাদারদের উপর আঘাত হানতে থাকে। পাকসেনারা ঘাটি থেকে বেরুলেই তাদের আঘাত করা হতো। জনগণের বিশেষকরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর চলাফেরার খবর সংগ্রহ করতো। মুক্তিবাহিনী জেলা সর্বত্র হানাদারদের উপর চাপ অব্যাহত রেখে টাঙ্গাইল শহের গ্রেনেড হামলা চালায়। এই গ্রেনেড বাহিনীর বিশেষ করে বাকু (শহীদ),সালাউদ্দিন (শহীদ) ও কালাম এদের বীরত্বগাথা অতুলনীয়। নদী, চর, খাল-বিল আর গজারি বন ঘেরা টাঙ্গাইল জেলার পাহাড়ী এলাকা মহান্দপুর ও সখিপুরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে মুক্তিবাহিনীর র্দুজয় ঘাটি। আনোয়ার-উল-আলম শহীদকে দেয়া হয় পরিচালনায় সরকারের বেসামরিক প্রশাসন এর দায়িত্ব। আন্দিগ্রামে গড়ে উঠে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আর অস্ত্রাগার। ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী, ডাঃ নিশি কান্ত সাহা ও আমজাদ হোসেনের তত্ত্ববধানে প্রতিষ্ঠিত হয় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হাসপাতাল।

এপ্রিল মাসে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে টাঙ্গাইলের আবদুল হামিদ খান ভাসানী সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বহির্বিশ্বে সরকারের প্রধান দূত নিযুক্ত হন। সরকারের প্রচার অভিযানের দায়িত্ব পান তথ্য ও বেতার মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এম. এন. এ(মন্ত্রীর মর্যাদা) টাঙ্গাইলের সাংসদ আবদুল মান্নান। শামসুর রহমান খান শাহজাহান আঞ্চলিক প্রশাসনিক কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব পদে শাহাজাহান সিরাজ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ২ মার্চের পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে তিনি স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমানের (জাহাজমারা হাবিব) একটি অপারেশন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল অনেক বাড়িয়ে দেয়। কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ ও স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে কমান্ডার হাবিবুর রহমান জানতে পারে এস.ইউ. ইঞ্জিনিয়ারর্স এল সি- ৩ এবং এস টি রজার নামে পাকিস্তান নৌবাহিনীর দু’টি জাহাজ অস্ত্র গোলাবারুদ বোঝাই করে উত্তরবঙ্গের দিকে যাচ্ছে। তিনি তার কোম্পানী নিয়ে মাটিকাটা গ্রামে নদরি বাঁকে যুৎসই পজিশন নেন এবং সুযোগ বুঝে (১২ আগস্ট ১৯৭১) তিন ইঞ্চি মর্টার চালিয়ে জাহাজের ইঞ্জিনভাগ ধ্বংস করেন। পাকিস্তানি নাবিকরা নদীতে ঝাপ দিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর হাজার খানেক স্বেচ্ছাসেবক, শতাধিক নৌকা দিয়ে জাহাজের অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে, জাহাজ মারার নেপথ্যের কৃতিত্বের দাবিদার জাহাজের সারেং ও সুখানীরা। তারাই দেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে জাহাজ গুলোকে নদীর চড়ায় আটকিয়ে দিয়ে মুক্তি বাহিনীকে খবর দেয়। তাদের নাম সংরক্ষিত করা হয়নি বলে আজ তা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। যতদুর জানা যায় তারা সকলেই নোয়াখালি অঞ্চলের অধিবাসী ছিল। তারপর লাগিয়ে দেন আগুন। জাহাজের সেই আগুন এতাটা প্রকান্ড আকার ধারণ করে যে বহুদূর থেকে লাখ লাখ মানুষ মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে উল্লাসে ফেটে পড়ে। ঢাকা থেকে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্লেন এসে মুক্তিবাহিনীর উপর গোলাবর্ষণ করে। এতে মুক্তিবাহিনীর কিছু ক্ষতি হয়। কিন্তু জাহাজ ধ্বংসে এতোটা বড় ক্ষতি পুরো পাঁচ মাসের যুদ্ধে পাকবাহিনীর কখনো হয়নি। কারণ অস্ত্র বোঝাই জাহাজটি ধ্বংসের ফলে পুরো উত্তরবঙ্গে পাকবাহিনীর অপারেশন ক্ষমতা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। জাহাজের লগবুক ও মুভমেন্ট কভারের হিসেবে জাহাজে একলক্ষ বিশ হাজার বাক্সে ২১ কোটি টাকার অস্ত্র-শস্ত্র ছিল। জাহাজ ধ্বংসের জন্য পাকসেনারা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ভূঞাপুর সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছাবিবশা গ্রামে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর পাক-হানাদাররা গ্রামটিতে গণহত্যা চালায়। একই দিনে ৩২ জন নারী-পুরষ ও শিশুকে হত্যা করে পাক হানাদাররা ছাবিবশা গ্রামে প্রায় ৩৫০ টি ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়।

এদিকে জুলাই মাস থেকে টাঙ্গাইলের কিছু কিছু এলাকা আংশিক হানাদারমুক্ত হয়। আগস্টের দিকে টাঙ্গাইলের মুক্ত একালার উপর পাকবাহিনী সামরিক চাপ ও অত্যাচার বৃদ্ধি করে। মুক্ত এলাকা রক্ষা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই সময় ধলাপাড়ার যুদ্ধে আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য আবদুল কাদের সিদ্দিকী ভারতে চলে যান। অক্টোবর মাসে আবদুল কাদের সিদ্দিকী ভারত থেকে ফিরে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে আসেন। ভারতে অবস্থানকালে কাদের সিদ্দিকী মুজিবনগর সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। তাই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আনোয়ার-উল-আলম শহীদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল মুজিবনগর গমন করেন। মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাদের অতি আগ্রহ নিয়ে যুদ্ধের খবর নেন। থিয়েটার রোডে বিশেষ মন্ত্রিপরিষদের সভায় তাদের স্বাগত জানানো হলে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ টাঙ্গাইলের যুদ্ধ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং জানান কিভাবে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের এতো অভ্যন্তরে থেকে সুপরিকল্পিত উপায়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছে। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সংবাদ বেতারে প্রচার করতে নির্দেশ দেন। মুজিবনগর  সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান আব্দুল মান্নান এমএনএ ও চরমপত্রখ্যাত এম আর আখতার মুকুল এর তত্তাবধানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দেশে-বিদেশে টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের সফল কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। ষোল নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী যুদ্ধকৌশল ও যুদ্ধপরিকল্পনা নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় তাঁর কামরায় টাঙ্গানো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা সম্বলিত মানচিত্র দেখিয়ে তাকে (শহীদকে) বলেন, আমার মনে হয়, কাদের সিদ্দিকী উইল বি দ্যা ফাস্ট ম্যান টু রীচ ঢাকা। উল্লেখ্য যে, এমএজি ওসমানীর এই ভবিষ্যৎবাণী এক মাস পর ঠিক ঐ একই তারিখে (১৬ ডিসেম্বর) অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো।

এদিকে একই সময়ে মিত্রবাহিনীর লেঃ জেনারেল আরোরা ও মেজর জেনারেল গিলের সঙ্গে কাদেরীয়া বাহিনীর লিয়াজো প্রধান নুরুন্নবী যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ো পরামর্শ করেন। তাদের এই দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আরোরা জানান যে, ভারত সরকারীভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হলে টাঙ্গাইলে ছত্রিসেনা নামাতে পারেন-যদি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনী করতে পারে। এ ব্যাপারে নুরুন্নবী টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের পূর্ণ আশ্বাস দেন। অতঃপর উভয় পক্ষের আলোচনায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে ১. মধুপুর এলাকাকে শত্রুমুক্ত করে কাদেরীয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ২. জামালপুরের শত্রুর প্রতিরোধশক্তি যদি দৃঢ় থাকে, তবে কাদেরীয়া বাহিনী দক্ষিণ দিক থেকে জামালপুর অতিক্রম করে ওদের শক্তি দুর্বল করে দেবে এবং ৩. কাদের সিদ্দিকীর বিশ্বাসযোগ্য নির্দেশ পাওয়ার পরই তাঁর নির্দেশিত অবস্থানে ছত্রী সৈন্য নামানো হবে। মিত্রবাহিনীর সন্দেহ ছিলো যে, ঢাকায় পাকবাহিনীর কাছে হয়তো স্যাবর জেট ছাড়াও মিগ-১৯ সি চায়না বিমান আছে। এ বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য নুরুন্নবীর কাছে মিগ বিমানের একটি ফটো দেওয়া হয়।

টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগ সাত দিনের মধ্যে তাঁদেরকে জানাতে সক্ষম হন যে, পাকবাহিনীর কাছে স্যাবর জেট ছাড়া আর কোন যুদ্ধবিমান নেই। অতঃপর মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি দল টাঙ্গাইল ফিরে আসেন। ১১ ডিসেম্বর পাকবাহিনী জামালপুর ও ময়মনসিংহ ত্যাগ করে ঢাকা যাবার পথে বিভিন্নস্থানেকাদেরীয়া বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ বিধস্ত ও ধ্বংস হয়ে যায়। অসংখ্য হানাদার সেনা নিহত ও বন্দী হয়। ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত হয়।

ময়মনসিংহ বা জামালপুর মুক্ত না হওয়ায় ঢাকার পথে মিত্রবাহিনীর কয়েকটি কোম্পানি সাভার জয়দেবপুরের দিকে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ভারত যৌথবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া পাকবাহিনীকে পরাস্ত করা ও ঢাকা মুক্ত করা। টাঙ্গাইল-ঢাকা যাত্রাপথ তাড়াতাড়িমুক্ত করতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হওয়ার কথা কিন্তু হানাদার বাহিনীর যুদ্ধক্ষমতা তখন নিস্তেজ হয়ে গেছে। তাই তারা সহজেই আত্মসমর্পন করে। আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর বেসামরিক দপ্তর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু করতে সহায়তা করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পন-এর পর ঢাকা শহরের শান্তি-শৃঙ্খলা ও জনসেবা, জানমালের সকল প্রকার নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে কাদেরিয়া বাহিনী। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ১৬ ডিসেম্বর রাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন জনসভা করে ঢাকাবাসীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে এবং স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৮ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীন রাজধানীতে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী প্রথম জনসভা করেন। সেই জনসভায় আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম (শহীদ), আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সহ কয়েকজন সাংসদ বক্তৃতা করেন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহবান জানান। ২৪ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় আসলে সারাদেশে তাদের কতৃত্ব স্থাপিত হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে প্রত্যাবর্তন করলে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর পক্ষে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ও আনোয়ার-উল-আলম (শহীদ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অস্ত্র জমা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এরপর ২৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে কাদেরিয়া বাহিনী সামরিক কায়দায় এবং সুশৃঙ্খলভাবে বিন্দুবাসিনী বালক বিদ্যালয় মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পণ করে।

এতদব্যতীত খন্দকার বাতেন (৭১-এ সরকারি সাদত কলেজের ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি)-এর নেতৃত্বে বাহিনী দক্ষিণ টাঙ্গাইলে ঢাকা জেলার কিছু অংশ, গাজীপুর, পাবনা, মানিকগঞ্জ জেলার কিছু অংশ ও সিরাজগঞ্জ জেলার ব্যাপক অংশে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। বাতেন বাহিনীতে সাড়ে তিন হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা ছিলো। একুশটি কোম্পানির সমন্বয়ে বাতেন বাহিনী গঠিত ছিলো। এই বাহিনীতে তেষট্টিটি প্লাটুন এবং একশতটি সেকশন ও তিনটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিলো। ১৯৭১ সালের মে মাসের ৪ তারিখে খন্দকার আব্দুল বাতেন তার বাহিনী নিয়ে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করে যুদ্ধ শুরু করেন। এছাড়া মানিকগঞ্জ জেলারদৌলতপুর থানা আক্রমণ, সিরাজগঞ্জের চৌহালী থানা আক্রমণ, মানিকগঞ্জ জেলার ঘিউর থানা দখল, বাতেন বাহিনীর সাটুরিয়া আক্রমণ ও দখল বীরত্বপূর্ণ।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বাতেন বাহিনীর একটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার কোনড়া গ্রামে। হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা টাঙ্গাইল থেকে পালিয়ে যাবার পথে টাঙ্গাইল জেলা সদরের প্রায় ১৫ মাইল দক্ষিণে কোনড়া গ্রামে পৌঁছালে সেখানে বাতেন বাহিনীর বীর যোদ্ধারা আক্রমণ করে। হানাদারদের সঙ্গে এখানে বাতেন বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বাতেন বাহিনীর বীর যোদ্ধা আব্দুর রব হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন এবং সুবেদার মেজর তাহের হানাদার সৈন্যদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন। কোনড়ার যুদ্ধে হানাদারদের প্রচুর জীবনহানি ঘটে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে গভীর রাতে বহু লাশ ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে হানাদার সৈন্যরা ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে টাঙ্গাইল পর্বে বাতেন বাহিনীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। নাগরপুরে বাতেন বাহিনীর প্রতিরোধ পাকহানাদারদের টটস্থ করে রাখতো। ফলে হানাদাররা নানা ধ্বংসযজ্ঞ চালায় বিভিন্ন গ্রামে। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর নাগরপুরের বনগ্রাম গ্রামে পাকবাহিনী ব্যাপক লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং সারেংপুর গ্রামে একই পরিবারের ৭ জনকে হত্যা করে। তাদের গণকবর দেয়া হয়। এই ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি নাগরপুরবাসীকে আজও শোকহত করে।

টাঙ্গাইলে খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাঃ

ক্রমিক নাম খেতাব থানা
০১। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম কালিহাতী
০২। হাবিবুর রহমান (জাহাজমারা কমান্ডার) বীর বিক্রম ঘাটাইল
০৩। আব্দুস সবুর খান বীর বিক্রম টাঙ্গাইল
০৪। আবুল কালাম আজাদ বীর বিক্রম টাঙ্গাইল
০৫। হামিদুল হক বীর প্রতীক সখিপুর
০৬। খোরশেদ আলম তালুকদার বীর প্রতীক ঘাটাইল
০৭। সৈয়দ গোলাম মোস্তফা বীর প্রতীক কালিহাতী
০৮। আব্দুল গফুর বীর প্রতীক বাসাইল
০৯। সাইদুর রহমান বীর প্রতীক কালিহাতী
১০। হাবিবুর রহমান তালুকদার বীর প্রতীক বাসাইল
১১। ফজলুল হক বীর প্রতীক ঘাটাইল
১২। ফায়েজুর রহমান ফুল বীর প্রতীক টাঙ্গাইল
১৩। খসরু মিয়া বীর প্রতীক মধুপুর
১৪। লেবু বীর প্রতীক বাসাইল
১৫। মোঃ সহিদুল ইসলাম লালু বীর প্রতীক গোপালপুর
১৬। আব্দুল্লাহ বীর প্রতীক বাটাজোর,ভালুকা,ময়মনসিংহ
১৭। আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি বীর প্রতীক সিরাজগঞ্জ
১৮। আব্দুল হাকিম বীর প্রতীক পিংনা, সরিষাবাড়ি

এছাড়া টাঙ্গাইলের ২জন বীর মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইলের বাইরে যুদ্ধ করে শহীদ হন। জাতি এদের বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করে।

০১। শহীদ লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলাম (বীর বিক্রম)

পিতা : মরহুম খন্দকার নূরুল ইসলাম

মাতা : মরহুমা সালেহা খাতুন

গ্রাম ও ডাকঘর : বানিয়ারা

উপজেলা : মির্জাপুর

জেলা : টাঙ্গাইল।

শহীদ লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীর বিক্রম, কুমিল্লার কস্বাতে চন্দ্রপুর গ্রামে স্বাধীনতাযুদ্ধে সম্মুখ সমরে ১৯৭১ সনের ২৩ নভেম্বর ভোর রাত্রিতে ১১ জন সহযোদ্ধা সৈনিকসহ শাহাদৎ বরণ করেন।

০২। শহীদ সিপাহী খন্দকার রেজানুর হোসেন (বীর বিক্রম)

পিতা : কে এইচ হায়দার আলী

গ্রাম ও ডাকঘর : পাচুরিয়া

উপজেলা : দেলদুয়ার

জেলা : টাঙ্গাইল।

সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে সম্মুখ সমরে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হন।

টাঙ্গাইল উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাঃ

উপজেলা টাঙ্গাইল সদর

ক্রমিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাগনের নাম পিতার নাম
১। শহীদ ইব্রাহীম খলিল মৃত আশোক আলী
২। শহীদ সালাউদ্দিন মৃত আঃ রশিদ মিয়া
৩। শহীদ মির্জা সুলতান (টগর) মৃত মির্জা আঃ হামিদ
৪। শহীদ মজিবর রহমান মৃত গনি মিয়া
৫। শহীদ ফজলুল হক মৃত আহাম্মদ আলী বেপারী
৬। শহীদ আব্দুল বাছেদ মৃত মানিক মোল্লা
৭। শহীদ আহসান আলী মৃত জমশের আলী
৮। শহীদ মিজানুর রহমান মৃত আলহাজ্ব মনসুর রহমান
৯। শহীদ জাহাঙ্গীর আলম মোঃ হাবিবুর রহমান তালুকদার
১০। শহীদ আব্দুল লতিফ মোঃ বছির উদ্দিন
১১। শহীদ সহরাব আলী মোঃ দুখু মিয়া
১২। শহীদ আবুল কাশেম খান (শফি) মোঃ আহম্মদ আলী খান
১৩। শহীদ নূরুল ইসলাম খান মোঃ আহাম্মদ আলী খান
১৪। শহীদ সেকান্দার আলী মোঃ কোরবান আলী
১৫। শহীদ মোজাম্মেল হোসেন মৌঃ নূর মোহাম্মদ মিয়া
১৬। শহীদ আব্দুল আজিজ মোঃ বছির উদ্দিন তালুকদার

তথ্য ও সূত্র- ইন্টারনেট অবলম্বনে।

সম্পাদনায়- মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!