খান আতা বিতর্ক আরও কিছু কথা

 

 

বাংলাদেশের একজন তারকা মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু। প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীনের কঠিন কঠিন সব নাটক সহজবোধ্য করে মঞ্চে এনেছেন নাসিরউদ্দিন ইউসূফ, এ যে কত বড় যোগ্যতা এবং মেধার ব্যাপার তা অনুধাবন করাও সহজ নয়। তাঁর সাংগঠনিক সক্ষমতা কিংবদন্তীতুল্য। হুমায়ূন ফরিদী, আফজাল হোসেন, পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবর্ণা মুস্তাফা… বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা তারকা অভিনয় শিল্পীদের একত্রিত করেছিলেন ঢাকা থিয়েটারের মাধ্যমে। এখন অনেকেই ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে নেই। কিন্তু তাদের প্রায় সবার গুরু এবং শ্রদ্ধার মানুষ নাসিরউদ্দিন ইউসূফ। নাসিরউদ্দিন ইউসূফ কাজ করেন, নানা রকমের কাজ। নিজের ব্যবসা থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গন পরিচালনা, কী করেন না তিনি!

সাধারণত তিনি যা করেন না তা হলো, বেফাঁস কথা বলেন না। সেই নাসিরউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু নিউইয়র্কের বাঙালিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন খান আতাকে নিয়ে। খান আতা বাংলাদেশের অত্যন্ত পরিচিত নাম। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমার পরিচালক। আরও অনেক সফল, দর্শক নন্দিত সিনেমার পরিচালক। নিজে অভিনয় করেছেন, গান লিখেছেন। জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন খান আতাউর রহমান।
নাসিরউদ্দিন ইউসূফ ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমাকে নেগেটিভ সিনেমা, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সিনেমা বলেছেন। বলেছেন, ‘খান আতা অনেক বড় শিল্পী সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খান আতা কিন্তু রাজাকার। আমি না হলে খান আতা বাঁচত না, আমি না হলে ১৯৭১ সালে খান আতা মারা যায়, ১৬ ডিসেম্বরের পরে। ‘আবার তো মানুষ হ’ নেগেটিভ ছবি। মুক্তিযোদ্ধাদের বলছে ‘আবার তোরা মানুষ হ’। আরে তুই মানুষ হ, তাই না?’
নিউইয়র্কের প্রখ্যাত ফটো সাংবাদিক নিহার সিদ্দিকীর করা এই ভিডিও চিত্র ভাইরাল হয়ে গেছে। রুনা লায়লার অন্য ভাষা-সাংস্কৃতির গান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে খান আতা সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন নাসিরউদ্দিন ইউসূফ। নিশ্চয়ই আগে-পরে আরও অনেক কথা বলেছেন। তবে আলোচনায় এসেছে এই অংশটুকুই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার মনে করছি, নাসিরউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চুর সঙ্গে শ্রদ্ধা-স্নেহের সম্পর্ক অনেক বছর ধরে। সূত্র বিচিত্রা, মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী। এ রকমের কথা তাঁকে কোনও দিন কারও সম্পর্কে বলতে শুনিনি। খান আতাকে তিনি বাঁচানোর কথা প্রসঙ্গে আরও একটি কথা মনে পড়ল। সরাসরি নাসিরউদ্দিন ইউসূফের মুখ থেকে শুনেছি আরেকজনকে বাঁচানোর গল্প। পরবর্তীতে তিনি পুলিশের আইজি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে যিনি একটি জেলার ডিসি ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসূফ। ঘরোয়া আলোচনায় বলা কথা এবং তা প্রকাশ করার অনুমতি না নেয়ায় নাম বলছি না। নাসিরউদ্দিন ইউসূফের খান আতা বিষয়ক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলছি।
১. মুক্তিযুদ্ধের আগের বহু বছরের প্রেক্ষাপট-ইতিহাসের দিকে যাব না। সরাসরি যুদ্ধের সময়কালের মধ্যে থেকে কথা বলছি। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ, ২ লাখ মা-বোনের উপর নিপীড়ন, একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম। সরাসরি যুদ্ধ করা অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন দেশ দেখার সুযোগ পেলেন। সব কিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে, অনেকেই অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। কী করবেন, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। খান আতা ১৯৭১ সালে পরিচিত মুখ। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। ঢাকাতেই থেকেছেন। অভিযোগ আছে, তিনি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন। অভিযোগ যে মিথ্যে নয়, তা খান আতার বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়। বলে গেছেন, ‘আমি পরিস্থিতির শিকার’। খান আতা সম্পর্কে যতটা জেনেছি, তাঁর একাত্তরের ভূমিকায় সন্দেহ মুক্ত হতে পারিনি। যেমন সন্দেহ মুক্ত হতে পারি না আরও অনেকের ভূমিকা নিয়ে। তাদের অনেককেই আমরা শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছি।
বুঝে অথবা ‘পরিস্থিতির শিকার’ যাই হোক না কেন, খান আতা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন আসবে, বয়স-সুযোগ দুটোই থাকা সত্ত্বেও যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি, তারা সবাই কী রাজাকার? যেসব শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন, তারা সবাই ঢাকা শহরে, দেশের ভেতরে ছিলেন। চাকরি করেছেন, পাকিস্তান সরকারের থেকে বেতন নিয়েছেন। ইচ্ছে করলে যারা ভারতে চলে যেতে পারতেন, যাননি। অনেকে দেশে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন নানাভাবে। কবি শামসুর রাহমান দৈনিক পাকিস্তানে চাকরি করেছেন, ছন্দনামে কবিতা লিখেছেন। মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী, হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক তাঁর কাছ থেকে কবিতা নিয়ে কলকাতায় পাঠিয়েছেন। একজনকে জানি, যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাননি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং পরবর্তীতে অধ্যাপক, মুক্তিযোদ্ধা-গবেষক হয়েছেন। তাঁর পরিচিতি কী হবে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজাকার?
বলা হয় বা হবে, যারা পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা রাজাকার, তারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। কিন্তু কে পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছেন, কে করেননি? এই প্রশ্নের তথ্যভিত্তিক উত্তর কী দেওয়া সম্ভব? খুব কঠিন। যে উত্তরই দেওয়া হবে, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হবে। বিতর্কের অবসান ঘটানোর জন্যে প্রয়োজন ছিল এ বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ গবেষণা। কিছু কাজ হলেও পূর্ণাঙ্গ গবেষণা বলতে যা বোঝায় তা হয়নি। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে একজনের নাম সামনে আনলে বা বললে, আরও অনেকের প্রসঙ্গ চলে আসে। খান আতা পাকিস্তানের পক্ষে যে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই বিবৃতিতে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বও স্বাক্ষর করেছিলেন। কোনও গবেষণা হয়নি, কেন তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন। আরও স্বাক্ষর করেছিলেন, তার মধ্যে আবদুল আলীমের নাম বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়েছে। স্বাক্ষরকারী এই নামগুলোর মধ্যে প্রখ্যাত শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদ, সৈয়দ আবদুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমিন, ফেরদৌসী রহমানের নাম থাকলেও তা তেমন একটা আলোচনায় আসেনি।
স্বাক্ষরকারীদের তালিকায় নাম ছিল সর্বজন শ্রদ্ধেয় মনীষী সরদার ফজলুল করিমেরও।
‘গণহত্যা হয়নি’ পাকিস্তানের পক্ষে এমন বিবৃতিতে কেন এসব শিল্পী-শিক্ষকেরা স্বাক্ষর করেছিলেন, এ প্রশ্নের উত্তর নেই।
এদের সবাইকে যদি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বা রাজাকার বলে দেওয়া হয়, কেমন হবে অবস্থাটা?
খান আতা যদি ১৯৭১ সালে নিহত হতেন, যেমন হয়েছেন মুনীর চৌধুরী কে বলা হতো? রাজাকার না শহীদ?
২. ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না’ খান আতার ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমার শিহরণ জাগানো গানটি গেয়েছেন শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধেও। ‘তবু বিজয়ের বীর এই মুক্তিসেনা, তোমাদের এই ঋণ কোনও দিন শোধ হবে না’ অবিস্মরণীয় এই কথাগুলোর লেখক খান আতা, সুরকারও খান আতা।
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হিসেবেই ‘আবার তোরা মানুষ হ’ দেখেছি। বিটিভিতে সিনেমাটি অসংখ্যবার দেখানো হয়েছে। মাঝে একটা সময়ে আলোচনা শুনেছি, মুক্তিযোদ্ধারা কি ‘অমানুষ’ যে মানুষ হবে? যে প্রসঙ্গটি এখন নাসিরউদ্দিন ইউসূফ তুলেছেন। অনেকেই বলেছেন, ‘মানুষ’ হতে বলে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হয়েছে। ‘অসম্মান’ করা হয়েছে, এই ব্যাখ্যায় আমিও অনেকটা প্রভাবিত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে সিনেমাটি আবার দেখেছি, ভেবেছি। ‘অসম্মান’ ভাবনার পাশাপাশি এমন একটা ব্যাখ্যাও মাথায় এসেছে। নিজে ব্যাখ্যা তৈরি করেছি, নিজের ব্যাখ্যায় নিজে অনেকটা সন্তুষ্টও।
‘আবার তোরা মানুষ হ’ বলতে মুক্তিযোদ্ধারা ‘অমানুষ’ তাদের মানুষ হতে বলা হয়েছে, বিষয়টি তেমন নয়। সশস্ত্র সংগ্রামের পরে একটি স্বাধীন দেশ-সমাজে নানা রকমের অরাজকতা-সংকট তৈরি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও তেমন হয়েছিল। এটা ইতিহাসের অনিবার্য সত্য। ‘মানুষ হ’ বলতে লক্ষ্যচ্যুত অংশটিকে ‘অমানুষ’ বলা হয়নি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিল। এছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, একটি দেশের সশস্ত্র যুদ্ধ করা প্রজন্ম নানা রকম ট্রমায় আক্রান্ত থাকে। তাদের বড় একটা অংশ স্বাভাবিক জীবনযাপনের বাইরে চলে যায়। যুদ্ধ শেষ হলেও তাদের জীবনের যুদ্ধ শেষ হয় না। জমা দেয়ার পরেও তাদের অনেকের হাতে অস্ত্র থেকে যায়। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে না পারলে, নানা জটিলতা দেখা দেয়। সামাজিক অনাচার তাদের আবার বিদ্রোহী করে তোলে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এর বাইরে ছিল না। অর্থাৎ যুদ্ধ প্রজন্মকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনারই আহ্বান ‘আবার তোরা মানুষ হ’, মুক্তিযোদ্ধারা ‘অমানুষ’ এবং তাদের মানুষ হওয়ার আহ্বান নয়। তা যদি হতো তবে ‘বিজয়ের বীর এই মুক্তিসেনা’ এই কথা লেখা সম্ভব হতো না।
৪. ‘আবার তোরা মানুষ হ’ মুক্তি পেয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ে। নায়ক ফারুক একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্রলীগের রাজনীতি করা মানুষ। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমা মুক্তির সময়েই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হিসেবে আলোচনা হয়েছিল, এমন কথা কেউ কেউ বলছেন। মুক্তিযোদ্ধা নায়ক ফারুক বলছেন, ‘…আবার তোরা মানুষ হ’ এটি নিছক কোনও ছবি ছিল না। যুদ্ধপরবর্তী বিশৃঙ্খলা নিয়েই ‘আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্র। …সময়টা বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল। তাঁর সময় মুক্তি পেয়েছে। স্বভাবতই তাঁর সায় ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, মুক্তিযোদ্ধা-নায়ক সোহেল রানাও প্রায় একই রকমের কথা বলেছেন। খান আতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখার অভিযোগ যেমন আছে। তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে সেই অভিযোগ খন্ডনও করছেন। স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে যে গবেষণা প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তিনি স্বাগত জানিয়ে গান লিখেছেন, রেডিও স্টেশনে ছুটে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হয়তো এই অভিযোগ সত্যি। আরও অনেকের বিরুদ্ধে, অনেক অভিযোগ সত্যি। ‘খুনি মুজিব খুন হয়েছে’ লিফলেট প্রকাশ করেছিল জাসদ, সে জাসদের একজন নেতা বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ‘বঙ্গবন্ধুর লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেয়া’র বুদ্ধি দিয়েছিলেন কর্নেল তাহের। খুনিদের সঙ্গে দেখা করতে তিনি রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। সুনির্দিষ্ট করে আমলা-রাজনীতিবিদ আরও অনেকের ভূমিকা তুলে ধরা যায়। তাতে বিতর্ক শুধু বাড়বেই। এর মধ্যে থেকে কোনও একজনকে যখন টার্গেট করা হয়, সমস্যা তৈরি হয় তখন। এক্ষেত্রে খান আতার প্রসঙ্গে তাই হয়েছে।
৫. একটি ঘটনা বলি। ঘটনার চরিত্ররা সবাই নাসিরউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চুর ঘনিষ্ঠজন। ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের ভাষায় লিখছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে আলোচিত ২ নম্বর সেক্টরের ক্রাক প্লাটুন’র গেরিলারা। ঢাকা শহরে যারা সাড়া জাগানো অপারেশন করেছিল। ১৯৭১ সালে গেরিলা বদিউল আলম বদি আশ্রয় নিয়েছিল ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিনের বাড়িতে। জালাল উদ্দিনের ছেলে ফরিদ। ফরিদ প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমানের ভাই, জিল্লুর রহমানের শ্যালক। ফরিদ পাকিস্তানি আর্মিকে দিয়ে ধরিয়ে দেয় বদিকে। নির্যাতনের মুখে বদি নাম বলে দেয় আরেক গেরিলা আবদুস সামাদের। সামাদ দুর্ধর্ষ ফার্মগেট অপারেশনে অসীম সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে গাড়ি চালিয়েছিলেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশনেও অংশ নিয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়ে আবদুস সামাদ ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের নাম ঠিকানা বলে দেন। পাকিস্তানি আর্মি যখন আলতাফ মাহমুদকে ধরে, সামাদই দেখিয়ে দেন। রুমিসহ ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলাদের অনেকে ধরা পড়ে যান। আস্তানা-অস্ত্র সনাক্ত করে ফেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পুরো তছনছ হয়ে যায় গেরিলারা। ধরা পড়েছিলেন আবুল বারক আলভী, আবুল মাসুদ সাদেক  ছুল্লু ও । আবুল বারক আলভী ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, কোনো কিছু স্বীকার করেননি। সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ছুল্লু । তাঁর শরীরের এমন কোনো অংশ বাকি ছিল না, যেখানে সিগারেটের ছ্যাকা দেয়া হয়নি। তাঁর মুখ থেকে শুনেছি, শরীরের নানা স্পর্শকাতর অঙ্গেও অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এই বীর গেরিলা গত ১৬ অক্টোবর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। শত নির্যাতনের মুখে পাকবাহিনীর কাছে ছুল্লু সহযোদ্ধাদের সম্পর্কে একটি তথ্যও স্বীকার করেননি। অথচ তিনি সবকিছু জানতেন।
বদি দুর্ধষ গেরিলা, বদির স্বীকারোক্তিতে ধরা পড়লেন সামাদ। সামাদ ধরিয়ে দিলেন আলতাফ মাহমুদদের। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে বদি, সামাদ দুজনই বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। ঢাকা থেকে প্রথম যে চারজন ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়েছিলেন, বদি তাঁর একজন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে আবার বদি আইয়ুব খানের এনএসএফ করতেন। সামাদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি নির্যাতনের স্বীকার হয়েও ছুল্লু , আলভী কোনো কিছু স্বীকার করলেন না।
পুরো অঘটনের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফরিদ। ইতিহাসে তার মূল্যায়ন কী? বীর মুক্তিযাদ্ধা বদি, সামাদকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? ছুল্লু , আবুল বারক আলভী?
মহা ক্যানভাসের মুক্তিযুদ্ধ। যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-ইতিহাস, এত সহজ তো নয়ই, সরলও নয়। প্রকৃত নির্মোহ গবেষণা ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে হঠাৎ হঠাৎ কাউকে টার্গেট করলে, কিছু অর্জন হয় না। বিভ্রান্তি দূর করে না, আরও বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।

লেখক- গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail.com

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!