বিদায় বছরে পিতৃহারা ও পা হারিয়ে পঙ্গু হলাম

বছর আসে আবার চলে যায়। রেখে যায় শুধু স্মৃতি। যা কারো জীবনে সুখময় আবার কারো জীবনে ব্যদনাময়। সুখের স্মৃতি অনেকেই ভুলে যাই। কেউ কেউ মনেও রাখি। কিন্তু দুখের স্মৃতি অমলিন, যা ভুলা যায় না।

জীবনের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত তুষের আগুন হয়ে জ্বলে। নিরবে নিভৃতে জীবনকে বিষাক্ত করে। কারণে অকারণে অশ্রুজলে সিক্ত হতে হয়।

জন্মের পর থেকে অনেক বছর আসতে ও যেতে দেখেছি। এ সব বছরে কিছু পেয়েছি, কিছু হারিয়েছি। তবে, পাওয়ার আনন্দের কাছে হারানোর ব্যদনা ছিল খুবই কম।

কিন্তু ২০১৯ সালের শেষ ছ’মাসে যা হারিয়েছি, তা কখনো ফিরে পাওয়া যাবেনা। যে ক্ষতি আমার হয়েছে তা অপূরণীয়। যে কষ্ট পেয়েছি তা বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু।

১৯ এর ২২ জুন, শনিবার। প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক ভাবেই সূর্য উঠেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই আমার জীবনে সকাল শুরু হয়েছিল।

এ দিনে আমাদের পাশের থানা ধনবাড়ীতে আমার একটি সাংবাদিকতার প্রোগ্রাম ছিল। যথানিয়মে আমি সকালের কাজ শেষে নতুন পোষাকে বাড়ী থেকে বের হই।

আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন সকালে খেতে দিতে দিতে আম্মা বলেছিল, “বাবা তুমি তো প্রতিদিন সকালবেলা বেরিয়ে যাও আবার বাড়ী ফির রাতে। আজ কোথাও না গেলে হয় না? আজকে বাড়িতেই থেকে যাও”।

খাওয়া শেষে আমি মায়ের কথা না শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। সকাল সাড়ে আটটায় সিএনজি যোগে ধনবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হই।

সকাল নয় টার দিকে যাত্রীবাহী আমাদের চলন্ত সিএনজির সাথে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

এতে আমার ডান পায়ের কয়েক জায়গায় কেটে মাংস পড়ে যায়। হাড় গুলো ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়।

মুমূর্ষ অবস্থায় স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় ধনবাড়ী ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম এসে আমাকে প্রথমে ধনবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে ভর্তি করে।

সেখানে অবস্থার অবনতি হলে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমাকে স্থানান্তর করে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আমাকে চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।

ততক্ষণে আমার অবস্থা মৃত্যুর কাছাকাছি। স্বজনদের আহাজারিতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

তারপর এ হাসপাতাল থেকে আমাকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। এদিকে শরীরের সমস্ত রক্ত ঝরে গেছে। সারা শরীর সাদা হয়ে গেছে।

মৃত্যুর যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে ময়মনসিংহ থেকে এ্যাম্বুলেন্স যুগে রাত দশটায় পঙ্গু হাসপাতালে পৌঁছি। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রাত একটার দিকে অপারেশনের ব্যবস্থা করা হয়।

শরীর রক্তশূন্য হয়ে যায়। এ অবস্থায় রক্তবিহীন অপারেশন করা অসম্ভব। গভীর রাতেই শুরু হয় স্বজনদের রক্তের জন্য দৌড়াদৌড়ি।

এত রাতে কোথাও মিললনা একফোঁটা রক্ত। অবশেষে সবার ছোট ভাই সাব্বিরের সাথে মিলে যায় আমার রক্তের গ্রুপ।

এ যাত্রায় ভাইয়ের রক্তে প্রথম অপারেশন সফল হয়। এ পর্যন্ত ত্রিশ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। এ সব রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে আমার স্বজন ও হৃদয়বান ব্যক্তিদের কাছ থেকে। যাদের কাছে আমি ঋণী।

জীবনের প্রথম অপারেশন থিয়েটারে নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। এই প্রথম দেখলাম, ড্রিল মেশিন দিয়ে মাংস ও হাড় ছিদ্র করে লোহার রড পরিয়ে দেয়।

রান থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে লোহার রড পুঁতে রড দিয়ে টানা দিয়ে রাখল।

টানা চৌদ্দ দিন পঙ্গু হাসপাতালে কতবার যে অপারেশন করেছে তার হিসাব নেই।

চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে অপারেশন করা হয়, তাই অপারেশনের সময় ব্যথা অনুভব হয় না।
কিন্তু ড্রেসিংয়ের সময় মৃত্যুর যন্ত্রণা কেউ হার মানায়। কারণ ড্রেসিং করার সময় চেতনানাশক ইন্জেকশন ব্যবহার করা হয়না।

একবার অপারেশন আর একবার ড্রেসিং। অন্যদিকে আহারনিদ্রাবিহীন হাসপালের বিছানায় টানা চিত হয়ে শুয়ে থাকা।
শরীরটা শুকিয়ে কঙ্কাল হওয়ার উপক্রম।

মুখ দেখে কেউ চিনতে পারেনা কে আমি?

জন্ম থেকে যে মানুষটি আমাকে চিনে ও জানে সেই মানুষটি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা আমাকে চিনতে পারেনা। কণ্ঠ শুনে তাঁরা আমাকে চিনে নেয়। এ অবস্থায় আমার শারীরিক অবস্থার এতই অবনতি হলো যে বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র আশা ছেড়ে দিলাম।

আল্লাহর কালাম যতটুকু মুখস্ত ছিল, সবগুলো পাঠ করলাম। তওবা করে নিলাম। পাশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে, চোখ বন্ধ করে মহান আল্লাহকে বললাম। আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। আমাকে তুমি নিয়ে নাও।

আমার এই মুমূর্ষ অবস্থা দেখে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে তড়িঘড়ি করে স্থানান্তর করে নিয়ে গেল ধানমন্ডির আনোয়ার খান মেডিকেল মডার্ন হাসপাতালে।

সেখানে উন্নত চিকিৎসা চলল। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, আমার ডান পা’টি হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হবে। কোনভাবেই পা’টি রাখা সম্ভব হবে না।

তাই অপারেশন করে আমার ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হলো একদিন। সেদিন থেকে আমি পুঙ্গু হয়ে গেলাম।

টানা দুই মাস হাসপাতালে থাকার পর, ঈদুল আযহা উপলক্ষে আমাকে ছুটি দেয়া হলো। সাত আগস্ট বাড়ি ফিরলাম।

বাড়ি ফেরার খবর শুনে শত শত লোক দলে দলে আমাকে দেখতে আমাদের বাড়িতে এলেন। হাজারো দুঃখপ্রকাশ করলেন।

আমার বাবা ছিলেন হার্টের রোগী। তিনি আমার ক্ষতস্থানটি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি। রাতদিন আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে দশ আগস্ট শনিবার হার্ট অ্যাটাক করে মৃত্যুবরণ করেন।

বার আগস্ট ঈদুল আযহা। সবার বাড়িতেই ঈদের আনন্দ। আমাদের বাড়িতে কান্নার রোল।

তের ই আগস্ট ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গোপালপুর হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে আমাকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকায়। দীর্ঘদিন ঢাকায় চিকিৎসারত অবস্থায় ডেঙ্গু ভালো হয়ে আবার ফিরে আসি বাড়িতে।

আমার সেবা যত্নের জন্য সর্বক্ষণ একজন মানুষ দরকার। তাই পরিবারের সিদ্ধান্তে এ অবস্থায় আমাকে চার অক্টোবর বিয়ে করানো হয়।

বিয়ের পর ফের চলে যাই ঢাকায়। ১০ অক্টোবর বুধবার থেকে ফের ঢাকার ধানমন্ডি প্যানোরমা হসপিটালে ভর্তি হই।

আবারো অস্ত্রোপাচার। এ সব আর ভালো লাগেনা। এ নিয়ে কতবার যে অস্ত্রোপাচার হলো! জীবনটা অসহনীয় যন্ত্রনার মহাসাগরে ডুবেও যেনো ডুবে না। আবার তীরেও ভীরেনা।

বৃহস্পতিবার রাত এগারো থেকে একটা পর্যন্ত চলছে অর্ধপায়ে অস্ত্রোপাচার। মাংস ও হাড়ে ডিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে পুঁতে রাখা রডগুলো খুলে ফেলা হল। যা গত ২২ জুন থেকে ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আমার নিত্য সঙ্গী হয়েছিল।

রডগুলো বের করা পর্যন্তই শেষ নয়। সড়ক দূর্ঘনার সে সময় ভয়াবহ মাংস কাটা ও থেতলানোর পাশাপাশি রানের মাঝবরাবর একটি হাড় বেসাইজে ভেঙ্গেছিল।

এতদিন রডগুলো দিয়ে ভাঙ্গাটি টানা দিয়ে রেখেছিল। এবার পালা সেই ভাঙ্গা হাড়ে রানের মাংস কেটে প্লেট বসানো। যথারীতি এক সময় সেই কাজটিও আট-দশজন দক্ষ ডাক্তারগণ মিলে সম্পন্ন করলেন।

অস্ত্রোপাচারের কাজ শেষে রাত দেড়টায় আমাকে বিশেষ একটি কামরায় রাখা হল। সারারাত অসহনীয় যন্ত্রনা ও অসহায় ভাবে সে কক্ষে সেবিকার সেবায় কাটিয়ে দিলাম।

পরদিন শুক্রবার থেকে এ হসপিটালের তৃতীয় তলার ৩১১ নম্বর ক্যাবিনে বড় বোন সালমা ও মেঝ ভাই শিহাবকে নিয়ে থেকেছি।

এই অবস্থায় আমি অনেকের কাছে ঋণী হয়ে আছি। এই ঋণ কখনো শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই।

আমার এই মুমুর্ষ অবস্থায় টাকা পয়সা দিয়ে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে যারা আমাকে সেবা-যত্ন ও সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের কাছে আমি চিরঋণী। যাদের দোয়ায় আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের কাছেও আমি ঋণী।

ফেইসবুকে সেই মহান ব্যক্তিদের নাম লিখে তাঁদের নাম কে ছোট করতে পারিনা। তাই তাদের নাম লিখে রাখলাম আমার হৃদয়ে।

২০১৯ সালের অপূরণীয় ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

আমি সকলের কাছে আমার বাবার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া চাচ্ছি। আপনাদের দোয়ায় যেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার বাবাকে জান্নাতবাসী করেন। আমাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন দান করেন। আমিন।

মো. সেলিম হোসেন
সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!