জীবনের ঝুকি: নিষেধাজ্ঞা শিথিল: করণীয়

জীবনের ঝুকি: নিষেধাজ্ঞা শিথিল: করণীয়
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে-বাড়ছে সারাটা দেশেই। বহু নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছিল এবং সেগুলি কার্য্যকর করারও চেষ্টা করা হয়েছিল। ঢাকার এবং জেলা শহরগুলির রাজপথগুলিও বহুলাংশে ফাঁকাও হয়ে এসেছিল-গণপরিবহন বন্ধ রাখা ও দোকান-পাট-হোটেল প্রভৃতি বন্ধ রাখার কারণে। অপর একটি বড় কারণে এই প্রচেষ্টা বহুলাংশে সফল হয়েছিল। সেটা হলো পুলিশ-বিজিবি-সামরিক বাহিনী রাস্তায় নেমে অনেকটা কঠোরতার সাথে স্বাস্থ্য বিধি মানানোর প্রচেষ্টা নেওয়ায় এবং মোবাইল কোট বা ভ্রাম্যমান আদালতগুলি সক্রিয় থেকে বিধি সমূহ লংঘনকারীদের জেল-জরিমানা প্রভৃতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করার ফলে। এই কঠোর বিধিনিষেধ জারী করা হয়েছিল ১ জুলাই থেকে প্রথমে এক সপ্তাহের জন্যে এবং পরে তা পুনরায় ১০ দিনের জন্য বাড়ানোও হয়েছিল।

কিন্তু দেখা গেল, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার প্রতিদিনই বৃদ্ধি পেতে পেতে ২৫০ শতের কাছে মৃত্যু এবং ১৩,০০০ জন সংক্রমিত হয়ে ঠিক এরই মুখে, ঈদ-উল-আযহার কারণে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে আগে জারীকৃত বিধিনিষেধগুলি প্রত্যাহার করে নিয়ে বলা হলো এই শিথিলতা ২২ জুলাই অর্থাৎ ঈদের পরদিন পর্য্যন্ত বহাল থাকবে কিন্তু ২৩ জুলাই থেকে এই কঠোরতাগুলি পুনর্বহাল করা হবে ৫ আগষ্ট পর্য্যন্ত মেয়াদে।

এই আদেশ ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই শুধুমাত্র ঢাকার নয়, সারা বাংলাদেশের রাস্তাগুলি ঠিক আগের চেহারায় চলে যায়। সরকারিভাবে বলা হয়েছিল, বাস, ট্রেন, লঞ্চ সার্বিস সহ সকল প্রকার গণপরিবহন চলবে তবে সকল ধরণের স্বাস্থ্যবিধি মেনে। অর্থাৎ গাড়ীগুলি নিয়মিত স্প্রে করতে হবে, অর্ধেক যাত্রী নিতে হবে ৬০% ভাড়তি ভাড়া এবং সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। কিন্তু কার্য্যক্ষেত্রে কি ঘটলো?

কার্য্যক্ষেত্রে একমাত্র ট্রেন ছাড়া বাদ বাকী কোন যানবাহনই স্বাস্থ্য বিধি মানার তোয়াক্কা করছে না। আবার তোয়াক্কা যে করছে না-তা দেখভাল করারও কেউ নেই। বাসে সরকারি আইন অমান্য করে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে দ্বিগুণ-অর্থাৎ ২০০ টাকা ভাড়া হলে নেওয়ার কথা ৩২০ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা প্রকাশ্যেই কোন রাখ-ঢাক না করেই। বাস টার্মিনালগুলিতে পুলিশ আছে কিন্তু কাউন্টারে বে-আইনী কার্য্যকলাপ বন্ধ করতে সেই পুলিশ এগিয়ে আসছেন না। ভাড়া ডবল নেওয়র পরেও প্যাসেঞ্জার নেওয়া হচ্ছে পুরো বাস ভর্তি। এটা তো বাইরে থেকেই দেখা যায়। কিন্তু দেখছেন না পুলিশ বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ।
লঞ্চগুলির অবস্থা সর্বাধিক খারাপ। সেখানে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে পূর্ণ আসন সংখ্যার অনেক বেশী-ভাড়াও ডাবল। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বালাই ট্রেনগুলিতে ছাড়া আর কোন গণপরিবহনে নেই। যাত্রী ও চালক-কর্মচারীদের প্রায় ৫০ ভাগের মুখে কোন মাস্ক নেই।

সরকার আদেশ জারী করেই তাদের দায়ীত্ব শেষ করলেন-সে আদেশ সমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তবে কে বা কারা করবেন? আর এই বিধিভঙ্গ, লাখে লাখে ঈদ যাত্রা ও ফিরতি যাত্রায় যে হারে সুস্থ লোকও অসুস্থ লোকের ছোঁয়া লেগে সংক্রমিত হবেন-মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন তা-ই বা কে কিভাবে প্রতিরোধ করবেন তার কোন খবর কোন সূত্রেই জানার সুযোগ নেই।

এভাবে দলে দলে গাদাগাদি করে যার যার গন্তব্য পৌঁছাতে পারলে আর পায় কে? নিজের বাড়ী, আত্মীয় বাড়ী, পরশীর বাড়ী না গেলে তো অভদ্রতা বলে মনে করতে পারে। তাই এই বাড়ীগুলিতে স্ত্রী-সন্তান বা ভাই-বোনদের নিয়ে ঘুরে আসা এবং তারাও আবার ফিরতি সাক্ষাত না করলে অভদ্রতা হয় ভেবে সদ্য ঢাকা থেকে দেশে আসা লোকদের বাড়ীতে দলে-বলে গিয়ে ঘুরে আসা গল্পগুজব ও নাস্তা পানি সেরে। সর্বত্রই বসার জায়গা কম-তাই ঠাসাঠাসি করেই বসা। মাস্ক? তার আবার দরকার কি? সব তো নিজেদের বাড়ীতে নিজেদের লোকজনের সাথেই ওঠাবসা। এতে আবার মাস্ক লাগবে কেন? স্যানিটাইজার? না গ্রামাঞ্চলে তার কোন বালাই নেই।

এরপর হাট-বাজার। ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনার মত বড় বড় শহর থেকে ছোট ছোট জেলায় বা গ্রামাঞ্চলে যাওয়ার পর স্বভাবত:ই সকলের মনে আকাংখা জন্মে স্থানীয় বাজার থেকে দেশী এবং টাটকা তরিতরকারী মাছ মাংস ডিম কিনতে। ছেলেমেয়েদের আবদারও থাকে সে রকম। তাই দলে বলে দিনকয়েক বাজারে যাওয়া কেনা কাটা ইত্যাদি চলে। নিজেরা মাস্ক পরলেও বাজারে তো শতকরা ৫-১০ জনের বেশী কেউ মাস্ক পরে না। শারীরিক দূরত্বের বালাই তো শহরের বাজারগুলিতেও নেই। গ্রামে তো প্রশ্নই ওঠে না।

সব থেকে বড় কেনাকাটা হলো কোরবানীর পশু। সরকারিভাবে প্রথমে বলা হলো কোথাও কোন পশু হাট বসবে না-কোরবানীর পশু কেনাকাটা চালাতে হবে অনলাইনে। দু’দিন যেতে না যেতেই আবার জানা গেল পশু হাট চলবে। চলছে দেশব্যাপি হাজার হাজার পশু হাট নিমেষেই চালু হয়ে গেল। বিশাল বিশাল হাট। কথা ছিল, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশু হাট বসানো যাবে। কিন্তু ঐ পর্য্যন্তই। বাস্তব চিত্রটি হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। কোথাও স্বাস্থ-বিধি মানার কোন বালাই নেই। বালাই নেই বিক্রেতাদের-নেই ক্রেতাদেরও। দিব্যি এভাবেই চলছে। কোন ব্যবস্থা নেই-স্বাস্থ্য বিধি সকলকে মানানোর যদিও তেমনটি বলা হয়েছিল সরকারিভাবে।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলি অনবরত দেখাচ্ছে বাসের ভীড়, লঞ্চের ভীড়, হাটবাজারের ভীড়, ফেরী ঘাটের ভীড়। জানাচ্ছে কোথাও স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলতে বা চালাতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। এ এক ভয়াবহ চিহত্রই বটে।
আবার ফিরতি যাত্রার জন্য সময় রাখা হয়েছে কার্য্যত দেড় দিন। এই স্বল্পতম সময়ে ফিরতি যাত্রায় যে মারাত্মক পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা কল্পনাতীত। বহু সড়ক ও লঞ্চ দুর্ঘটনাওে তাতে অসংখ্য মৃত্যুর ও সংক্রমণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশংকা বিদ্যমান।

এবারে বিবেচনা করা যাক-এমন যাত্রা ও ফিরতি যাত্রার পরিণতি কেমন দাঁড়াতে পারে। আগে থেকেই গ্রামাঞ্চলে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপকভাবে ঘটতে সুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে তার কারণ হলো বিগত ঈদের ঈদ যাত্রা ও মেলামেশা। তখন গ্রামাঞ্চলে কোথাও করোনা সংক্রমণ বা মৃত্যু ঘটে নি। এবারকার এ সংক্রান্ত চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত। আগে থেকেই গ্রামাঞ্চজলে করোনা ছড়িয়ে আছে। জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলিতে ‘ঠাঁই নেই’, ‘ঠাঁই নেই রব শুনা যাচ্ছে। মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছা মাত্র সেই সব রোগীদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকায় বা নিকটস্থ বিভাগীয় হাসপাতালে। মৃত্যু ঘটছে সেখানে। ফলে জেলায় মৃত্যুর তালিকায় তাঁদের নাম নেই।

হাসপাতালগুলি আই.সি.ইউ. বেড নেই। অক্সিজেন নেই। রোগীর মৃত্যু ঘটছে অহরহ। সময় গেল দেড় বছর কিন্তু হাসপাতালগুলিতে আই.সি.ইউ বেড ও অক্সিজেন জুটলো না। তার বাবদে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত দিলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একে পরিহাস ছাড়া আর কীই বা বলা যায়।

চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলছেন, সরকারের ঘোষিত শিথিলতা আগামী দিনে মারাত্মক বিপর্য্যয় ঘটানোর সমূহ আশংকা দেখা যাচ্ছে। এ আশংকার পেছনে বাস্তব কারণগুলি এতক্ষণ বর্ণনা করলাম। যদি আশংকাগুলি আগামী আগষ্টের মধ্যে সত্যে পরিণত হয়ই তখন কী হবে?

এ প্রশ্নের উত্তরে যা যা বলা যায় তা হলোঃ-
এক. ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগষ্টের পরিবর্তে ১৫ আগষ্ট পর্য্যন্ত কঠোর লক ডাউ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট, বাজার-বিপণী, হোটেল-মোটেল, গণপরিবহন, কল-কারখানা সব কিছু বন্ধ ঘোষণা করে কঠোরভাবে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হোক;
দুই. ব্যাপকভাবে গ্রাম ও শহরগুলিতে বিনামূল্যে করোনা নমুনা সংগ্রহ ও তা পরীক্ষার ব্যবস্থা দ্রুততার সাথে করা হোক;
তিন. জেলা উপজেলা হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক করোনা ওয়ার্ড করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড ডাক্তার-নার্স, আই সি ইউ বেড, অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হোক;
চার. আগামী ১ আগষ্ট থেকে ১২ বছর পর্য্যন্ত বয়সের নারী-পুরুষকে ভ্যাক্সিনেশনের আওয়াতায় আনা হোক এবং
পাঁচ. সকল হাসপাতালে করোনা রোগী আনা নেওয়া ও মৃত রোগীর সৎকারে সহায়তার জন্য কমপক্ষে দু’টি করে এমবুলেন্সের ব্যবস্থা দিবারাত্রির জন্য করা হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!