এবারের পহেলা মে তে যা ভাবছি

এবারের পহেলা মে তে যা ভাবছি
সিডনীর কথকতা-১৭
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

পহেলা মে মে দিবস। দিবসটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে খ্যাত। বিশ্বের বেশীর ভাগ দেশে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষেরা নানা সমাবেশ, মিছিল, শ্রমিক-জনসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করছেন। অনেক দেশে সরকার এই দিবসটি সরকারী ছুটির দিন হিসাবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ও এর ব্যতিক্রম নয়। এইদিন পৃথিবী ব্যাপী শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ সকল দেশের শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের সকল সংগ্রাম, আন্দোলন, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা, বিজয়োল্লাস প্রভৃতি সকল কিছুর সাথে সংহতি ঘোষণা করে দিবসটির আন্তর্জাতিক চরিত্র সংহত করছেন।

কিন্তু আমি তো বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়ায় আছি। আগেও কয়েকবার এসেছি। সম্ভবত: পঞ্চম দফায় অষ্ট্রেলিয়ান মে দিবস দেখবো এবার। কারণ এর মধ্যে চারবার অতীতে দেখেছি। কোন কিছুই নেই। এ দেশের মানুষেরা মে দিবস কি-কেন তার বিন্দু বিসর্গও অবগত নন, অবহিতও নন বলে মনে হয়। দিব্যি ঐ দিন সমস্ত সরকারী, বে-সরকারী অফিস আদালত সব খোলা। কলকারখানাতে সবই রীতিমত নিত্যদিনের মত কাজ-কর্ম চলছে। যেন কোন ব্যাপারই না পহেলা মে তারিখটা।

অথচ অষ্ট্রেলিয়ার শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের অতীতের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহু কিছু আদায় করে নিয়েছেন – যা দেখে মনে রীতিমত বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়। কারণ এখানে সকল শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষকে বাধ্যতামূলক ভাবেই ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের সদস্য হতে হয়। নিয়মিত চাঁদাও দিতে হয়। আর প্রতিটি শিল্পে একটি করে মাত্র ট্রেড ইউনিয়ন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ট্রেড ইউনিয়ন গুলির উপর দেখি না। শুনেছি, শতকরা অন্তত ৮০ ভাগ ট্রেড ইউনিয়নই বর্তমানে এবং দীর্ঘদিন যাবত বিরোধী দল অষ্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। লেবার পার্টি দীর্ঘদিন যাবত বিরোধীদল হিসেবে সংসদের ভিতরে ও বাইরে কাজ করে চলেছে। কিন্তু কোন ট্রেড ইউনিয়নকেই সরকারী দল লিবারেল পার্টি বলছে না – তাদের দলের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতারাও সুবিধে বুঝে সরকারী দলে যেতে প্রলুব্ধ হচ্ছেন না। চিত্রটি আমাদের দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং অবশ্যই গণতান্ত্রিকও প্রশংসনীয়।

তদুপরি এখানে সকল ক্ষেত্রেই শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের নি¤œতম মজুরীর হার প্রতি ঘন্টায় ২০ ডলার যা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা প্রতি ঘন্টায়। দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করতে হয়। ফলে প্রতিদিনের রোজগার শ্রমিকদের অন্যূন ১০,৪০০ থেকে ১১,২০০ টাকা। সপ্তাহে দুদিন ছুটি। ফলে ২২ দিনে যদি মাস হিসেব করা যায় দেখা যাবে মাসে শ্রমিকরা আয় করছেন কমপক্ষে দুই থেকে তিন লাখ বাংলাদেশী টাকা। এমন বেতন তো আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও পান না (অবশ্য আমি যতটুক জানি)। এই হার পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চও হতে পারে। তবে তিন-চারটি দেশের নি¤œতম বেতন না জেনে তা জোর দিয়ে বলতে পারছিনা। যেমন ইংল্যান্ড, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া। তবে আমেরিকায় ন্যূনতম মজ্রুী মাত্র সাত ডলার বলে শুনেছি। অষ্ট্রেলিয়ার চাইতে সেটা কম নি:সন্দেহে।

তদুপরি, এদেশে বেকার নেই। যা সামান্য কিছূ আছেন তাঁরা রীতিমত বেকার ভাতা পান-যা সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট।
কথা হচ্ছিল মে দিবস নিয়ে।

এতৎসত্বেও এদেশে মে দিবস পালন না করার কারণ জানা যায় নি। তবে প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি দিনকে Labour Day বা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সেদিন এদেশের শ্রমিকেরা নিজ নিজ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের পতাকা (দলীয় পতাকা নয়) হাতে সমাবেশ প্রভৃতি করে থাকেন। এরকম পদ্ধতি হয়তো বা নিউজিল্যান্ডেও প্রচলিত আছে-আর কোথাও আছে কি-না জানা নেই। তবে ঐ লেবার ডে’তেও বাংলাদেশের মত হৈ হুল্লোড় বা বাস-ট্রেন কয়েক ঘন্টা বন্ধ – এসব নেই এখানে।

কিন্তু মে দিবস যথার্থভাবে আমাদের দেশে পালিত হলেও শ্রমিকদের অর্জন বিশ্বের নিম্নতম পর্য্যায়ে আজও। নিম্নতম মজুরী, বাসস্থান, সন্তানদের শিক্ষা, পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য, মাসিক বা বাৎসরিক ছুটি এগুলির সব কিছুতেই আমাদের দেশের শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের অবস্থান সর্বনিম্নে যদিও আমরা মাথাপিছু আয়ের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং জাতীয় আয়ের বিপুল প্রবৃদ্ধির কথা হর হামেশাই শুনছি।

বস্তুত: এছাড়াও যেটি মারাত্মক ভাবে হলো বাংলাদেশের শ্রমিক বা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের উপর অলিখিত বাধ্যতামূলক সরকারী দলের সংশ্লিষ্টতা। ফলে একই শিল্পে একাধিক ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে শ্রমিকদের মধ্যে অনৈক্য বেড়েছে এবং শ্রমিক নেতাদের একটি বড় অংশ শ্রেফ দালালীতে নিয়োজিত রয়েছেন। পরিণতিতে শ্রমিক আন্দোলন নেই এবং দেশের সাধারণ শ্রমিকদের অন্তহীন দুর্দশা।

বাংলাদেশের শিল্প মালিকেরাও শুধুই শোষণ চিনেছেন। তাঁরাও মূলত: যখন যে দলের সরকার ক্ষমতাসীন হয় সেই দলের সাথে দিব্যি সম্পৃক্ত হন শ্রেফ শ্রমিক শোষণ অব্যাহত রাখতে এবং নিজেদের শোষক চরিত্র চাপা দিয়ে রেখে সরকারের কাছ থেকে অঢেল বৈধ-অবৈধ সুযোগ আদায় করে নেওয়ার লক্ষ্যে। বাংলাদেশের ব্যাপক বেকারত্ব ও মালিকদের পক্ষে শ্রমিক-শোষণ ও নির্য্যাতনের পক্ষে এক বিরাট সুযোগের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই মালিকেরা যদি বুঝতেন, অন্য কেউ না শ্রমিকরাই তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খেটে যা আয় করছেন তারই বিপুল অংশ মুনাফা হিসেবে নিয়ে তাঁরা ক্রমান্বয়ে আরও বড় ধনিকে পরিণত হচ্ছেন। কিন্তু শ্রমিকদের বেতন যথেষ্ট পরিমানে বৃদ্ধি করলে পৃথিবীর অপরাপর দেশের মত নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি না করলে, তাদের স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান এবং সন্তানদের সুশিক্ষা ও সবার চিকিৎসা সুযোগ বাড়লে যে ঐ শ্রমিকেরা আরও বেশী আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করে তাদের উপার্জনও অনেক বাড়াতে পারতো এবং ফলে তাঁরাও আরও বড় ধনীতে পরিণত হতে পারতেন। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার প্রবণতা আমাদের দেশে যত বেশী এতটা অন্যত্র খুব কমই চোখে পড়ে। আর সে কারণেই শ্রমিক নির্য্যাতন, শ্রমিক শোষনের মাত্রা, চোরাকারবারী, বিদেশে টাকা পাচার এগুলিও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সমাজতন্ত্র আজ বিশ্বব্যাপী বিপর্যস্ত। এর মধ্যেও কিউবা, ভিযেতনামের মত সমাজতান্ত্রিক দেশ যে কিভাবে টিকে আছে সা¤্রাজ্যবাদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে আজও তা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাইনি। তবে নিশ্চিত বলতে পারি ঐ দেশগুলিতে শ্রমিক শ্রেণীর সার্বিক অবস্থা সর্বশ্রেষ্ঠ আজকের পৃথিবীতে ।

আমাদেরও অঙ্গীকার ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। দীর্ঘকাল ধরে সে আন্দোলনকে আমরা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেটা পাকিস্তান আমলের কথা। তারাই ফলশ্রুতিতে এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপুল অবদানের পরিণতিতে ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার ফলে বাহাত্তরের সংবিধানে তা রাষ্ট্রীয় মৌল লক্ষ্য হিসেবে স্থানও পেয়েছিল কিন্তু পনেরই আগষ্টের নির্মম হত্যালীলার প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সমাজতন্ত্রকে পর্দার আড়ালে ঠেলে দিয়ে বস্তুতঃ পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশ ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির দাপটে আজ দেশটা ভিন্নমুখী অবস্থানে স্থান করে নিয়েছে।

অপরদিকে দেশের বামপন্থী দলগুলিতে বারংবার ভাঙ্গন ও যৌক্তিক/অযৌক্তিক ইস্যুতে তীব্র মতানৈক্যের ফলে প্রগতিশীল আন্দোলন তীব্র হোঁচট খেয়ে আজ ঘরে বসে পড়ার উপক্রম। জনগণের হৃদয়-ছোঁয়া কর্মসূচী, তা নিয়ে ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামার ব্যাপারে বাস্তব আগ্রহ ও উদ্যোগের তীব্র অভাব এক মারাত্মক রাজনৈতিক শূণ্যতারও সৃষ্টি করেছে। সুযোগ নিয়েছে উগ্রবাদী ও দক্ষিণপন্থী দল ও শক্তিগুলির প্রভাব বৃদ্ধির।

এই সার্বিক পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িকতার প্রসার, গণতন্ত্রের সংকোচন সবকিছু মিলিয়েই দেশের শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলন আজ নিম্নতম পর্যায়ে। সাধারণ শ্রমিকদেরকে এবারের মে দিবসে তাই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে এবং তা পারলেই মে দিবস পালন সার্থক হবে। নতুবা তা পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

আমার জীবনে পহেলা মে ভিন্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য্যও বহন করে। এবং সেটি বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা পর্য্যায়ের সাংবাদিকতার বিকাশে এবং সীমাহীন অবদান রাখতে সমর্থ হয়।

১৯৬১ সালের এই দিনে পাবনাতে প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলাম মাত্র আর দু’জন সাংবাদিক প্রয়াত আজিজুল হক ও বন্ধুবর আনোয়ারুল হক সহ। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পাবনার তৎকালীন সুধীসমাজ।

সহকর্মী এ.কে.এম আজিজুল হকের বাসগৃহের বৈঠক খানায় পাবনা শহরের প্রধান সড়ক এ. হামিদ রোডের পশ্চিম পার্শ্বে। এ.কে.এম আজিজুল হক হলেন প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ও আমাকে করা হলো সম্পাদক।

সাংবাদিকতা শুরু করি ১৯৫১ সাল থেকে। তার ১০ বছরে প্রতিষ্ঠিত এই প্রেসক্লাব জেলা শহরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম (জানা মতে)। এখন দিনে দিনে ক্লাবটির জৌলুষ বেড়েছে, কর্মকান্ডের পরিসরও বেড়েছে যদিও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রায় ৫০ বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন এবং আমি দীর্ঘকাল কারাগারে ও বেশ কিছুকাল বিদেশে অবস্থান করছি। ভিন্ন একটি ভবনের দোতলা অর্পিত সম্পত্তি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিজ নিয়ে স্থানাস্তরিত হয়েছে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই । এখন একটি আকর্ষনীয় অডিটোরিয়াম, সদস্যদের বসার ঘর, এ.সি. কয়েকটি, দুটি টেলিভিশন সেট সহ অন্ত:কক্ষ খেলাধুলা প্রভৃতির ব্যবস্থাদি সংযোজিত হয়েছে। সদস্যদের বিপদ-আপদের মুহুর্তে সামান্য হলেও সহায়তা করার লক্ষ্যে একটি তহবিলও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সদস্য সংখ্যা প্রথমে তিনজনের স্থলে এখন প্রায় ৬০ জন।

তারপরেও সমস্যা রয়েছে অনেক।
এক. ক্লাবরুম এবং সংশ্লিষ্ট গোটা দালানটির মালিকানা প্রেসক্লাবের নামে আজও হয়নি। বিষয়টি দ্রুততার সাথে সরকার দেখলে খুব ভালো একটি কাজ হতো।
দুই. পাবনার সাংবাদিকদের অপর সমস্যা হলো ক্লাবের নিজস্ব আয়ের পথ না থাকায় এবং তা দূর করতে হলে কাঠা দশেক জমির প্রয়োজন। সেখানে দালানকোঠা তুলে বিপনী বিতান, হল ঘর, সেমিনার রুম, ব্যাংক স্থাপন সহ একটি বা দুটি ফ্লোর একান্ত নিজেদের জন্য রেখে প্রত্যেকের জন্য ড্রয়ার, বিফ্রেল মোট, কম্পিউটার ছাড়াও কিছু বিনোদন জাতীয় ব্যবস্থা রাখা যায়। এতে বিস্তর আয় এবং পেশাগত সকল সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা সম্ভব। এই কাজটি উদ্যোগ নিলে পাবনার জেলা প্রশাসকের সহযোগিতাতেই এবং ব্যবসায়ী সমাজের সক্রিয় সাহায্যে করা সম্ভব এবেং তার পূর্ব শর্ত হচ্ছে সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য পুনরুদ্ধার।

এবারের পহেলা মে পাবনা প্রেসক্লাবের ৫৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। দিনটি উদযাপিত হোক,“আমরা ঐক্যবদ্ধ হবো-হবোই” এই শ্লোগান কণ্ঠে নিয়ে। মে দিবস অমর হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!