স্বাভাবিক গাছ বাদ দিয়ে অস্বাভাবিক গাছ নিয়ে মাতামাতি শুরু। আমরা বিউটিফিকেশনের নামে বিলাসিতা করে ঢাকা শহরে ‘বনসাই’ আমদানি করেছি। বনসাই হলো মূলত  প্রকৃতির নিয়মে বেড়ে ওঠা বৃক্ষেকে কেটে-ছেঁটে-বেঁধে ছোট্ট একটি টবে জোর করে সংকুচিত আকারে বাঁচিয়ে রাখাই হচ্ছে বনসাই।অভিধানে বনসাই মানে হচ্ছে, ঘর সাজানোর জন্য পূর্ণবয়স্ক গাছের আকারকে কৃত্রিম উপায়ে ছোটো করার জাপানি পদ্ধতিবিশেষ। প্রথমে চীনে এবং পরে জাপানে পাত্রে জন্মানো বামন আকৃতির গাছ জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেকের মতে, বনসাই শব্দটি চৈনিক ‘পেনজাই’ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়। জাপানিরা শব্দের উচ্চারণ পরিবর্তন করে ফেলে। তারা নাম দেয় বনসাই (Bonsai)। বন (bon) মানে পাত্র এবং সাই (sai) মানে গাছ বা গাছ রোপণ। বিশেষ কৌশল ও পদ্ধতিতে একটি পাত্রে পরিকল্পিতভাবে ডালপালা ও শিকড় ছেঁটে, তার পেঁচিয়ে গাছটিকে একটি ক্ষুদ্র রূপ দেওয়া হয়।

সম্প্রতি আমাদের এয়ারপোর্ট রোড থেকে বনানীর পথের দুপাশের বনসাই স্থাপন করা হয়েছে। রাজধানীর বনানী ওভারপাস থেকে এয়ারপোর্ট বিউটিফিকেশন প্রকল্পের আওতায় ফুটপাতের সৌন্দর্যবর্ধন কাজের অংশ হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভিনাইল ওয়ার্ল্ডের তত্ত্বাবধানে আধুনিক যাত্রী ছাউনি নির্মাণ, ফুটপাতে আলোক সজ্জা এবং গাছ লাগানো হয়েছে। ফুটপাতকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে চীন থেকে আনা হয়েছে ১২০টি ফাইকাস বনসাই। এই বনসাই গাছগুলোর একেকটির দাম প্রায় দেড় থেকে ২ লাখ টাকা। এই গাছগুলো আনতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা।  চীন থেকে ফ্রিজার কনটেইনারে এগুলো নিয়ে আসা হয়।

অথচ আমাদের দেশীয় কৃষ্ণচুড়া, রাধাচুড়া, ঝাউ, তমাল, দেবদারু, বট, পাকড় সহ বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ যেমন-নারকেল, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা লাগানো যেত। এয়ারপোর্ট রোডের এই তথাকথিত সৌন্দর্যবর্ধনের নামে যা হলো তা পরিবেশের সঙ্গে এক নির্মমতা এবং নগরবাসীর প্রতি এক বিশালাকার প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

সৌন্দর্যবর্ধন করার আগে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, মানসম্মত পানি সরবরাহ, রাস্তাঘাট চলাচলের উপযোগী করা, অলি গলিসহ সকল স্হানে আলোর ব্যবস্হা, বস্তি এলাকায় পানি-গ্যাস-স্যানিটেশন সমস্যার সমাধান, জনপরিবহন সমস্যা সমাধান, ময়লা-আবর্জনা দ্রুত অপসারন, মশা নিধন, বিদুৎ বিপর্যয় রোধ সহ হাজারো সমস্যা সমাধানে আন্তরিক না হয়ে, বিদেশি বনসাই দিয়ে নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগটা অনেকের কাছেই খুব একটা ‘সৌন্দর্যমণ্ডিত’ মনে হচ্ছে না!

রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনায় আমরা সাধারন জনগন যেন বনসাই হয়েছি। বনসাইর মতো নিরবে সব সহ্য করছি। তাই মাঝে মাঝেই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে: আমরা নিরাপদ জীবন চাই, বনসাই হতে চাই না। আমরা শুধু বিমানবন্দর সড়ক নয়, পুরো দেশকে, জাতিকে ‘বনসাইকরণ’ প্রক্রিয়া থেকে রেহাই চাই!