শরৎ চন্দ্রের সৃষ্টি গফুরের মহেশকে অভাবের জন্য বিক্রি

শরৎ চন্দ্রের সৃষ্টি গফুরের মহেশকে অভাবের জন্য বিক্রি
-ফরিদা ইয়াসমিন জেসি (প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও-আর্ন এন্ড লিভ)

আমাদের স্কুলের প্রতিবন্ধী যুবক আবু বকর কম্পিউটার কেনার জন্য তার মহেশকে বিক্রির কথা বলছি- মেইন গল্প থেকে। মহেশ – প্রতিবেশিদের গৃহ হইতে ফ্যান চাহিয়া আনিয়া মহেশকে খাওয়াইলো এবং তাহার গায়ে মাথায় ও শিংজ্ঞে বারংবার হাত বুলাইয়া অস্ফুটে কত কথায় বলিতে লাগিলো গফুর । তারপর চোখ দিয়া টপ টপ করিয়া জল পড়িতে লাগিলো। চিৎকার করিয়া গফুর কহিলো আমার মহেশকে আমি বেচিবো না। খবরদার কেউ দড়ি ধরিও না।

লার্ন এন্ড লিভ স্কুলের প্রতিবন্ধী ছেলে আবু বকরের মহেশ – চোখের সামনে তিল তিল করে বড় হয়ে উঠেছে। বাড়ির পাশে বড়ই তলায় বেধে রাখা হয়, ঘাসে জবর কেটে কেটে মাথা দুলিয়ে সক্ষতা করে আবু বকরের সাথে। মায়াবি চোখের নজরে থাকে তীক্ষ্ণতা। চাষাবাদে মন থাকেনা তার তেমন, বকরের সান্নিধ্যেই বেশি তার আনন্দ। মহেশের মনে পড়ে তার মাকে বিক্রির পর বকরই তার কাছের বন্ধু, প্রিয়জন।

ইরি ক্ষেতে যখন তুমুল ফসল। ধানের মলন হবে আজান ভোরে, মহেশ কাজ করে যায় মনের আনন্দে। দুই বন্ধু থাকে গলায় গলায় মহেশ আর বকর। শস্যের আল ঘেষে যেতে চায় মহেশ বাগী ক্ষেতের মাঠে ঘাস খাওয়ার লোভে। কখনো যেতে চায় পশ্চিমের পাড়ার ডোবার কচুরিপানার লোভে, খালের ধারে। যেতে চায় নালিয়া খেতের পাশে।

মন যেতে চায় তার আরো দুরের পাহাড়ের নিচে সবুজ ঘাস আর শান্তিছায়ায়। এসব মহেশের মনের খেয়াল, মনেই রেখে দেয় সবুজ প্রান্তরে তরতাজা ঘাসের লোভনীয় স্বাদ। দড়িতে বাধা থাকে চৈত্রের দুপুরে, বৈশাখের মেঘের ডাকে। বায়না করেনা কিছুই বন্ধু বকরের কাছে । বন্ধু বকরের দুটি পা নেই, একটি হাত নেই। মহেশকে নিয়ে কি করে যাবে তেপান্তরের মাঠে রাখাল বালক সেজে। বাশিতে সুর তুলে গাইবে গান “মন মাঝি তোর বইঠা নেরে আমি আর গাইতে পারলাম না।”

আবু বকর দুর আসমানে চেয়ে উদাস মনে স্বপ্ন দেখে আধুনিক বিশ্বকে করবে জয়। কম্পিউটার শিখছে আজকাল স্কুলে, দিনের পর দিন করছে সাধনা। নিজেকে বুঝায় সে, সব ছেলেরা পারে আমিও কেনো পারবো না।

যদি ও গায়ের ছেলেদের মত কাদা মাটিতে লাফিয়ে খেলার স্মৃতি নেই তার, ঝম ঝম বৃষ্টির মাঝে কাবাডি খেলা হয়নি কখনো । কখোনো ভাংগা পুলে বসে নদীর পানিতে ডিগবাজি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়াও হয়নি। এসব করতে দুটি হাত দুটি পা থাকা লাগে। বন্ধুরা কি নিবে খেলায় তাকে সাথে? না সে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার আছে বসে থাকা জিন্দেগী। অভাবের সংসারে জিওল মাছের বন্দি জীবন তার।

“সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে” গান ধরতে চায় সে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে। মহেশ তার বন্ধু, বুঝে তার ভাষা। ইতিহাসে আলোকচিহ্ন একে দিয়ে যাক তার বন্ধু সুর্য হয়ে অন্ধকারের জগত থেকে বের হয়ে। মহেশ তা চায়। দুজনে গলা ধরে করে মোলাকাত, রাজ্যের ভালবাসা ভাগাভাগি করে নেয় দুজনে। কি মিষ্টি আলিংগন। মহেশ বুঝে কি কারনে বকরের পরান কাদে।
দখিনের কাঠাল তলায় বাধা থাকে মহেশ। কখনো তার সামনে দেয় আউশের ন্যাড়া, কখনো সামান্য ভাতের ফ্যানা। নির্জন দুপুরে খা খা চারিদিক, খাবার তেমন পড়েনা পেটে তার, ভাতের ফ্যান খাওয়ানো হয়ে যায় বিহান বেলায়। বাড়ির কর্তা যায় খেতের কামলা টানতে। পরিবারের টানাপোড়েনে মহেশের যত্ন আত্তি হয়না একেবারেই। পরের আলু ক্ষেত পরিচর্যায় আগাছা যা পায় তা নিয়ে তুলে দেয় মহেশের মুখে। পড়া লেখার পাট শেষ করে বাড়ি আসে বকর। মন তার উচাটন, নতুন উদ্ভাবনী আলোর পরশ পায় বিদ্যালয়ে। কম্পিউটারে শিখছে সে বিভিন্ন প্রগ্রাম। এক হাতে কাজ করা সহজ। প্রযুক্তি ব্যবহারে সহজ সাধ্য হয় এক হাতেই। দুটো হাত না হলেও। হবে সে দক্ষ কম্পিউটার কারিগর। চিত্র অংকনে ও পারদর্শী সে। পুরস্কার ও পেয়েছে বহুবার।

বকরের স্কুল ফেরার সময় হলে তার ছায়া দেখার অপেক্ষায় নৃত্য করতে থাকে মহেশ ঘাস ফড়িং আর প্রজাপতির মত। মুখে শব্দ করে উয়েলকাম করে বন্ধুকে। ঘর মুখি বন্ধু বকর উচ্ছাসে যায় ছুটে মহেশকে আলিংগন এর জন্যে। চিরকালীন মুগ্ধতা চলে দুজনের কোলাকুলিতে।

সকালের মিঠা আলোতে উঠোনে বসে পান্তার থালাতে হাত রাখে বকর। পিয়াজে কামড় দিয়ে বলে বাপজানকে। এইবার একটা কম্পিউটার না কিনলে হইবোনা বাপজান। অনেক জিনিস শিখার আছে। আমি মস্ত শিক্ষা নিমু। অনেক বড় হইমো। দেশ বিদেশের কাজ করা যায় ঘরে বসে। ছেলের কথায় বাপজান হাসে, তুই কি করে করবি চাষের কৌশল, দেখবি কি করে ফসলের মাঠ। জমিনের বুকে লাংগল কি আর তোর ধরা হবে। হাটার ক্ষমতা তো নেই, নেই লাংগল ধরার শক্তি।
কম্পিউটার যদি চালাতে পারিস এক হাতে । কিনতে হইবো বটে কিন্তু এত টাকা কোথায় পাই?
অনেক ভাবে আদি অন্ত। অনেক করে উথাল পাথাল হাসফাস। অবশেষে উপায় না দেখে তাকায় মহেশের দিকে। বেচে দিবো মহেশকে এবার, কিনে দিবো তোর কম্পিউটার যন্ত্র যা দিয়া করবি স্বপ্ন পুরন। আমার তো নেই কোন সঞ্চয়, নাই কোনো টাকা।
বকরের কর্নকুহরে গরম শিশা ঢালার অনুভূতি হলো, কেপে উঠলো আত্বার আরশ। কন্ঠ ছেড়া বুলন্দ আওয়াজে বলে উঠলো বকর, কউকি বাপজান! না না মহেশ আমার প্রান, সে আমার খেলার সাথি। বেহুশ হউয়ার ভংগিমায় তাকায় মহেশের দিকে। গোয়াল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে আছে বাপ ছেলের দিকে মহেশ। দেখছে দারিদ্রের নিষ্ঠুরতা, দেখছে প্রতিবন্ধী বকরের স্বাবলম্বীর পথে সে হতে পারে উপায়। কি কথা বুঝলো মহেশ কি করলো উপলব্ধি। দুচোখের কোল বেয়ে পড়তে শুরু করলো নোনা জল।

মনে পড়ে অভাবের দিনে ঘরে খাবার ছিলোনা বলে বাছুর বয়সে মহেশকে রেখে মাকে নিয়েছিলো হাটে। মায়ের পরে পেয়েছিলো বন্ধু বকরকে। গায়েবি ভালবাসায় আশক্ত ছিলো দুজন। বকরের দুটো পা নেই, একটি হাত নেই মনে ছিলো নিরাশা, জীবনের পরাজয়ের হতাশা। মহেশ ছিলো তার আনন্দ, তার খেলনা, তার প্রানের দুসর।

আজ যান্ত্রিক যন্ত্র কম্পিউটার হলে বহুদুর যেতে পারবে তার বন্ধু, পরাজয় নয় জয়ী হবে জীবনে। লাংগল নিয়ে হাল চাষ নয়, সারা বিস্বজুড়ে চাষ করবে সে। এই কথা ভেবেই মহেশ চোখের পানি ফেলে। মনে মনে তৈরি হয় সে, যাবে হাটে। বিক্রি হবে অনায়াসে। বন্ধুর জন্য এটা তার উপহার। জীবন বিসর্জন দিয়ে আত্বত্যাগ।

বকর বাবজানকে জানায় ধার দেনা কেউ কি দিবে না। মহেশকে হাড়াতে চাই না, সে তো আমার বন্ধু। তাকে ছাড়া আমি একা
গরিবকে ধার কে দেবেরে বাপ?
মহেশকেই নেবো হাটে।
ক্রন্দনরত বালকের মাথায় হাত রাখে পিতা। স্পর্শ মায়ায় আলিংগন করে মহেশকে।
বকর কন্ঠভরা কষ্টের সুর তুলে গলায়। তুই যে আমার প্রানের দোস্ত, তরে ছায়া দেবো, মায়া দেবো, একদিন উঠবে রোদ এই আধার কেটে।

মহেশ ভাবে শেষমেষ যাত্রা হবে কোথায়? কোন সুদুরে। বকরকে হাড়িয়ে সে বেচে থাকবে তো?

বিঃদ্রঃ আবু বকর লার্ন এন্ড লিভের ছাত্র, তার কম্পিউটার প্রয়োজন। নিজে বহু কিছু শিখেছে স্কুলের কম্পিউটার থেকে এখন ঘরের গরুটি বিক্রি করে কম্পিউটার কিনবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তার প্রিয় বন্ধুটিকে বিক্রি হতে দিতে চাই না। সবাই মিলে একটা কম্পিউটার কিনে কি দিতে পারিনা? নিশ্চয়ই পারি। যারা সহায়তা করবেন, কৃতজ্ঞ থাকবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!