সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এর ১ম মৃত্যু বার্ষিকী

সম্পাদকীয় ডেক্স । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ষষ্ঠ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ-৩ ও কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে একাধিক বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৫ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। এর পূর্বে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ১লা জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বাংলাদেশের মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আশরাফুল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সাথে আশরাফুলের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফুল যুক্তরাজ্যে চলে যান এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাস কালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সেসময় তিনি লন্ডনস্থ যুবলীগের সদস্য ছিলেন। আশরাফুল ফেডারেশন অব বাংলাদেশী ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (এফবিওয়াইইউ) এর শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল।

শেখ হাসিনার ডাকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলেন। দেশে ফেরার পর অংশ নিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ১৯৯১ সালে বিএনপির কাছে হারানো কিশোরগঞ্জ সদর (তৎকালীন কিশোরগঞ্জ-৩) আসনটি ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে রাজনীতিতে অবিস্মরণীয় প্রত্যাবর্তন হয় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের।

২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চরম ভরাডুবি ঘটলেও সৈয়দ আশরাফ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৭তম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এক-এগারোতে সেনা সমর্থিত সরকার রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার নীল-নকশা নিয়ে যখন এগোচ্ছিল, বয়সের ভারে ন্যূব্জ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান একা সব কিছু সামাল দিয়ে পেরে উঠছিলেন না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল কারাগারে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন ‘মিস্টার ক্রাইসিস ম্যান’ খ্যাত সৈয়দ আশরাফ। সেই ক্রান্তিলগ্নে দৃঢ়চিত্ত আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আওয়ামী লীগকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনাকে মুক্ত ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৪শে জুলাই অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৮তম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় কাউন্সিলে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিলে তিনি জায়গা পান প্রেসিডিয়ামে। তখন আরেক দফা তাঁর প্রতি নেতাকর্মীদের আবেগ অনুভূতি ও সমর্থন দৃশ্যমান হয়। তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। দলের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে তিনি কখনও কোন গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেননি। রোজ প্রেসবিফ্রিং করেননি। কিন্তু যখন যেটি প্রয়োজন সেটি সময়মতো ইতিবাচকভাবে বলতে ভুল করেননি। অতিকথন, ক্ষমতার দম্ভ যেমন তাকে স্পর্শ করেনি তেমনি গণমাধ্যমের সমালোচনায় ব্যক্তিগত আক্রোশ পোষেননি। একজন উদার পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদের মতোই তিনি নীরবে নিভৃতে পথ হেঁটেছেন। আমৃত্যু সেই পথ থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি।

টানা পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সংসদে একবারই মাত্র বিরোধী দলের আসনে বসতে হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নেয়ার আগেই পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। বাকি তিনবারই তিনি বসেছেন সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চে। এই তিন সরকারে মন্ত্রীত্ব ছাড়াও টানা দুই বার তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দফায় দফায় মন্ত্রী এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গড়ে তুলেননি সম্পদের পাহাড়। বরং তাঁর সম্পদ দিন দিনই কমেছে। পৈত্রিক বাড়ি ছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত কোন বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট কিছুই ছিল না। এমনকি সরকারি সুবিধা পরিহার করে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি বিক্রি করেছিলেন উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া গুলশানের বাড়িটি। গুলশানে জাতীয় চার নেতার নামে বরাদ্দ করা প্লট থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে হিসেবে তিনি ২ শতাংশ জমি পেয়েছিলেন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি সেই জমি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদকের কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদল ইউনিয়নের যশোদল বীরদামপাড়া গ্রামে ১৫ শতাংশ জমির উপরে একটি পৈত্রিক বাড়ি এবং ময়মনসিংহের কলেজ রোডে ৮ শতাংশ জমির উপরে একতলা একটি বাড়ি রয়েছে, যা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফুল ব্রিটিশ ভারতীয় সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের শীলা ঠাকুরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শীলা লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন এবং ২৩ অক্টোবর ২০১৭ সালে তিনি মৃত্যুবরন করেন। আশরাফুল-শীলা দম্পতির একমাত্র মেয়ে রীমা ইসলাম, যিনি লন্ডনের এইচএসবিসি ব্যাংকে চাকরি করেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেই অন্তরালে চলে যান।

সৈয়দ আশরাফুল ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। নভেম্বর ২০১৮ সালে তার ফুসফুসের ক্যান্সার ৪র্থ ধাপে পৌঁছে। ২০১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি থাইল্যান্ডের ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ৬ জানুয়ারি ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!