সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৪০ তম পর্ব)

 

 

অ-মানব-৪০-তম-পর্ব

————————সেলিনা জাহান প্রিয়া

 

বৃষ্টি এর কম কমছে না। বাজারের মানুষ অ-মানব কে দেখছে। বোয়াল মাছ গেদু মিয়া দিয়ে সে খালি হাতে আরও কিছু মাছ ধরতে লাগলো। তার মাছ ধরা দেখে একে একে বৃষ্টির মধ্যে মানুষ এই ছোট নদীতে নামছে। যেই নামে সেই কিছু না কিছু মাছ পাইতেছে। অল্প সময়ের বাজারের অর্ধেক মানুষ সেই নদীর ঘাটে। এত মাছ কোথায় থেকে আসলো তাই নিয়ে সবার মধ্যে কথা হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন বলল এই মানুষটার বাড়ি কোথায় জানি। সে খুবই ভাগ্যবান মানুষ। আর একজন বলল মানুষটা দয়ালু দেখ নাই। ফটিক মিয়ারে কত দামি জুতা গুলো দিয়া দিল। ডাক্তার সাহেব বলল গেদু মিয়া এখন খিচুড়ি তারে খাওয়াতে হবে। বৃষ্টি কমতে শুরু করলো। অ-মানব নদী থেকে মাছ নিয়ে বাজারের মাঝ খানে এসে বসল। ডাক্তার কে ডাক দিয়ে বলল — কি মিয়া ভদ্রলোক নদীতে নামলে তো ভাল মাছ পাইতেন। কিন্তু নামেন নাই তাই আপনার জন্য একাটা মাছ। সবাই অ-মানবের দিকে তাকিয়ে আছে। অ-মানব তাদের মধ্যে থেকে একজন কে ডাক দিল। ভাই জান কাছে আসেন আপনি আজগর আলির ছেলে তো?
—– হ্যা আমি তার ছোট পোলা । আমার বাবারে কেমনে চিনেন?
—–অ-মানব বলল দেখুন আপনি যার তার ছেলে আমি কিভাবে চিনলাম তা জিজ্ঞাস না করে আপনার বাপরে কি ভাবে চিনলাম তা জেনে কি হবে?
—– আমাকে কেমনে চিনলেন?
—– আপনার রে কেমনে চিনলাম তা বলা যাবে না। তবে আপনার বাবা কে আসার পথে চিনেছি । খুবই ভাল মানুষ। একটা কথা বলব একটু কাছে আসেন।
—– আজগর আলির ছোট ছেলে আলম কাছে এসে বলল। কি বলবেন বলেন?
—– এই তিনটা মাছ আপনাদের তিন ভাইয়ের। আর আজ রাতে আপনার বাবা আপনাদের জমি দিতে চাইবেই। আমার সাথে কথা হয়েছে। বলল আর কয়দিন বাচব। ছেলেদের সব দিয়ে যাই।
—– আপনি কে পরিচয় দেন?
—— অ-মানব বলল মাছ গুলো নেন। আমার কাছে আর মাছ নাই। এই কথা বলে ডাক্তার কে বলল কি ডাক্তার মাছ পছন্দ হয়েছে?
—– ডাক্তার বলল ভাই তুমি যেই হও। একটু ভিতরে এসো। তোমার কাপড় গুলো বদলাও !!!
—– ডাক্তার আমার তো আর কাপড় নাই।
—– তা আমি দেখতে পাচ্ছি। এই নাও লঙ্গি আর তোমার জন্য একটা গেঞ্জি নিয়ে আসছে গেদু মিয়া। গেঙ্গি টা নতুন।
—– যাই হউক একটা ভরসা পাইলাম। মানুষ মানুষের জন্য।
—– একজন চা আর ডালপুরি নিয়ে আসলো। এসে বলে বাবা তুমি এই গুলা খাও তোমারে দেখে আমার অনেক ভাল লেগেছে। এই কোন মানুষের ভিতরে আল্লাহ্‌ কি দিয়েছেন তিনিই জানেন।
—– অ-মানব বলল দুঃখী মানুষ গুলো শুধু অন্য মানুষের দুঃখ কিছুটা বুঝতে পাড়ে।
—– আরেক জন বলল বাবা এই গ্রামে কার কাছে আসছ।
—– কারো কাছে না।রাস্তা হারিয়েছি। নিজের বাড়ি কোথায় জানি না। কিছু মনে নাই।
—– ডাক্তার বলল হ্যা বুঝতে পারছি তোমার কথায়। লিখা পড়া কিছু জান।
—— লিখা পড়া করার মত স্কুল পাই নাই। আপনারা যে স্কুলে পাড়ছেন ঐ সব স্কুলে যে যার সুবিধা মত পড়ায়। আমি সুবিধা বিদ্যা পড়ি না।
—– গেদু মিয়া বলল তাহলে কোন বিদ্যা পড়তে চাও তুমি?
—– যে বিদ্যা মানুষ কে মানুষ বানায়।
—– লিখা পড়া করে কি আমারা মানুষ হয় নাই।
—–তাহলে আপনারা সবাই শিক্ষিত মানুষ। আজগর আলির ছোট ছেলে আই এ পাশ সেও তো শিক্ষিত। কিন্তু দেখুন তারা তার বাপের চোখ অপারেশন করাইয় না। বাপ ভাল হলে যদি বিয়ে করে। নতুন বউয়ের যদি বাচ্চা কাচ্চা হয়। তাহলে সম্পদের ভাগীদার হবে। যে শিক্ষা মানুষ হয়ে মানুষের অধিকার দিতে জানে না
না সেই শিক্ষা নিয়ে আমি কি করব?
বাজারের সবাই বলল হ এই মানুষটা সত্য বলেছে। ডাক্তার একটু হেসে বলল এই ভাই আগে জামা কাপড় বদলাও। দেখ রোদ উঠেছে। অ-মানব বলল গোলামেরর কাজ গোলামী করা। দেখুন এই সূর্যকে যে বানাইছে আমাদের সে বানাইছে। এত বড় সূর্য সে তার কাজ ঠিক মত করে যায়। কিন্তু আপনারা নাকি সৃষ্টির সেরা কিন্তু যে বানাইছে তার কাজ কেউ করেন না। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। আজগর আলির ছেলে আলম বলল আপনি কথা সুন্দর বলেন। আমার বাবা কে তো ভাল করে চিনেন না। খুবই কঠিন মনের মানুষ। চোখ ভাল হলেই একটা বিয়া করবে। আল্লাহ্‌ যা করে ভালই করে।
অ-মানব বলল যে বাপ আপনাকে জন্ম দিয়েছে। যার জমিতে চাষ করে খান। যে বাপের আদরে এত বড় হলেন সেই বাপের জন্য কিছু করেন না। আলম মিয়া বলল থাক আপনার কাছ থেকে ফ্রি জ্ঞান নিতে হবে না, নিজের কাজ করেন। ধান্দাবাজির জায়গা পান না।
অ-মানব আলমের দিকে চেয়ে হেসে বলল – দুনিয়ার সব চোর মনে করে সবাই চোর। পাগল মনে করে অন্য সবাই পাগল। ডাক্তার বলল ভাই থাক তুমি ওর সাথে কথা বলনা। গেদু মিয়া বলল ঐ মিয়া পাগল কি দিয়ে খিচুরি খাইবা বল?
—– অ-মানব একটু হেসে বলল যা দিয়ে খেতে চাই তা পাড়বেন না।
—- কি এমন জিনিস যে পারব না বল শুনি?
—- হরিণের মাংস?
—- এটা তো সম্ভব না।
—- আমি তো তাই বলেছি। সবার পক্ষে সব সম্বব না। তবে আপনার একজন সৎ মা আছে তিনি সবজি দিয়ে খুব সুন্দর খিচুড়ি রান্না করে সেটা খেতে আমার খুব ইচ্ছা করছে।
—- এটা তো আরও সম্বব না।
—- অ-মানব বলল আচ্ছা আপনার প্রথম স্ত্রীর হাতে হলেও চলবে।
—– আরে মিয়া তুমি তো আজব এখন তো আরও কঠিন। আর তুমি এত কিছু কি করে জানো?
—– অ-মানব বলল ডাক্তার গেদু মিয়া আমাকে খিচুড়ি খাওয়াতে পারবে না। দেখছেন আমি জানি তার কোন যোগ্যতা নাই। গেদু ভাই আপনে ফেইল। ডাক্তার বলল ভাই রাতে আজ আমার সাথে আমার বাড়িতে চলেন। আল্লাহ্‌ যা রেখেছে কপালে তাই খাবেন।

অ-মানব একটু হাসি দিয়ে বলল কঠিন কথা আমার কাছে কোন উত্তর নাই। তবে ডাক্তার আমি কিন্তু গেদু মিয়ার কিছুরি না খেয়ে যাব না।
ডাক্তার বলল আচ্ছা গেদু ভাই খাওয়াবে।

অ-মানব বলল হয়ত হরিণ না হয় অন্য যে কোন দুই জনের একজন। বাজারে মানুষ বলছে এই মানুষটা আজ গেদু মহাজনকে বাঁশের চিপায় ফেলছে। আজগর আলির তিন ছেলে রাতে খেতে বসছে অ-মানের সেই মাছ দিয়ে । বড় জনের বউ এসে বলল কই গো শুনছ তোমার বাবা বলছে জমি নাকি সব তোমাদের দিয়ে দিবে এখন তোমরা কই বাপের পছন্দ মত নিবা নাকি তোমাদের পছন্দ মত।
বড় ছেলে বলল- বাপে কই চোখে দেখে যে পছন্দ করে দিবে? মেজু বলল আমারা আমাদের পছন্দ মতে নিব।
ছোট ছেলে চুপ করে গেল কোন কথা বলছে ন। দুই ভাই বলল কই রে কিছু যে বলিস না? ছোট ছেলে একটু বুদ্ধি করে বলল তোমাদের দুই জনের যা পছন্দ তাই আমার সিদান্ত। তোমারা আমার আমাকে যা বলবে তাই হবে। বড় জন বলল এটা ঠিক বলেছিস। তাদের খাওয়া শেষ।
বড় বউ তার স্বামী কে বলল বাজারের সাথে বড় জমি আমার চাই , আর বড় রাস্তার পাশে যে জমি সেটাও। মেজ মিয়ার কোন ছেলে নাই। তাদের ভাল জমি দিলে সেই জমি পাবে মেয়ের জামাই। ছোট মিয়ার তো এখনো পোলাপান হয় নাই। তার মাঝের জমি দিলেই হবে।
মেজু মিয়ার বউ রাতে স্বামী কে বলছে দেখ আমার কোন ছেলে নাই বাজারের পাশের জমি হলে আমাদের মেয়ে কে কোন ভাল ব্যবসায়ীর ছেলে বিয়ে করবে।
ছোট ছেলের বউ বলে দেখ বড় রাস্তার জমি তুমি নিবা। ঐ খানে একটা রাইস মিল করবা। না হয় স মিল। আমি বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিব।
গেদু মহাজন তার বউ কে বলল আজ বাজারে একটা আজব মানুষ আসছে। বোয়াল মাছটা সেই লোকের দেয়া। নদী থেকে মাছ টা বৃষ্টির সময় ধরেছে। লোকটা আমাকে খুব কঠিন বিপদে ফেলছে। বাজারে হাজার মানুষের সামনে। তারে খিচুড়ি খাওয়াতে হবে।
—– খিচুড়ি আর এমন কি? রান্না করে খাওয়াতে হবে। আমি রান্না করে দিব বাজারের লোক নিয়ে খাবে।
——আরে আমি ঐ ব্যটার কথার ফেরে পড়ে গেছি। এমন ফেরে যা সম্বব না। কিন্তু খিচুড়ি না খাওয়াইতে পাড়লে বাজারের আর মজাজন গিরি করা যাবে না। সবার কাছে ইজ্জত আর থাকবে না।
—— কি এমন কথার ফের যে ইজ্জত থাকবে না?
—— আরে পাগল বউ আমার। আমি বলেছে কি দিয়ে খাবে খিচুড়ি। লোকটা বলল প্রথমে হরিণ মাংস। আমি বললাম সম্বব না। তখন বলল আমার বাপের ২য় বউ। যারে তোমার কথায় বাড়ি থেকে বের করলাম তার হাতের। না হয় আমার প্রথম বউ দিলুর মায়ের হাতে।
—– পাগল এত কিছু জানে কি ভাবে? আরে একটা থাপ্পড় দিতে পার নাই।
—— তাহলে বাজারের মানুষ আমারে আনাম রাখব মনে করছ।
—— এখন এই পাগল ছেরা কোথায়?
—— ডাক্তারের বাড়িতে। তুমি তো জান ডাক্তার আমার সব চেয়ে গোপন শত্রু।
—— তুমি যে কেন যাও এই সব মানুষের সাথে। এখন কয়দিন বাজারে যাবা না বলবে তোমার জ্বর। বাকিটা আমি দেখছি। এই পাগল কে। আমিও ডাকাত গফুরের মেয়ে। মানুষ চিনে না। তুমি ঘুমাও। এটা মনে হয় কোন চক্রান্ত। আর ডাক্তারের কেন এত আগলা প্রেরিতি পাগল ছাগল নিয়ে। আমি হলাম গফুর ডাকাতের মেয়ে হাজানারা বেগম।
—– গেদু মাহাজন বলে আরে বেশি কথা না বলে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর। ডাক্তার আবার কোন কথা শিখায় দেয় কে জানে?
—– আরে কি আর শিখাইব গ্রামের এক কথা সবাই জানে। দরকার পড়লে বাজারে এক মন চালের খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ায়ে দাও। ডাক্তার কি জানে না তোমার টাকা পয়সা কি কম আছে।

ডাক্তারের বাংলা ঘরে শুয়ে আছে। ডাক্তারের ছোট মেয়ে ময়না তার বাবা কে বলে, আব্বু এই মানুষটা কে। পাঁচ বছরের ময়না অনেক বেশি কথা বলে তাই তার মা তাকে ধমক দিয়ে বলে তোমার জানা কি দরকার। তুমি ঐ লোকের সামনে যাবে না। আমার একটা মেয়ে যদি পালিয়ে নিয়ে যায়। আজ কাল কত ধরনের চোর ডাকাত আছে। আর তুমিও পার চিনা নাই জানা নাই একটা অচেনা মানুষ কে বাড়িতে নিয়ে আসছো। এত মানুষ দরদি ভাল না। তোমার কত দুষমন। ডাক্তার বলল আরে তুমি না জেনে এত কথা বলছ। আমি একটা বিষয়ে খুব অবাক হয়েছি।
—– কি বিষয় অবাক হয়েছ শুনি।
—– আমাদের নদীতে বৃষ্টির সময় এত মাছ থাকার কথা না। আর এই মানুষ সেই নদী থেকে অনেক মাছ ধরেছে। গ্রামের অনেক মানুষ এই মানুষটার সাথে নদীতে নামে যারা নেমেছে সবাই ভাল মাছ পেয়েছে। আর একটা বিষয়। তার পায়ের জুতা ছিল খুব দামি। সে তার জুতা গুলো আমাদের গ্রামের একজন গরীব মানুষ কে নিজ হাতে পড়িয়ে দিল।
—– আরে ডাক্তার তুমি বোকা মানুষ। এটা দেখায়ে মানুষের সহানুভূতি নিল।
—– আরে না। সে তো আমার বাড়িতে আসতে চায় নাই আমি নিয়ে এসেছি। অনেক রাত হল খাবার কিছু দিয়েছ।
—– হ্যাঁ দিয়েছি।
—— কিছু বলল?
—– আমিও কিছু বলি নাই সে বলে নাই।
—– মানুষটার চা খুব পছন্দ তুমি যদি পার একটু চা দিও। ডাক্তারর বউ চা নিয়ে অ-মানবের কাছে আসে। অ-মানব পশ্চিম দিকে ফিরে ধ্যান করছিল। খুব শান্ত ভাবে মাটিতে একটা চট বিছিয়ে সেই চটে বসে ধ্যান করছে। ময়না বলল মা চা আমি দেই। মা বলল -না তোমার দিতে হবে না। আমি দেই। এই বলে অ-মানব কে এই যে চা নাকি খুব পছন্দ চা নেন। অ-মানবের চোখ বন্ধ।

—– অ-মানব বলল আপা চা আমার খুব পছন্দ। কিন্তু আপনি চাতে চিনি দিতে ভুলে গেছেন। দুধ চা চিনি ছাড়া মজা লাগে না।
—— ডাক্তারের বউ চামুচ দিয়ে চা মুখে নিয়ে একদম বোকা চিনির বদলে লবন দেয়া।
—– তুমি কি করে জান চিনি দেই নাই? তাহলে বল কি দিয়েছি?
—– আপা চায়ে লবন দিয়েছেন। মানুষ যখন একসাথে চিন্তা আর কাজ করে তখন চিন্তায় ও কাজে ভুল করে। আপনি তাই করছিলেন। আপনি আমাকে অপছন্দ করলে মন খুলে বলেন। যদিও বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে তবু আমি এই রাতে চলে যেতে পারব। আমি চাইনা আমার জন্য কেউ কষ্ট পাক। নারী মায়ের জাত যে নারী কে সম্মান দিতে জানে না। সে তো তার নিজ মাকেই সম্মান দিতে জানে না।
—— না ভাই তোমার যেতে হবে না। আমি অবাক হয়েছি যে তুমি আমার চায়ের ভুল না দেখেই ধরে দিলে। এখন বল? তোমার প্রিয় চা কি? রং চা দিব। না কি দুধ চা দিব।
—– অ-মানব বলল আপা দুধ চা তবে একটু আধা দিয়ে দিবেন।
—– দুধ চায়ে আদা?
—– হ্যা আপা খুব মজা আপনি একটু খেয়ে দেখবেন। চা পাতা দেয়ার আগে আদা দিবেন ।

চলমান ——-

অ-মানব-প্রথম পর্ব    অ-মানব-দ্বিতীয় পর্ব    অ-মানব-তৃতীয় পর্ব    অ-মানব-চতুর্থ পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!