আদিবাসীদের বিজয় অষ্ট্রেলিয়ায়

আদিবাসীদের বিজয় অষ্ট্রেলিয়ায়
রণেশ মৈত্র (একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

ইংরেজি নববর্ষ ২০২১ এর প্রথম দিনে দেশ থেকে কোন সুসংবাদ না পেলেও সুদুর অষ্ট্রেলিয়া থেকে একটি বিশেষ সুসংবাদ পেয়ে তা নিয়ে কিছু লিখবো ভাবছিলাম। সুসংবাদটি আদিবাসীদের মর্য্যাদা সংক্রান্ত ব্যাপারে। পরদিন, ২ জানুয়ারি আমাদের কতিপয় জাতীয় পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, “আদিবাসীদের ইতিহাস প্রতিফলিত করতে জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন” শিরোনামে। খবরটি আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদেরকে জানাতে নীচে উদ্বৃত করছিঃ
“নতুন বছরে বদলে গেল অষ্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত। দেশটার সরকার বলছে, দেশটির আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে প্রতিফলিত করতে এই পরিবর্তন আনা হলো।
এতদিন অষ্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতে সেখানকার জনগোষ্ঠীকে “তরুণ ও স্বাধীন” বলে উল্লেখ হতো। সেটিকে পরিবর্তন করে এখন থেকে ‘আমরা সবাই এক এবং স্বাধীন’ যুক্ত করা হয়েছে। দেশটির নাগরিকরা এ বছর থেকে ভিন্ন সংস্করণে জাতীয় সংগীত গাইবেন। জাতীয় সংগীতে অতীতের মত এখন থেকে আর “ইয়ং এ- ফ্রি” উল্লেখ করা হবে না। দেশটির দীর্ঘ নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস তুলে ধরতে এটা করা হয়েছে।
জাতীয় সংগীতের এমন পরিবর্তন সবাইকে অবাক করলেও তা সর্বত্র সাধুবাদ পাচ্ছে। এতে দেশের মধ্যে ঐক্যের চেতনা আরও সুদৃঢ় হবে বলে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করছেন অষ্ট্রেলিয়ার প্রধান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমাদের এই ভূমিতেআদিকাল থেকে এই মানুষের বাস করে আসছেন। আমাদের ইতিহাসে ৩০০ জাতিসত্ত্বা ও ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে তার প্রতিফলন প্রয়োজন এবং জরুরী। স্কট মরিসন বলেন, আমাদের এই নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই আকাংখার বাস্তবায়ন হলো।
অষ্ট্রেলিয়ার আজ থেকে ৫০ হাজার বছর পূর্বেই মানুষের আগমন হয়েছে। তবে এ দেশে বৃটেন থেকে মানুষ আসে ১৭৮৮ সালে। এ উপলক্ষ্যে প্রতি বছরের ২৬ জানুয়ারি সারা দেশ ছুটি পালন করে।
এ কারণে, অপরদিকে, আদিবাসীরা এই দিনকে “আগ্রাসনের দিন” হিসাবে আখ্যায়িত করেন। জানা যায়, বৃটিশরা প্রথমে অষ্ট্রেলিয়ায় সৈন্য পাঠায়। সম্প্রতি আমেরিকাতে “ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স” আন্দোলন সুরু হলে অষ্ট্রেলিয়াতেও এই ইস্যুটি আলোচনায় আসে। উল্লেখ্য, সেখানকার আদিবাসীদের গায়ের রংও কালো।
জীবনে এযাবত পাঁচবার অষ্ট্রেলিয়ায় দেখেছি। অল্প সময়ের জন্য হলেও, দেশটির নানাস্থানে আদিবাসীদের দেখেছি-দেখেছি তাদের কষ্টকর আবাসন।
এতকাল পর সেই অবহেলিত আদিবাসীদের জন্যে জাতীয় সংগীতের সংশোধন করায় সেদেশের সরকারকে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকে অভিনন্দন জানাই।
এই আদিবাসীদের সহসেই ইংল্যান্ড থেকে আসা সাজাপ্রাপ্তদের সাথে বহু বছর ধরে প্রত্যক্ষ এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে অগণিত (লক্ষ লক্ষ) আদিবাসী নিহত হন কারণ তাঁদের হাতে ছিল হাতে তৈরী সাধারণ অস্ত্র যেমন, তীর-ধনুক, লাঠি, ফালা, সড়কি অপরদিকে ইংরেজদের হাতে ছিল তুলনামূলকভাবে আধুনিক অস্ত্র। তা সত্বেও বিপুল সংখ্যক ইংরেজকেও আদিবাসীদের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারাতে হয়। সে যুদ্ধ ভিন্নভাবে হলেও, আজও যে অব্যাহত আছে, অষ্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতের সাম্প্রতিক সংশোধন তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। অষ্ট্রেলিয়ার সরকারের উপর সেখানকার আদিবাসীদের ক্রমাগত এবং ধারাবাহিক চাপের ফলেই যে এটা সম্ভব হলো তাও সহজেই অনুমেয়। তাই অষ্ট্রেলিয়ার আন্দোলনেরও আদিবাসী, তাদের ভাষা, এবং রিজিন্যালদেরকে জানাই অভিবাদন জানাই স্যালিউট।
অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা যুদ্ধ চালাতে গিয়ে যে বিপুল প্রাণহানির শিকারে পরিণত হয়েছেন তার চিত্রটি তুলে ধরছি। ইংরেজরা ১৭৮৮ সালে জাহাজে করে সমুদ্রপথে এসে অষ্ট্রেলিয়ার মহাসাগরের তীরে যখন অবতরণকরে-তখন আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭,৫০,০০০ (সাড়ে সাত লক্ষ)। ১৯০০ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৩,০০০ এ। ইতিমধ্যে অবশ্য তাদের সংখ্যা বাড়ছে সশস্ত্র যুদ্ধ বন্ধের ও শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি ঘটিয়ে উন্নততর জীবন ধারা তৈরী মাধ্যমে।
তাঁদের অসংখ্য নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, নৃত্য রয়েছে। বহু ভাষার অপর আজও আবিস্কৃত না হলেও তাঁদের মুখে মুখে তা প্রচারিত হয়ে থাকে।তারা সিনেট সদস্য পদও পান-অর্থাৎ অষ্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতেও তাঁরা মোটামুটি একটা মজবুত অবস্থান তৈরী ও সংহত করেছেন।
আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগতের বহু খ্যাতনামা লেখক অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে বেশ ভাল সংখ্যক বইও প্রকাশ করেছেন।
আদিবাসীদের উপর অষ্ট্রেলিয়া ইংরেজদের অত্যাচার ছিল বহুমুখী। উপেক্ষা ছিল চরমে নিষ্ঠুরতা ছিল সীমাহীন। তাদের হাজার হাজার কোলের শিশুকেঅপহরণ করে নিয়ে বহু ইংরেজ নিজ বাড়ীতে আটকে রেখে গৃহকর্মী বানিয়েছিলেন এ জাতীয় অনেক মেয়ে শিশুর গর্ভে মিলিত রক্ত জাত অনেক শিশুর জন্ম দিয়েছেন।এইভাবে জন্ম নেওয়া শিশুরা আজ অষ্ট্রেলিয়ার মূল জনস্রোতে মিশে গিয়েছেন-তাদের আর আদিবাসী পরিচয় নেই। এ জাতীয় নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে কিছুদিন আগে পর্য্যন্তও সে দেশের আদিবাসীরা ছিলেন সবর। এখন আর এ জাতীয় নিষ্ঠুরতা ঘটছে না। কিন্তু গোটা আদিবাসী সমাজকে আজও নানাবিধ বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে।
২০২০ সালে যখন আমেরিকা সহ নানা দেশে “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলন চলছিল-তখন তার রীতিমত প্রভাব পড়েছিল সুদূর অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যেও।
আমার একটি অত্যন্ত সুখকর খবর বা ঘটনা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটেছিল-যখন বিগত ২০০০ সালে আমি অষ্ট্রেলিয়াতে গিয়েছিলাম। একটিদন সেখানকার টেলিবিশনে লাইভ প্রচারিত হচ্ছিল সেখানকার ফেডারেল পার্লামেন্টের অধিবেশন। এক পর্য্যায়ে দেখি, তৎকালীন লেবর পার্টি মনোনীত প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড দাঁড়িয়ে আদিবাসীদের উপর দুই শতাব্দী যাবত পরিচালিত অত্যাচারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়ে বলে উঠলেন, “স্যরি”। এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা একের পর এক বিজয় অর্জন করে চলেছেন। তাঁরা তাঁদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিও অর্জন করেছেন। তাতে গৌরবান্বিত হয়েছে অষ্ট্রেলিয়াও। সমৃদ্ধতর হয়েছে তার। তবে ভূমি আন্দোলন আজও চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। বহিরাগত ইংরেজরা তাঁদের জমি দখল করে নিয়ে তা দেখে সর্বহারায় পরিণত করেছেন।
বাংলাদেশ সংখ্যায় অল্প হলেও বাংলাদেশের পাহাড়ী এবং সমতলভূমি এলাকাগুলিতে বেশ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় বাস করছেন। কিন্তু তাঁদের “আদিবাসী” হিসেবে কোন সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজও অর্জিত হয় নি। এমন কি, জাতিসংঘ ঘোষিত আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবসও সরকারি উদ্যোগে পালিত হয় না। সংবিধানে লেখা হয়েছে “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী”। এই পরিচিতি প্রত্যাখ্যান করেছেন দেশের সমগ্র আদিবাসী সমাজ।
সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নব্বই এর শেষ দিকেস্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আজও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয় নি দীর্ঘ ২৩-২৪ বছরেও। পরিণতিতে পাবর্ত্য এলাকার আদিবাসীদের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সেখানকার আইন সৃংখলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ আদিবাসীদের। নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন প্রায় ৩০ বছর আগে। আজও তাঁর মৃত্যুর তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় নি। এ বিষয়ে মামলারও কোন অগ্রগতি নেই। এ ছাড়াও ওখানকার আইন শৃংখলা বাহিনীর বিতর্কিত ভূমিকায় অনেক আদিবাসীকে আজও প্রাণ হারাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ।
জমির দাবী বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যেও ব্যাপকভাবেই রয়েছে। রয়েছে তাদের অনেকগুলি ভাষা। এর মধ্যে কিছু ভাষার কথ্য রূপও চালু আছে। লিখিত অক্ষরও তৈরী হয়েছে-বহু পুস্তকও বেরুচ্ছে আদিবাসীদের জীবন নিয়ে। বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান লেখক তাঁদের মধ্যে জন্ম নিয়েছেন আবার অনেক বাঙালিও আদিবাসীদের উপর বাংলা ভাষায় বই পুস্তক রচনা ও প্রকাশ করেছেন।
আদিবাসীরা গোটা বাংলাদেশে এবং অবিভক্ত ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অমন সাহসিকতার সাথে লড়াই করতে গিয়ে ইংরেজদের হাতে নিহত হন। তাঁদের এ আত্মদান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
বাংলাদেশ সরকার অষ্ট্রেলিয়ার সরকারের পদক্ষেপ দেখে এবং দেশের আদিবাসীদের দাবী ও আন্দোলনের পটভূমিতে তাঁদেরকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে জমির মালিকানার স্বীকৃতি, আদিবাসীদের নিজ নিজ ভাষায় শিক্ষাদানের জন্য আদিবাসী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিধ্যালয় স্থাপন করতে এগিয়ে এলে বিশ্বব্যাপী অভিনন্দিত হবেন।


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!