পাবনার ঐতিহ্যবাহী টাউন হলটি আজ নিশ্চিহ্ন

পাবনার ঐতিহ্যবাহী টাউন হলটি আজ নিশ্চিহ্ন
রণেশ মৈত্র
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি পাবনা টাউন হল। বাবার মুখে শুনেছি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাবনা টাউন হলে আয়োজিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পাবনা জেলা সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। পরে ইতিহাসেও তার সত্যতার স্বাক্ষর মিলেছে। তবে সালটা আমার মনে নেই।

ইংওরেজ আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাবনা টাউন হল-সালটা কোথাও খুঁজে পেলাম না-পেলাম না প্রতিষ্ঠাতার নামও। তবে জেনেছি, ঐ টাউন হল ময়দানেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের, ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির ও তৎকালীন অপরাপর রাজনৈতিক দল অসংখ্য জনসভা করেছেন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। ওখানে অজস্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, ঐ টাউন হলের মাঠ থেকেই অসংখ্য মিছিল শোভাযাত্রা বেড়িয়েছে “ভারত ছাড়ও” আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। ঐ সব জনসভা-মিছিল করার কারণে কত শত পাবনাবাসীকে ইংরেজ সরকার কারাগারে নিক্ষেপ করেছে, অন্যান্যভাবে নির্য্যাতন করেছে, লাঠি-টিয়ার গ্যাসে আহত করেছে-তার ইয়ত্তা নেই।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়ই একটি করে টাউন হলের অস্তিত্ব রয়েছে দীর্ঘকাল যাবত। সেগুলিও ঐতিহাসিক বহু ঘটনার সাক্ষী হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কখনো ঐ ইতিহাস খন্ডিত করা বা টাউন হল ও সংলগ্ন ময়দানকে ভেঙ্গে ফেলার কথা ভাবতেই পারেন না-বরং তাকে সযতনে রক্ষা করে চলেছেন দেশের সর্বত্র।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে অবশেষে ভারত ছাড়তেই হলো। সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী দীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিকতার সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ও সমগ্র জনগণের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ইংরেজ বিতাড়নের সাথে সাথে উদ্ভব হলো ভারতবর্ষ ভেঙ্গে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে।

দেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় মুসলিম লীগের সম্মেলনে জোরে সোরে পাকিস্তানের দাবী উত্থপন করেন। ঐ দাবী সম্বলিত প্রস্তাবটি “লাহোর প্রস্তাব” নামে খ্যাত।

সে আন্দোলন ও ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটের পরিণতিতে আজকের বাংলাদেশ “পূর্ব পাকিস্তান” নামে অভিহিত হলো। পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত হলো “পশ্চিম পাকিস্তান” আর দুই পাকিস্তানের মিলিত নাম হলো পাকিস্তান। বাঙালি মুসলিম সমাজ ১৯৪৬ এর গণভোটে পাকিস্তানের পক্ষে একযোগে ভোট দিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে সম্ভব করে তুলেছিলেন এই আশায় যে পাকিস্তান শুধু মুলমানদের দেশ হবে তাই না-দেশটি হবে সকল অত্যাচার নির্য্যাতন এবং শোষণ মুক্তও।

কিন্তু সহসাই তাঁদের ঘুম ভাঙলো। ১৯৪৮ এ এসে যখন দেখলেন, পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে একমাত্র ঊর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করার পক্ষে সাক্ষাই গাইলেন। সাংসদ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্য) ধীরেন দত্ত জাতীয় পরিষদের করাচী অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবী জানালে তাঁকে “ভারতের দালাল” “পাকিস্তানের দুশমন”, “ইসলামের শত্রু”, “বাংলা হিন্দুর ভাষা”, “বাংলা ভারতের ভাষা”, “বাংলা মুসলমানের ভাষা নয়” প্রভৃতি বলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান স্বয়ং ধীরেন দত্ত ও বাংলা ভাষাকে অপমানিত করার পর পাকিস্তানের প্রতি বাঙালির মোহভঙ্গ হতে শুরু করে।

এবারে এ যুগের আন্দোলন সংগ্রাম। আজ থেকে ৭৩ বছর আগে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবীতে দেশব্যাপী যে হরতাল-মিছিল সংঘটিত হয়-পাবনা টাউন হল সে গৌরবও ধারণ করে যেমন করেন পাবনাবাসী দলমত নির্বিশেষে আজও। আবার ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গুলিবর্ষণ করে কয়েকটি তরতাজা প্রাণ যখন কেড়ে নেওয়া হয় তার প্রতিবাদে ২২ শে ফেব্রুযারি পাবনাতেও আমরা হরতাল-মিছিলের আয়োজন করি ব্যাপক জনগণের অংশ গ্রহণে। টাউন হলও সে গৌরবেও পাবনাবাসীর সাথে গৌরবান্বিত। একটি প্রাণবন্তু ইতিহাসের স্মারক হয়ে উঠলো পাবনা টাউন হল সেদিন।

এর পর থেকে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব মুহুর্ত পর্য্যন্ত পাবনার সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলনের উৎস-ভূমিতে পরিণত হয় পাবনা টাউন হল। সেই আন্দোলনের তরঙ্গে তরঙ্গে ক্রমান্বয়েই উত্তাল হয়ে ওঠে পাবনা।

যেহেতু ছাত্র-আন্দোলনই পাকিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিল পাবনাতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের তৎকালীন পাবনা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকও পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মমিন তালুকদার, আজহার আলী, শামসুজ্জোহা, সৈয়দ রেজা কাদের প্রমুখ, বাহান্নোর শেষ দিকে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রণেশ মৈত্র, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন, কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আহমেদ, কামাল লোহানী, নিনু ও আরও বহুসংখ্যক ছাত্র নেতা অসংখ্য সভা সমিতি করেছেন পাবনা টাউন হল ময়দানে।

এলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বের যুগ। আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমজাদ হোসেন এম.এন.এ, আবদুর রব বগা মিয়া ও আরও অন্যান্যের বক্তব্যস্থলে পরিণত হলো টাউন হলটি।
আসতে থাকলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়াদী, শেখ মুজিবর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ জাতীয় নেতৃবৃন্দ। তাঁদের পদচারণায় মুখরিত হতে থাকে পাবনা টাউন হল ময়দান।

১৯৫৭ সালে গঠিত হলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ। পাবনায় আসতে শুরু করলেন ন্যাপ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, পীর হাবিবুর রহমান, বেগম সেলিনা বানু, ভাষা-সৈনিক আবদুল মতিন প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধের পরে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হলে ঐ দলের নেতৃবৃন্দ যথা আ.শ.ম. আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ তাঁদের আগুন ঝরা ভাষণে কাঁপাতেন পাবনা টাউন হল ময়দান। মুক্তিযুদ্ধের আগে দেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা, ছাত্র সমাজের ১১ দফা ও স্বাধীনতার দাবীতে উচ্চাকিত করে তুলছিলেন পাবনা টাউন হল ময়দান। ঐ ময়দান সংলগ্ন হল ঘরে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ কত যে কর্ম ীসভা করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এর সবই স্বাধীনতা ও প্রগতির দাবীতে আয়োজিত হতো।

স্থানীয় ছাত্র যুব রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পাবনা টাউন হল ময়দানে যাঁরা অজস্র ভাষণ দিয়েছেন, তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমজাদ হোসেন এম.এন.এ., আমজাদ হোসেন এডভোকেট, আবদুর রব বগা মিয়া, ওয়াজউদ্দিন খান, রফিকুল ইসলাম বকুল ন্যাপের মীর্জা আবদুল আউয়াল, আবদুল মতিন, সেলিনা বানু রণেশ মৈত্র প্রমুখ, তরুণ ছাত্র নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল, জাহিদ হোসেন জিন্দান, রবিউল ইসলাম রবি, শিরীণ বানু মিতিল প্রমুখ বিপুল অবদান রাখেন। গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের উদ্দীপনা সৃষ্টিতে সকলেরই মূল কেন্দ্র ভূমি ছিল পাবনা টাউন হল ময়দান।

এহেন গৌরবের, সুমহান ঐতিহ্যের, খ্যাতিমান ও অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টিকারী পাবনা টাউন হলের আজ কোন চিহ্ন নেই। সেই সুউচ্চ একতলা সাদা রঙের দালান ঘর, তার বারান্দা, তার সামনে সিমেন্টের ছোট একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে নেতারা মাইকে অনলবর্ষী বক্তৃতা ভাষণ দিয়ে দেশের ভাষা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা অর্জনে বিপুল ভূমিকা রেখেছিলেন, যে টাউন হলে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন আইনকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীন বাংলার পতাকা ২৩ মার্চ ১৯৭১ উত্তোলন করে পাবনা বাসীকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে উজ্জীবিত করা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে কি আওয়ামী লীগ, কি ন্যাপ, কি ছাত্র ইউনিয়ন, কি ছাত্রলীগ, কি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় ঐ টাউন হল ময়দানে জমায়েতে, অনুষ্ঠানে, মিছিলে মুখরিত করে তুলতো-পাবনার সেই ইতিহাস ম-িত টাউন হলটি আজ নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ ও অস্তিত্বহীন। বুলডোজার দিয়ে তাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ক্রেন দিয়ে তার মূল্যবান ইঁট, কাঠ, লোহা, ইস্পাত তুলে নিয়ে ট্রাকে করে সেগুলিকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলে ঐ বিশাল মাঠটিকে আজ বিরান করে ফেলা হয়েছে। একটি পিঁপড়াও সেখানে আজ আর ভেড়ে না। কবরস্থান বা শ্মশানের নিস্তব্ধতাই আজ টাউন হলের ভাষা।

পথচারীরা ঐ ময়দানের সামনে দিয়ে চলাফেরার সময় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিায়ে তাকিয়ে দেখেন আর ভাবেন আজ কোথায় হারিয়ে গেল পাবনার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টির কেন্দ্রস্থল পাবনা টাউন, তার বিশাল দালান, হল ঘর, বারান্দা, মাঠ ও মঞ্চ? সবই যেন নিষ্ঠুর হত্যালীলার শিকার।

পাবনা টাউন হলকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো কেন? কী তার অপরাধ পাবনাবাসী কেউ তা জানেন না। শুধুই দুঃখ প্রকাশ করেন, হা-পিত্যেস করেন-আর বলেন, ক্ষমা করো ঐতিহ্যবাহী পাবনা টাউন হল! ভাঙ্গা হলো চূরমার করে দেওয়া হলো আমাদের পাবনাবাসীর ইতিহাস ম-িত গৌরবের, আন্দোলনের, অহংকারের হৃৎপি- পাবনাবাসীর মতামতের তোয়াক্কা না করে।
পাবনা টাউন হল দেখাশুনার দায়িত্ব পাবনা গৌরবসভার। সেটাকে ভাঙ্গার অধিকার পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে বা অন্য কাউকে, তা তিনি যতবড় কেউ কেটাই হন না কেন, দেওয়া হয় নি। তবু জবাবদিহি পৌর কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে পাবনাবাসীর দাবী যেমন ছিল অবিকল তেমন সুউচ্চ সাদা রঙের টাউন হল দালান, ভেতরে বিশাল হল ঘর, সামনে বারান্দা ও ছোট্ট মঞ্চটি পুন:নির্মাণ করা হোক। এর কোন বিকল্প নেই।

মাঠের দক্ষিণ দিকে সদ্য নির্মিত নির্মিত মঞ্চ ও মাঠটি স্বাধীনতা চত্বর হিসেবে যথারীতি সংরক্ষিত হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!