সেলিনা জাহান প্রিয়ার ধারাবাহিক গল্প: ‘অ-মানব’-(৩০ তম পর্ব)

‘অ-মানব’-(৩০ তম পর্ব)
———————- সেলিনা জাহান প্রিয়া

আমজাদ সাহেব খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ডাকতে গেল অ-মানব কে। কিন্তু অ-মানব কে দেখে আমজাদ সাহেব অবাক বাগানের মাঝ খানে ধ্যান ধরে বসে আছে। হাত দুটা বিশেষ কায়দায় উপরের দিকে করে।
—- এই অ-মানব
—- স্যার আপনার পায়ে দু’ই জাতের জুতা। একটা ম্যাডামের অন্য টা আপনার।
—–আমজাদ সাহেব পায়ের দিকে চেয়ে একটু অবাক হয়ে বলল তোমার তো চোখ বন্ধ। কি করে দেখলে?
—- স্যার আমার চোখ বন্ধ কিন্তু অন্তর তো বন্ধ না। যেমন স্যার আকাশ দেখে কি বুঝা যায়। আমরা ভেসে আছি এই আকাশের মাঝে।
—- না বুঝা যায় না।
—– ঠিক আমি স্যার বলতে চাই আপনার মনটা আকাশের মত বড়। কিন্ত আপনি পৃথিবীর খবর রাখেন না।
—- আরে দাড়াও। জুতা বদলে আসি।
—- স্যার যেতে হবে না। কারন এত ভোরে কেউ ঘুম থেকে উঠবে না। শুধু পশু পাখি ছাড়া।
—- ঠিক বলেছ অ-মানব। অনেক দিন পড় সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। সকালের মিষ্টি বাতাস খুব মজা।
—- স্যার তাই তো সকালে পশু পাখি জেগে উঠে। কারন যারা সকালে ঘুম থেকে উঠবে তারা সকালের তাজা বাতাস পাবে। ফুসফুস তাজা বাতাস মনে শরীর তাজা।
—-অ-মানব এখন চোখ খুল।
—- স্যার আপনি আমার কাছে আসুন। শরীর থেকে জামা টা খুলে একটা ধ্যান করুন।
—- ধ্যান করলে কি হবে?
—- স্যার জগতের সব মহা মানব ধ্যান করত। যেমন- গৌতম বুদ্ধ। বট গাছ তলে। ইসলামের শেষ নবী মোহাম্মদ সাঃ হেরা পর্বতে।
—- ঠিক তো। আমি চিন্তা করি নাই।
—- ধ্যান হল স্যার আপনার জীবনের প্রাথমিক স্কুল। যদি পাশ করেন তার পর স্যার হাই স্কুল।
—– তুমি এত কিছু কি করে জান।
—– স্যার আমি তো ভাল রান্না করি। তো দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক দিন পীরদের আস্তানায় রান্না করেছি। তখন পীরদের কাছে থেকে শিখেছি। পীররা মানুষ কে কি করে বোকা বানায়।
—- ভাল তো স্যার আজ কি গাছের যত্ন নিবেন। না কি ধ্যান করবেন।
—- কোনটা করলে ভাল হয়।
—- আসুন স্যার আগে ৩০ মিনিট ধ্যান।
আমজাদ সাহেব কে অ-মানব ধ্যানে বসিয়ে বলল স্যার আপনি আজ চেষ্টা করুন। চোখ বন্ধ করে ৩০ মিঃ থাকতে। ৩০ মিনিট হলে আমি আপনাকে বলব। এমন এক সময় আসবে কত মিনিট হয়েছে আপনি নিজেই জেনে যাবেন। আমজাদ সাহেব ৩০ মিনিটের ধ্যানে বসা। অ-মানব আমজাদ সাহেব কে রেখে চলে যায় রান্না ঘরে। খুব সুন্দর করে চা বানায়। সাথে নিয়ে আসে গরম দুইটা রুটি আর একটা খাতা কলম। অ-মানব আমজাদ সাহেব কে বলে স্যার ৩০ মিনিট হয়েছে। আমজাদ সাহেব বলল

——খুব শীত লাগছে।
—– স্যার গরম চা খান। খুব ভাল লাগবে।
—– আমজাদ সাহেব বলল চা কোথায় পেলে।
—– স্যার বানিয়ে আনলাম। সাথে গরম পাতলা রুটি।
—- আমজাদ বলল তুমি তো বাবু আমাকে রীতি মত চমক দেখালে। এটা আমার জিবনে একটা অন্য রকম চমক।
—- স্যার আপনি ধ্যানে বসে মনে মনে গরম চায়ের কথা চিন্তা করছিলেন।
—- আরে একদম ঠিক।
—- স্যার একমাস সকাল বিকাল ধ্যান করলে কার মনে কি আছে জেনে যাবেন। তখন স্যার খুব মজা হবে।
আমজাদ চা আর রুটি শেষ করে বলল। খাতা কেন। খাতা দিয়ে কি হবে অ-মানব।
— স্যার আপনার মালিকে বলবেন বাগানে কি কি গাছ আছে। তার নাম আপনি লিখবেন। আর যা মালি চিনে না। আপনি আপনার মোবাইল দিয়ে ছবি তুলবেন।
—- তার পর।
—- স্যার ইন্টারনেট থেকে এবং বই থেকে কি গাছ কি ভাবে যত্ন নিতে হয়। তার উপর একটা ধারনা নিবেন। এত গাছ কিন্তু ফুল আর ফল নাই কেন। এটা আপনার জানা দরকার। স্যার নিজের হাতের লাগানো গাছের ফুল ফল সবজি আলদা একটা মজা দেখে খেয়ে।।
——আমজাদ সাহেব বলল তুমি কোথায় যাও।
—– বাসার অন্য সবার নাস্তা বানাতে।
আমজাদ সাহেব বাগানে প্রবেশ করে দেখে বাগানে আজ একটাও ময়লা নেই। আমজাদ সাহেব ভীমরুল খাঁ মালিকে ডাক দিল। এই ভীমরুল খাঁ। ভীমরুল খাঁ লাফ দিয়ে উঠে আমজাদ সাহেবর কাছে এসে দাঁড়ালো। আমজদ সাহেব বলল সকাল ৬.৩০ টা বাজে। কয়টা থেকে কাজে লাগার কথা। শুনি।
— স্যার ৫.৩০ মিনিট থেকে।
—-এখন কয়টা বাজে। এটা কি মামার বাড়ি। এক বিঘা একটা বাগান। এখন চল আমার সাথে। পিছন থেকে অ-মানব স্যার আপনার জুতা আর মেডিসিন।
— অহ। থ্যাংকস। বুদ্ধিমান ছেলে। এই ব্যাটা ভীমরুল খাঁ। দেখ কাজ কাকে বলে। আমজাদ সাহেব প্রতিটা গাছের নাম নাম লিখছে। সারা বাগানে মাত্র দেশি কিছু গাছের নাম পেল। বাকি ৭০% গাছের নাম আমজাদ সাহেব জানে না। ভীমরুল খাঁ জানে না। আমজাদ সাহেব যেন নিজেই আজ নিজের কাছে অচেনা।

রেবেকা বেগম রান্না ঘরে। অ-মানব বলল আম্মাজান আপনি এত সকালে। আর বল না অ-মানব। কাল সারারাত ঘুমাতে পাড়ি নাই। বিয়ে হয়েছে ৩০ বছর কেউ তোমার মত করে বলে নাই। আমাকে আজ থেকে রান্না শিখাও। আর মিতা কোথায়।
— আম্মাজান মিতা তো নয়টার আগে ঘুম থেকে উঠে না।
—- এটা কোন কথা হল।
—– আম্মাজান আগে আপনি সাত দিন ঘুম থেকে উঠে স্যার কে নিয়ে একটু বাগানে
সময় দিন। পরে আমার সাথে রান্না। এই সাত দিন কাউকে কিছু বলবেন না। যদি তাদের নিজেদের লজ্জা সরম থাকে তখন দেখবেন নিজ থেকে কাজ করছে।
—- রেবেকা একটু হেসে বলল। বাবা তুমি কিন্তু আসলেই একটা চমৎকার ছেলে। এত কিছু কিভাবে শিখলে।
—- আম্মাজান মানুষ যে খানে ঠেকে সেই খানেই শিখে। শিক্ষার কোন শেষ নাই। এই যে আপনি কত লিখা পড়া করা একজন মানুষ। আপনি বলুন এই লিখা পড়া এখন কোন মানুষের কাজে লাগছে। কিন্তু আমি রান্না পাড়ি তাই আমার একটা কাজ আছে। মানুষ তো কাজের মধ্যে বেছে থাকে।

আমজাদ সাহেবের একমাত্র ছেলে রাজ। একটু অন্য রকম। বাসার কারো সাথে তেমন কথা বলে না। কে আসলো কে গেল কোন কিছুর খবর রাখে না। এই পর্যন্ত অ-মানবের সাথে দেখা হয় নাই। যখন যা লাগবে সব কিছু মা। বাসা থেকে বের হলে সবাই তাকে ভয় পায়। দারোয়ান জাফর তার আসা যাওয়ার সময় হিসাব করে রাখে ঠিক ঐ সময় সে গেইটের সামনে থাকে। অ-মানব সিঁড়ি ঝাড়ু দিতেছে এমন সময় রাজ নামছে। মিতা এসে বলল – এই যে সিঁড়ি থেকে সরেন ছোট স্যার নামবে।
—- ওকে ঠিক আছে।
—- আপানকে আম্মাজান ডাকছে।
অ-মানব ঝাড়ু হাতে নিয়ে আম্মাজানের সামনে এসে দাঁড়ালো।
— কি অ-মানব কি কাজ এখন।
— আম্মাজান সিঁড়ি ঝাড়ু দিব। পানি দিয়ে মুছব।
— না তোমাকে করতে হবে না। এই মিতা এই দিকে আয়। এই ঘড়ি রাখ। আমি দেখলাম এই ছেলে এই ঝাড়ু আর মুছার কাজ ৩৫ মিনিটে করে। অ-মানব তোমার খাতায় টাইম কত লিখা।।
—- আম্মাজান ৩৫ মিনিট।
— ঠিক আছে। মিতা কি কি কাজ করবে আমি দেখে দিচ্ছি। এই মিতা আমার দুই মেয়ে কে ডেকে আন। সায়লা পারু এসে হাজির। আম্মাজান ডেকেছেন।
—- হা দুই জন দুইটা খাতা নিয়ে এক ঘণ্টা পরে আমার সামনে আসবে। যাও। মিতা তুমি এখন ৩৫ মিনিটে ঝাড়ু মুছার কাজ শেষ করে আমার সামনে আসো। অ-মানব আমাকে নিয়ে বাজারে চল। যেই বাজারে মেয়ে বাজার করে।
—- জি আম্মাজান। ১১ টায় বাজারে যাব।
আমজাদ সাহেব রেবেকার কথা শুনে হাসছে। তুমি বাজারে যাবে।
—- সাহেব কি নিয়েই যাব। কোন কাজ না করতে করতে আমরা সব আলসের সরদার হয়েছি। এত টুকু ছেলে কাজ করে। মাগো। রান্না বান্না কাপড় কাচা। ঝাড়ু-মুছা, বাজার, ঘর গোছানো। আমাদের কখন কি লাগবে। এটা আমি দেখে আবাক। এমন সময় রাজ মায়ের কাছে এসে বলল মা টাকা লাগবে। কত টাকা বাবা। দাও হাজার দশেক।
— আচ্ছা দিচ্ছি।
—- অ-মানব ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে আছে। এমন সময় রাজ বলল কি ব্যাপার তুমি কে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন।।
—- রেবেকা বলল এ আমাদের বাবুর্চি বাবা।
— ও কত কয়দিন তোমার রান্না খাচ্ছি।।
—- অ-মানব বলল জি ভাইজান।।
—- আমাকে ভাই জান বলবে না। ছোট স্যার বলবে।
—- জি ভাইজান।
—– আবার ভাইজান বললে কেন। একবার বললে কি কানে শুনা যায় না।
—– জি ভাইজান যায়।
—- আবার ভাইজান।
—– জি আবার
—- এই ব্যাটা আবার কি?
—- ভাইজান।
—- তোমাকে একটা চর দিব কিন্তু
—- আমারও তো হাত আছে।
—- কি আমাকে মারবে।
—- না ভাইজান ফিরাব। আমি কেরাটি মাইর এ পুরুস্কার পাওয়া মানুষ।
আর কিছু দিন কংফু শিখেছি, একটা হাসি দিয়ে বলল। আপনি আমাকে
যতই মারেন আমি কিন্তু ভাইজান ডাকবো।
—-এত দেখি পাগল আম্মু।
সবাই হেসে দিল। এমন সময় রাজ বলল আসলেই এই বাড়িতে সব পাগল থাকে। তা এই পাগলের নাম কি আম্মু।
— ওর নাম অ-মানব।
—- কি অ-মানব। এটা কি নাম। এই অ-মানব। তোমার এই নামের মানে কি?
—- স্যার আমি মানব হতে চাই কিন্তু পাড়ি না।
—- কেন পার না।
—- ভাইজান যারা মানব তারা মানুষকে বিশ্বাস ও করে অবিশ্বাস ও করে। তারা স্বার্থ ছাড়া কিছুই করে না। তাদের সব কিছুই চাই আর চাই। মোট কথায় তারা ভোগে আনন্দ পায়। তাদের মাঝে লোভ লালসা সুখ দুঃখ আছে। কিন্তু আমার মাঝে কিছুই নাই। মানব হতে চেষ্টা করি কিন্তু পাড়ি না।
—- বাহ চমৎকার। মানুষ হতে কত দিন লাগবে।
—- ভাইজান আপনার শরীরে কোন বিষ ফুরা হয়। এটা কবে পেকে বের হবে আপনি বলতে পারবেন। বা আপনি যে ছবি তুলেন তা কেমন হবে না দেখে কি বলতে পারেন।।
—- না পাড়ি না।
—- আমিও কবে মানুষ হব বলতে পাড়ি না।
—- তা কি বলতে পার।
—– ভাইজান এটা সবার সামনে বলতে চাই না। তবে আমি বলতে পাড়ি আপনি
রেগে যাবেন। তবু বলছি আপনি আজ যাকে নিয়ে সময় ব্যয় করবেন। তাকে বলবেন। আমারা বাবা তার সব সম্পদ আমার দুই বোনের নামে লিখে দিয়েছে।
—- কাকে বলব।
—- আজ সন্ধ্যায় যে বন্ধু নিয়ে চাইনিজ খাবেন।
—– রাজ বলল পাগলের দল। মা আমি যাই। আমার কাজ আছে।

চলমান ———–

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!