মাছ মিলছে বুড়িগঙ্গায়

 

অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডি.কম

বুড়িগঙ্গার পানি বিষাক্ত, এই পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। এ সব তকমা লেগে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীতে ফের প্রাণ ফিরেছে। বুড়িগঙ্গায় পাওয়া যাচ্ছে মাছ! জেলেদের জালে ধরা পড়ছে কালি বাউস, টেংরা, চাপিলা, পুঁটি, নলা, রুই, কাতল, বোয়াল, শিং, মাগুর, কৈ, বাইমসহ নানা মাছ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষায় নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় দূষণের পরিমাণ কমেছে। সেই ছোঁয়া রয়ে গেছে শরতে এসেও। এই কারণেই এই মৌসুমে দেখা মিলছে মাছের। দেখা মিলছে ডলফিনেরও। সারা বছরই দূষণ মুক্ত করা গেলে নদীতে ফিরে আসবে জলজ প্রাণীসহ সব প্রজাতির মাছ। জেলেরা ফিরে পাবেন তাদের জীবিকা। এ জন্য দরকার একটি সম্মিলিত উদ্যোগ।
বুড়িগঙ্গা নদীর বছিলা এলাকায় মঙ্গলবার মাছ ধরছিলেন জেলে সোহেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘কচুরিপানার নিচেই বেশি মাছ পাই। ছোট-বড় মিলিয়ে ভালোই মাছ পেয়েছি। সারাদিনে চার থেকে পাঁচ কেজি মাছ পাই।’
সোহেল হোসেনের মতো আরো অনেকেই এখানে মাছ ধরায় ব্যস্ত। কেউ নৌকা নিয়ে মাঝখানে গিয়ে বড়মাছ ধরার জাল ফেলছেন। আবার কেউ ‘ঠেলা জাল’ দিয়ে নদীর নিচ থেকে তীরে টেনে এনে মাছ ধরছেন। অনেকে আবার ‘হাত জাল’ দিয়ে মাছ ধরছেন। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেনো মাছ ধরার এক উত্সব।
মশারির কাপড় নিয়ে দুই দিকে কয়েক জন ধরে নদীর তীর ধরে ভেসে যাওয়া কচুরিপানার নিচ দিয়ে টেনে আনছেন কেউ কেউ। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ছোট মাছ। এ ছাড়া বাঁশের মাচা তৈরি করে এতে ভেসাল জাল বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রেখে কিছুক্ষণ পর পর তুললেই পাওয়া যাচ্ছে ছোট ছোট মাছ।
বাঁশের মাচায় খালি গায়ে বসে থাকতে দেখা যায় মধ্যবয়সী একজনকে। নাম মনির মিয়া। কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা। নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, ‘জাল ফেলে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর পর তুলতে হয়। একবার তুললে পাঁচ-সাতটা মাছ পাওয়া যায়।’
কামরাঙ্গীরচর ও পোস্তাগোলায় মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই মেতেছেন মাছ ধরার উত্সবে। তাদের জালে ধরা পড়ছে দেশীয় অনেক প্রজাতির মাছ। জেলেরা বলেন, বুড়িগঙ্গায় মাছ পাওয়া তাদের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতোই।
বছিলা ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা যায় একদল জেলে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। জানতে চাইলাম, মাছ পাওয়া যায়? একজন জেলে বললেন, ‘পামু না ক্যান! পুঁটি, খইলশা, আর নলা; মইদ্যে মইদ্যে রুই মাছও পাইয়া যাই।’
সন্ধ্যায় নদীতে দেখা হয় সুবল রাজবংশীর সঙ্গে। তিনি প্রতিরাতে মাছ ধরতে যান নদীতে। তার মতো আরো সাতটি নৌকা টিকে আছে এই জেলে পাড়ায়। সন্ধ্যার পর আটজনের দল যায় নদীতে। সারা রাত মাছ ধরে সকালে রায়েরবাজারে বেপারীদের কাছে মাছ বিক্রি করেন তারা। মাছের পরিমাণ আগের চাইতে কম হলেও বাপ দাদার পেশাটা আকড়ে ধরে আছেন সুবল।
পরিবেশকর্মী সৈয়দ সাইফুল আলম বলেন, বুড়িগঙ্গায় অক্সিজেনের মাত্রা কত, বিষাক্ত নানা গ্যাসের পরিমাণ, কোথায় কি দূষণ হচ্ছে- এসব নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এর বাইরেও বুড়িগঙ্গার অনেক রূপ আছে। কাশফুল, বক, মাছরাঙ্গা, পাল তোলা নৌকা, জেলে আর মাঝি। এই নদীকে ঘিরে অনেক উত্সব এখনো টিকে আছে। এছাড়া গত কয়েক দিনে বুড়িগঙ্গায় ঝাঁকে ঝাঁকে কালা বাউস মাছ ধরা পড়ছে বলেও জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে হলে, মাছের আবাস ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
এছাড়া বুড়িগঙ্গা খনন করতে হবে। অন্য নদী দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পানি এনে প্রবাহ বাড়াতে হবে। জোয়ার-ভাটা ঠিক রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। গৃহস্থলী বর্জ্য পানি প্রবাহে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ট্যানারি জরুরি ভিত্তিতে স্থানান্তর করতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান জানান, গত মার্চ মাসে পবা থেকে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের নদীর পানি পরীক্ষা করা হয়। তখন দেখা যায়, ঢাকার চারপাশের নদীর প্রায় অধিকাংশ স্থানের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায়। সেখানে কোনো প্রাণ থাকতে পারে না। বর্ষায় নদীতে পানি বেড়েছে। তাই নদীতে প্রাণও ফিরেছে। সারা বছরই আমরা নদীর এ অবস্থা দেখতে চাই।
নদীতে মাছ পেতে হলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে অবশ্যই ৫ মিলিগ্রামের বেশি থাকতে হয়। সেই হিসেবে ধারণা করা যায়, বুড়িগঙ্গায় দূষণের পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে।
বিশ্বে নদী দূষণের হাত থেকে রক্ষার অনেক উদাহরণ রয়েছে। লন্ডনের টেমস নদীর ভয়াবহ দূষণে চারবার মহামারি আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। তবুও টেমস নদী দূষণমুক্ত হয়েছে। ফিরে এসেছে প্রাণ। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে বুড়িগঙ্গাকেও বাঁচাতে পারলে বদলে যাবে রাজধানীর চিত্র।
বুড়িগঙ্গা ছাড়াও গত কয়েক দিন রাজধানীর চারপাশের তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার পাড় ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি নদীতেই মাছ ধরছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ঢাকার উত্তরা ও টঙ্গীর মাঝে তুরাগে দেখা মেলে পেশাদার জেলে। এসব নদীতেও ধরা পড়েছে প্রচুর মাছ।
এদিকে নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে সরকার নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে গত জুন মাসে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের’ অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশী-তুরাগ নদী পুনঃখনন করা হবে যাতে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা মহানগরীর চারপাশে বহমান নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ বজায় থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!