উন্নত জীবনের সন্ধানে ইতিহাস বিশ্লেষণ ও আমাদের কর্তব্য

উন্নত জীবনের সন্ধানে ইতিহাস বিশ্লেষণ ও আমাদের কর্তব্য
এন এন তরুণ

আজকের পৃথিবীর অধিবাসী আমরা এই যে আধুনিক, উন্নত, আরামদায়ক, সহজ সুন্দর জীবন যাপন করছি, সব কাজ এত দ্রুত ও স্বাচ্ছন্দে করতে পারছি, তা কীভাবে পারছি? মানব সভ্যতা উন্নতির এই পরাকাষ্ঠায় কীভাবে পৌঁছলো- এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই পাওয়া যাবে আজকের বাংলাদেশের ও বিশ্বের ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্ট দূর্বীসহ ও ভয়াবহ যে অবস্থা, তা থেকে উত্তরণের পথ।

ইতিহাসকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ঐতিহাসিক কয়েকটি ঘটনা আজকের এই আধুনিক পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে। পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টদশ শতক পর্যন্ত ইতালিতে শুরু হয়ে সমগ্র ইউরোপে যে রেনেসাঁ ঘটেছিল। ইংল্যাণ্ডের গৃহযুদ্ধের ও গ্লোরিয়াস রেভ্যুলেশনের মধ্য দিয়ে বিল অফ রাইটস প্রতিষ্ঠা (যার প্রভাবে আমেরিকাতেও বিল অফ রাইটস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল), চার্চের উপর পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য, রাষ্ট্র থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ। ১৭৮৯-১৭৯৯ সাল পর্বে ফরাসী দেশে সংঘটিত ফরাসী বিপ্লব। রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব। এই ঘটনাগুলোই আজকের আধুনিক পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে কারণ এই ঘটনাগুলো ব্যক্তির চিন্তার, কর্মের ও সৃজনশীলতার পথ খুলে দিয়েছিল। রোগ নির্ণয় ও আরোগ্য, আয়ুবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মৃত্যুহারের পতন, অর্থনৈতিক ও বস্তুগত সম্বৃদ্ধি, স্বাচ্ছন্দ্য তথা আধুনিক উন্নত জীবন যে শিল্পবিপ্লব সম্ভব করেছে, সেই শিল্পবিপ্লবের শেকড়ও প্রথিত ছিল উপরেল্লেখিত ঐ সব ঘটনাসমূহের মধ্যে অর্থাৎ ঐ ঘটনাগুলো না ঘটলে শিল্পবিপ্লব কখনই ঘটত না এবং মানবজাতির পক্ষে আজকের এই উন্নত জীবন অর্জন সম্ভব হত না।

ঐ যে ঘটনাগুলো, ঐ ঘটনাগুলোর অন্তর্নিহিত মূল সুর কী ছিল? ঘটনাগুলো কেন ঘটেছিল, যাঁরা এর পুরোধা বা নায়ক তাঁরা কেন এর সূচনা করেছিলেন, কী অর্জন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা, কেন এগুলো ইতিহাসে বৈপ্লবিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত? এই বিশ্লেষণ আজ জরুরী কারণ এর মধ্যেই আধুনিক পৃথিবীর জন্মের bবীজ উপ্ত। ধর্মীয় মৌলবাদ সভ্যতাকে যে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে সেই ধ্বংসের হাত থেকে সভ্যতাকে যদি রক্ষা করতে হয়, মানুষের জীবনকে আরও উন্নতির দিকে নিতে হয় তাহলে ঐ সব ঘটনার মর্মার্থ বুঝতে হবে, যে আদর্শ ও মূলনীতির উপর ঐ বৈপ্লবিক ঘটনাগুলো ঘটেছে তা বুঝতে হবে।

উল্লেখিত ঐ প্রতিটি ঘটনার মূলে ছিল রাজতন্ত্র ও জমিদারতন্ত্রের বিপরীতে সাধারণ্যের প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব, ঈশ্বরের বিপরীতে মানুষে তথা দৃশ্যমানতা্য আস্থা, ইহকালের বিপরীতে ইহজাগতিকতার গুরুত্ব, জীবন চালনার ক্ষেত্রে ভাবের বিপরীতে বস্তুর, বিজ্ঞানের, বিজ্ঞান-মনষ্কতার ও যুক্তির আশ্রয়।

রেনেসাঁর মূল কথা ছিল ‘মানুষের জন্য শিল্প’, পরকাল নয়, লক্ষ্য এই জীবন- ইহকাল, ইহজগত। মানুষের জন্য সব কিছু, সর্বত্র মানুষ, মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। সংস্কৃতি হবে ইহজাগতিক আর সংস্কৃতি মানে বাঁচা- নিজের জন্য ও অপরের জন্য সুন্দরভাবে ভালভাবে এই জীবনে বাঁচা। এর পর আঠারো শতকে ঘটে ফরাসী বিপ্লব। উদার ও সর্বাত্মক মৌলিক পরিবর্তনকামী ধ্যান-ধারণার উপর সংঘটিত ফরাসী বিপ্লব আধুনিক ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে, ফরাসী বিপ্লবের ঢেউ পৃথিবীর বহু দেশকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে ও উদার গণতন্ত্রে ফিরিয়ে এনেছে। দেশ হবে সাধারণ মানুষের, শাসন হবে জনগণের, জনগণের জন্য ও জনগণের দ্বারা নির্ধারিত হবে জীবন প্রণালী- কোন কল্পিত অদৃশ্য শক্তির কল্পিত প্রত্যাদেশে নয়। এই ছিল আদর্শ, নীতি ও দর্শন এই আধুনিক পৃথিবী নির্মাণের।

এই আদর্শ, নীতি ও দর্শন মানুষের মধ্যে, বিশেষ ক’রে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপকভাবে সঞ্চারিত করা দরকার। ধর্মের নীতি শুধুই ব্যক্তির নিজস্ব চর্চার মধ্যে থাকতে পারে- কোনক্রমেই তা রাষ্ট্রে ও যৌথ জীবনে ব্যবহৃত হতে দেয়া যাবে না। যদি দেয়া হয়, মানব সভ্যতা পিছনের দিকেই ধাবিত হবে- ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ এই শিক্ষাই আমাদের দেয়। অথচ আজকের প্রগতিবাদী লেখকেরা যখন ঐ সব নীতি, আদর্শ ও দর্শন এর পক্ষে কথা বলতে চান, রাষ্ট্রীয় তথা যৌথ জীবনে ধর্ম ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তখন ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাঁদেরকে নির্মমভাবে চোরা-গোপ্তা হামলায় একের পর এক হত্যা করে চলেছে আর বাংলাদেশ সরকার তাঁদের মদদ ও প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। এই মৌলবাদীদের ও সরকারের মৌলবাদ তোষণের নীতির বিরুদ্ধে সবাই মিলে এখনই যদি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে না তুলি, আমাদের সবার জীবনে অচিরেই নেমে আসবে ভয়াবহ ঘোর অন্ধাকার।

লেখক পরিচিতি
এন এন তরুণ পেশায় অর্থনীতিবিদ্‌। সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির ইকোনোমিক্সের প্রফেসার।পড়াশুনা করেছেন ইংল্যাণ্ডের ইউনিভার্সিটি অফ লীডজ, লণ্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স ও বাথ ইউনিভার্সিটিতে। তিনি একাডেমিক বিষয় হিসেবে অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে লেখেন। অস্ট্রেলিয়া,
থাইল্যাণ্ড, রাশিয়া, ইংল্যাণ্ড, কানাডার বেশ কিছু ইউনিভার্সিটিতে ও কনাফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করেছেন, লেকচার দিয়েছেন ড. তরুণ- রয়্যাল ইকোনোমিক সোসাটি (ইংল্যাণ্ড), ডিভেলপমেন্ট স্টাডিজ এসোসিয়েশন (ইংল্যাণ্ড), বাথ রয়্যাল সায়েন্টিফিক এণ্ড লিটারেরী ইন্সটিইউট (ইংল্যাণ্ড), অস্ট্রেলিয়ার মারডক ইউনিভার্সিটি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি, ২০১৮-এর জানুয়ারীতে ফিলাডেলফিয়াতে আমেরিকান ইকোনোমিক এসোসিয়েশন কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!