নাহিন শিল্পীর ’অনামিকার দিনগুলো-২’

অনামিকার দিনগুলো – ২
-নাহিন শিল্পী

অনামিকা আত্মীয়ের বাসা থেকে ফিরে ভেনিটি ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে ছোট্ট একটা পার্স নিয়ে বাসায় ফ্লেক্সিলোডের নাম করে দ্রুত বের হয়ে গেল। তখন বিকেল গড়িয়ে কংক্রিটের পথ বেয়ে নেমে এলো সন্ধ্যা।

মুটোফোন বেজেই চলছে, রিক্সা থেকে নেমে ফোন রিসিভ করতে করতে যে মানুষটার দিকে প্রথম দৃষ্টি পড়েছিলো অনামিকার, তিনিই সেইজন। কিছুটা ভয় আর সংকোচতা নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো সে। কাছাকাছি হতেই ভদ্রলোক প্রথম সালাম দিলেন। উদ্যানের গেট পেরিয়ে তুলনামূলক একটা নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলো দু’জন। তখন সমুদ্রের তল ছুঁয়ে অকস্মাৎ ভেসে ওঠা ডলফিনের কুচকুচে গা বেয়ে যেনো ঝরছিলো সজীবতা । সাদা বসনে আদৃত প্রেমিক পুরুষের কাশফুল প্রেমের শুভ্রতায় যেনো ম্লান হয়ে এলো নিয়নের ঝকঝকে আলো। নিরবতা ভেঙ্গে বেজে ওঠলো মুঠোফোনে শুনা চিরচেনা সেই সুর —
–কেমন আছেন আপনি?
বিনয়াবনত কণ্ঠে অনামিকা জবাব দিলো, জ্বী ভালো। আপনি?
—ভালো আছি। যতটা সুন্দর ভেবেছিলাম তারচেয়ে অনেক বেশী সুন্দর আপনি।
— আপনার বাড়ী কি শহরের কাছেই?
— তেমন কাছে বলা যাবে না, তবে বাসে এলে আধঘন্টা সময় লাগে।
— এলকার নামটা জানি কি বলেছিলেন?
— শ্যামলপুর।
— এখন কি বাড়ী ফিরে যাবেন?
— জ্বী, চলুন না কোথাও বসা যাক্ ; আকুতি ভরা আবদার নিবাসের।
— বাসায় ফ্লেক্সির কথা বলে বের হয়েছি, আমাকে এখুনি যেতে হবে বলে এই প্রথম নিবাসের চোখের দিকে তাকালো অনামিকা। যেনো কয়েক সেকেন্ডে মেঘ ভেদে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো।
— আপনার বাসায় এখন কে কে আছে?
— মা আর একমাত্র সন্তান। প্লিজ আমি চলে যাই?
— ওকে ভালো থাকবেন, পরে কথা হবে বলে উপায়ন্তরহীন নিবাস বাধ্য হয়ে বিদায় দিলো অনামিকাকে।
সালাম দিয়ে অনামিকা দ্রুতপায়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো।
সর্বোচ্চ দশমিনিটের এই দেখা নিবাসের ভেতর যন্ত্রণার একটা ক্ষত তৈরী করেছিলো যা অনামিকা জেনেছিলো দীর্ঘ কয়েক বছর পর।

–(৩)
অনামিকার জন্ম ফরিদপুরের মাদারিপুরে। দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও। এ পর্যন্ত যেই তাকে দেখেছে, প্রথম দেখাতেই পছন্দ করেছে। হেসে খেলেই কেটে গেছে শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো।
বাঁধ সাধলো যৌবন। তারুণ্যের ঝাঁঝালো দিনগুলোতেই প্রেমের ফাঁদে পা দিয়েছিলো অনামিকা। স্বপ্ন গড়ার দিন থেকেই শুরু হলো স্বপ্ন ভাঙ্গনের।
গায়ের সহজ সরল আবহে বেড়ে ওঠা অনামিকা হঠাৎ একদিন ভালোবাসার মানুষটার কাছে প্রতারিত হয়ে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ খুঁজে নেয়। উদ্দেশ্য সবার সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। কয়েক মাসের মধ্যে কর্মস্থলেই এক সহকর্মীর সাথে পারিবারিক ভাবে কমিউনিটি সেন্টারে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো তার।
এইবার সে অতীত ভুলে বর্তমানকে ঘিরেই বাঁচার অনেকটা প্রস্তুতি ভেতর থেকে নিয়ে নিলো।
মনে মনে ভাবলো সমস্ত যন্ত্রণার লাঘব করে ভেঙ্গে পরা স্বপ্নটাকে যত্ন দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করে তুলবে এই মানুষটাই যার হাত ধরে জীবনের পথ চলা শুরু হয়েছে। বিশ্বাস আর নির্ভরতা সে তার মাঝেই খুঁজতে থাকলো। এখানেও বিধি বাম।
প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে একা যুদ্ধ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছিলো অনামিকা। যাকে আকড়ে ধরে তার বাঁচার কথা, চোখ বন্ধ করলেই সেই মানুষটাকে তার কাছে অভ্যাগত ছাড়া কিছুই মনে হয় না। এভাবেই কয়েক বছর কেটে যাবার পর নিজের মধ্যে আরো একটি জীবনের অস্তিত্ব অনুভব করলো সে। নির্দিষ্ট সময়ের পর অনামিকা হলো এক কন্যা সন্তানের মা।
মনে হয়েছিলো এবার বোধহয় একটু নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচা যাবে। যাকে অভ্যাগত মনে হয় সে সত্যি সত্যিই আপন হয়ে উঠবে। কিন্তু নাহ্, সন্তান যখন ঘুমিয়ে যায় তখন নির্ঘুম চোখে আকাশের পানে চেয়ে ঝলমলে তারাদের মাঝে আশ্রয় খুঁজতে হয় তাকে । নিঃসঙ্গতায় পারদ ঢেলে আঁধার তাকে টেনে নিয়ে চলে আরও গহীন থেকে সীমাহীন গহীনে। এভাবেই দিন কাটতে লাগলো তার।
অনামিকার স্বামী পরিবারের কথায় সিদ্ধান্ত নিলো দেশের বাইরে চলে যাবে। স্ত্রী হয়েও এইসব তার সময়মতো জানার অধিকার বা উপায় কোনটাই ছিলো না। ঘনিয়ে এলো সেই দিন, অতিথি পাখি এবার সত্যি সত্যিই উড়াল দিলো সুদূর সাইপ্রাসে।
সেসময় গ্রামে হাতে গুণা কয়েকজনের হাতে ফোন ছিলো। বেশীরভাগ মানুষকেই কথা বলতে হতো দোকানে গিয়ে। কলরেট ছিলো প্রতি মিনিট সাত টাকা। সময়টা ছিলো ২০০৩-২০০৪ সাল। সবাই যখন অতিথি পাখির সাথে কথা বলতো, আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ ভিজে উঠতো অনামিকার। মনে হতো এবার হয়তো তার কথা বলবে, কিন্তু নাহ্। সবার কথা শেষ হলে মুঠোফোনটা কাজের ছেলেটাকে দিয়ে দোকানে পাঠিয়ে দেয়া হতো। একদিন কী ভেবে জানি না অনামিকার ননাস (স্বামীর বড় বোন) সবার কথা শেষ হলে বলছিলো তার ভাইকে, “কিরে অনামিকার সাথে একবার কথা বল্ “। পরক্ষণেই ছোট ভাগ্নিটা মোবাইলটা এনে অনামিকার হাতে দিলো।
হ্যালো, কেমন আছো?
ভালো, তুমি কেমন আছো?
তারপর নিবিড় নিরবতা আর কিছুটা চোখের জলে ভেসে গেলো তিরিশটি সেকেন্ড।
সেই সাড়ে তিনটাকায় কেনা তিরিশ মিনিটের যে ক্ষতটা বুকের মধ্যে হয়েছিলো, সময়ে অসময়ে এখনো তার থেকে রক্ত ঝরে। এভাবেই একটু একটু করে অনামিকা হয়ে ওঠে এক অদৃশ্যমান পাথুরে মানবী।
সময়ের সাথে সাথে সন্তানও বড় হতে লাগলো। অনামিকা সন্তান নিয়ে চলে আসে কর্মস্থল নেত্রকোণাতে । এর আগে তাকে বদলী করা হয়েছিলো হাতিয়াতে। অনেক কষ্টে, চেষ্টা-তদবীর করে সেই বদলী ফেরানো হয়। ছোট চাকরীর কারণে যখন তখন বাইরে থাকতে হয় অনামিকাকে। সন্তান, সংসার, চাকরী একা সামলানো তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে । তাই সে বাড়ী থেকে কিছু সময়ের জন্য নিজের মাকে বাসায় নিয়ে আসে।
সুজয়া তার কলিগ সেই সাথে ভালো বন্ধুও। কারণ একি কর্মস্থলে কাজের সুবাদে দু’জন একই মালিকের বাসায় ভাড়া থাকে। তবে আলাদা আলাদা রুমে। অনামিকার রুম ২টি। একটিতে তার মা, অন্যটিতে তারা মা-মেয়ে।
একদিন বাজারের এক দোকানে গিয়ে অনামিকা তার স্বামীকে ফোন করলো সুজয়া পাশেই বসা। দু’জনের মধ্যে কিছু কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে অনামিকা লাউডস্পিকারের ভলিয়ম বাড়িয়ে দেয়, তারপর যা শুনছিলো সুজয়া। নিজের কানে না শুনলে হয়তো কোনদিনও তার বিশ্বাস হতো না। এভাবেই অনামিকার ভাঙ্গা জীবনে একদিকে নিঃসঙ্গতা , অন্যদিকে নিজের দায় একা নিজেকেই বয়ে বেড়াতে হচ্ছিলো।
সুজয়া অনামিকার মুখের দিকে তাকায় আর ওর জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মাঝেই সে যেনো নিজেকে দেখতে পায়।
অপমান, অবহেলা আর অবিচার যখন সীমা ছাড়িয়ে গেলো তখনি সে সবার কথার অবাধ্য হয়ে, এক যুগেরও বেশী সময় সংসার করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এবং একসময় আইনিভাবে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। সেই থেকে আলো আঁধারের পথে একমাত্র সন্তানের হাত ধরে তার নিঃসীম দিনাতিপাত।
সুজয়ার লেখার হাতটা একসময় মুটামুটি ভালোই ছিলো। চর্চার অভাবে আর সময়ের ব্যবধানে তাতেও এখন জং ধরে গেছে। সে ও অনেকটা জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে সবার কাছ হতে নিজেকে আড়াল করে চলতে পারলেই বরং বাঁচে।
আজ অনামিকার কথা রাখতে গিয়েই তাকে জীবনের গল্পটা লিখতে হচ্ছে। আর লিখতে গিয়ে আজ এত বছর পর বড় অদ্ভূতভাবে সে লক্ষ করলো অনামিকার গল্পের পরতে পরতে যেনো লুকিয়ে আছে তার জীবনের বেদনাক্লিষ্ট সেইসব দিনগুলোও। আর সেই কারণেই হয়তো এমন কঠিন কাজটা সে শত ব্যস্ততার মাঝেও করে যেতে পারছে অনায়াসে ।
#বাইরে থেকে যতটা হাসিখুশী বা পরিপূর্ণ মনে হয় অনামিকাকে, ভেতর থেকে সে ততটাই নিঃস্ব এবং রিক্ত। আগের চাকরীটা ছেড়ে নতুন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে জয়েন করেছে সে। কর্মস্থল গাজিপুর শহরে।
এই শহরে আসলেও নিবাস তার পিছু ছাড়ে নি। কিন্তু অনামিকা কিছুতেই নিবাসের কথা রাখতে পারছিলো না। এরই মধ্যে সে একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনে ফেসবুক একাউন্ট ওপেন করেছে । যতটা মনে পড়ে নিবাসেই তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছিলো । তারপর তাদের কথা চলতে থাকে মেসেঞ্জারে। আর নিবাস নেট বন্ধ পেলে নাম্বারে মেসেজ করতো নইলে কল্ করতো।
প্রতিবারেই তার কথা একটাই “আইলাভইউ”। কতশতবার যে বলেছে তার কোন হিসেব নেই। সময় করে প্রতিনিয়ত খুঁজ খবর নিতে থাকে। এত দায়িত্বশীল পুরুষ এর আগে কখনো অনামিকা দেখেছে বলে মনে হয় না । তারপরও সম্পর্ক গড়তে তার মন একেবারেই সায় দিচ্ছিলো না। নিজের মতো করে সিদ্ধান্তে অনঢ় থেকে সে জীবনের যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে লাগলো। এখানেও নিয়তির বিড়ম্বনা । হঠাৎ একদিন নিজের হাতে ধরে সে ডেকে আনলো এক কঠিন বিপর্যয়।
চলবে——-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!