মুজিব শতবর্ষঃ যতার্থভাবে পালন-প্রত্যাশায়

মুজিব শতবর্ষঃ যতার্থভাবে পালন-প্রত্যাশায়
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ,

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী চলছে। ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে তাঁর জন্মের ক্ষণগননা। ১৭ মার্চে তাঁর জন্মদিন এবং শততম জন্মদিন। দিনটি পরম আনন্দের এবং বাঙালি জাতির জীবনেও অজশ্র ঐতিহাসিক স্মৃতিবহ।
১৯২০ সালের ১৭ জানুয়ারি সাবেক ফরিদপুর বর্তমানের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এই মহামানব জন্মগ্রহণ করেন। কে জানতো সেদিনের ঐ শিশুটি একদিন মহীরুহে পরিণত হবে এবং ইতিহাসে মহানায়ক হিসেবে অবিহিত হবে।
আমরা যারা তাঁকে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছি বা নানাভাবে তাঁর সাহচর্য্য পেয়েছি আজকের প্রজন্মের জীবনে সে সুযোগ ঘটে নি। বঙ্গবন্ধুর দৈহিক বিদায় ঘটে মর্মান্তিক এক হত্যালীলার শিকার হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের ভোর রাতে। তার পর আজ ৪৫ বছর অতিক্রান্ত। সুতরাং যে কোন হিসেবেই বলা যায়, যাঁদের বয়স আজ ৬০ বছর তাঁরাও হয়ত তাঁকে দেখেন নি-তাঁর কার্য্যকলাপ যে প্রত্যক্ষ করেন নি-তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে যে গ্যাপের বা শূন্যতার বা ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে সেটি দূর করে উভয়ের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টিই হওয়া উচিত এবং তা করতে হলে তাঁর জীবনী আলোচনা, তাঁর কর্মজীবন, শিক্ষা জীবন, পারিবারিক জীবন কারজীবন প্রভৃতি নিয়ে, বা এই প্রতিটি সময়কাল ও তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে সর্বত্র যেমন সত্যনিষ্ঠ আলোচনা হওয়া দরকার, তেমনই, বা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার তাঁর জীবনাদর্শ কি ছিল এবং সেই জীবনাদর্শ বাস্তবায়নে তিনি কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এবং আমরা তাঁর ঐ আদর্শগুলিকে রাষ্ট্রীয়, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কতটা লালন করছি এবং কতটা বাস্তবায়ন বাকী আছে এবং কত দ্রুত আমরা সেগুলি বাস্তবায়ন করতে চাই এবং সে লক্ষ্যে আমরা কোন পথে অগ্রসর হবো।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক নিয়ে সত্যনিষ্ঠ আলোচনা ব্যাপক ভিত্তিতে এবং সকল পর্য্যায়ে আরও করা দরকার এ কারনে যে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট থেকে একটানা একুশ বছর যাবত সামরিক-আধা সামরিক বা বেসামরিক যে সকল সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বৈধ বা অবৈধ পস্থায় দখল করেছিলেন তাঁরা বেমালুম সত্যের পথে না থেকে বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির পরিচালিত গণ আন্দোলন সমূহের, নির্বাচনী ব্যবস্থাবলীর ও বঙ্গবন্ধুর অবদান সমূহের যে বিকৃতি সাধন করেছিলেন, ইতিহাস বিকৃতির যে বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন তার পরিণতিতে আজ যাঁদের বয়স ৬০ বছর পর্য্যন্ত তাঁদের প্রায় সকলেই ঐ বিকৃত, অসত্য ইতিহাস পাঠ করতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশের এবং তার জাতির জনকের ভূমিকা ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃতভাবেই জেনেছেন ও লিখেছেন।
শুধু শিক্ষার্থীরাই নন, ঐ শিক্ষা নিয়ে কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের নামী-দামী ডিগ্রী নিয়ে যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষাদান করেছেন বা আজও করছেন তাঁদের থেকেও ঐ বিকৃত ও অসত্য শিক্ষা সম্ভবত: আজও কোন কোন ক্ষেত্রে চালু আছে।
তাই আমরা এক গভীর ও বিশাল দায়িত্বের মুখোমুখি। বঙ্গবন্ধুকে সমগ্র দেশের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরা, তাঁর জীবন, তাঁর সংগ্রাম, তাঁর বিজয়, তাঁর ভুল-ত্রুটি, তাঁর সাহস, তাঁর অবদান, তাঁর আদর্শ এবং সব কিছু। কারণ আমরা তাঁর কাছে, ইতিহাসের কাছে এবং সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে রীতিমত দায়বদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিশাল ক্যানভাস এই নিবন্ধে তুলে আনা আমার লক্ষ্য নয়। তেমন ংঢ়ধপব এর নিতান্ত অভাব। আর অত বড় দায়িত্ব পালনের সামর্থ্যও আমার নেই-সে যোগ্যতাও নেই।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক এবং অবিভাজ্য। এমন কথা আমরা হামেশাই বলে থাকি শুনেও থাকি? কিন্তু বলার সময় একটি বারও কি আমরা ভাবি, কেন তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের অখ- অস্তিত্ব বজায় না রেখে স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? পাকিস্তানের সাথে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের কি পার্থক্য রচনা করতে চেয়েছিলেন?
মনে রাখা দরকার, তিনিও তাঁদেরই একজন যাঁরা পাকিস্তান নামক মুসলমান রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন এবং তার জন্যে, অপরাপর অনেকের সাথে তিনিও প্রচ- পরিশ্রম করেছিলেন যদিও তিনি তখন একজন কিশোর কলেজ পড়–য়া এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর (মুসলিমলীগ নেতা তৎকালের) একজন বিশ^স্ত কর্মী হিসেবে। তিনিও মুসলিম লীগেরই কর্মী ছিলেন। ১৯৪৭ এর আগষ্টে তাঁর সেই আকাংখা পূরণও হয়েছিল।
অবশ্য একথাও সত্য, মুসলিম লীগের সকল নেতা-কর্মীর সাথে এক করে বঙ্গবন্ধুকে ভাবলে এক হবে না। কোন সাম্প্রদায়িক চিন্তা বা কোন ধর্মাশ্রয়ী চিন্তা তাঁকে কদাপি গ্রাস করে নি। বরং তিনি যখন দেখেছিলেন, হিন্দুরা বেশী শিক্ষিত, বেশী আধুনিক, আর্থিকভাবে বেশী উন্নত আর মুসলিম সমাজ প্রায় অশিক্ষিত, অনাধুনিক এবং পশ্চাৎপদতায় আচ্ছন্ন এবং চরম অর্থনৈতিক বৈষশ্যের শিকার তখন উভয় সম্প্রদায়কে সকল দিক থেকে বৈষম্যমুক্ত করার লক্ষ্য থেকেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করেছিলেন।
কিন্তু পাকিস্তান নামক ঐ আকাংখিত তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বছর যেতে না যেতেই, মাত্র কয়েকমাস পরেই তিনি বুঝে ফেললেন, পাকিস্তান তাঁর আকাংখিত রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে আসে নি। বরং রাষ্ট্রটি একেবারেই বিপরীত ধর্মী এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া এবং পাকিস্তানের পক্ষে ব্যাপকভাবে ভোট দিয়ে পাকিস্তান অর্জন সম্ভব করে তুললেও, বাঙালি মুসলমানদের (তথা সমগ্র বাঙালি জাতির) স্বার্থ বিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পাকিস্তান।
তখন তিনি এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী তরুণেরা ১৯৪৮ এ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নি¤œকর্মচারীদের স্বল্প বেতন ও অন্যান্য নির্য্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরিণতিতে তাঁদের জেল-জীবন সুরু হয়।
অত:পর ১৯৪৮ ও ১৯৫২ এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। জেল থেকেই তিনি তার প্রতি সমর্থন জানান। একই সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ গঠন করেন-ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
অত:পর ধারাবাহিক আন্দোলন একের পর এক। নির্বাচনের দাবীতে, বন্দীমুক্তির দাবীতে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসনের দাবীতে, সামরিক শাসনের অবসানের দাবীতে, সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবীতে, ছয়দফা-এগার দফার দাবীতে, আবারও নির্বাচনের দাবীতে, নির্বাচন পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীতে, অত:পর অসহযোগ এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
এক নিমেষে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এর মূল আন্দোলনগুলির কথা উল্লেখ করা হলেও প্রতিটি আন্দোলনের পেছনে রয়েছে অনেক ইতিহাস। এই ইতিহাসের শ্রষ্টা বাংলাদেশের সংগ্রাম। কথাটি শুধুমাত্র তাত্ত্বিক তা নয় পূরোদস্তুর বাস্তবও।
ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, বঙ্গবন্ধু এক পর্য্যায়ে এসে নেতৃত্বের মধ্যমনির আসনে অধিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানের মাটিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্বের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় স্থান গ্রহণ করেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ শোহ্রাওয়ার্দী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড মনি সিংহ, শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখও। বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে এসে প্রধানতম নেতায় পরিণত হয় এবং পূর্বোল্লিখিত নেতৃবৃন্দের অবদানও বঙ্গবন্ধুকে ঐ পর্য্যায়ে আনতে কোন ক্রমেই কম ছিল না।
আবার আওয়ামী লীগ আন্দোলনগুলির প্রধান শক্তি হলেও একক শক্তি ছিল না। সেখানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গোপন (বে-আইনী হওয়ার কারণে) কমিউনিষ্ট পার্টির অবদানও সকল আন্দোলন সংগ্রামে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁদের অবদান ও ঐতিহাসিক। বস্তুত: বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন গড়ে উঠে ছিলো জাতীয়তাবাদী শক্তি ও বামপন্থী শক্তিসমূহের সাম্মিলিত উদ্যোগে এবং পরস্পর হাত ধরাধরি করে। উভয় শক্তিই তার ফলে পুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল লাভবানও হতে পেরেছিল। আজকের বামপন্থী শক্তিগুলির দুর্বলতা দেখে অতীতকে ভাবলে ইতিহাস সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও এবং তা সঠিক ভাবনা হবে না। হবে এক ভুল ও বিকৃত ভাবনা।
বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন ভাষা আন্দোলনের ও অপরাপর আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং দলের বাম-অনুরাগী সভাপতি মওলানা ভাসানী ও অন্যান্য বামপন্থী আওয়ামী লীগ নেতারা আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম শব্দ’ তুলে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ রূপান্তরিত করতে, দ্বিধাহীনভাবে তিনি সে কাজে উদ্যোগী হন।
পাকিস্তান সরকার যখন সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে “ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান” করার উদ্যোগ নিলো অন্যান্য নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুও তার বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে বলেন, পাকিস্তান হবে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবার মিলিত ও সম-অধিকার সম্পন্ন রাষ্ট্র।
এর আগে পাকিস্তান সরকার ঐ একই লক্ষ্যে একবার উদ্যোগ নিয়েছিল পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে অর্থাৎ ধর্ম ভিত্তিতে আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকবে এবং বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থীরা ঐ আসনগুলিতে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন এবং ঐ ধর্মবিশ^াসীরা ঐ প্রার্থীদেরকে ভোট দেবেন। দেশের বামপন্থী শক্তিগুলির সাথে বঙ্গবন্ধুও পৃথক নির্বাচন যুক্ত নির্বাচন চাই বলে দাবী-উত্থান করলেন।
ধাপে ধাপে আন্দোলন যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলো, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যখন জীবনাসন ঘটলো এবং বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের প্রধান এবং একক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হলেন, তখন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় (১৯৬৪) তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের কর্মসূচী দলীয় মেনিফেষ্টোতে সন্নিবেশিত করেন এবং তিনি দলীয় সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
অত:পর ১৯৬৬ তে ঐ ছয় দফা এবং এগার দফা তারপর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হন-দেশটাও দ্রুতই মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে ঐ দাবীর মূর্ত প্রতীকে পরিণত হন।
যেদিন তাঁকে “বঙ্গবন্ধু” হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল সমাবেশে সমগ্র বাঙালি জাতি আবেগাপ্লুত চিত্তে তাকে স্বাগত জানালেও, প্রতিক্রিয়াশীল জামায়ত মুসলিম লীগ মহল তাঁর “জয় বাংলা” শ্লোগানকে আখ্যায়িত করে ভারত ভূক্তির বা দুই বাংলা এক করার নির্দেশিকা হিসেবে। কিন্তু ঐ অপপ্রচার তাঁকে বিভ্রান্ত করতে পারে নি-তিনি একদিকে যেমন বাঙালির স্বার্থের কথা বলা অব্যাহত রেখেছেন, তেমনই আবার ভারতের সাথে সৎ প্রতিবেশী সুলভ সু-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথাও সমভাবে বলেছেন। সমমর্য্যাদার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছেন। প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলি জনমতের কাছে পরাজিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের অঘোষিত পথে দেশটি অগ্রসর হতে থাকে।
এর জন্যে তাঁকে “ইসলামিক রিপাবলিক বর্জন”, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় বিশ^াস নির্বিশেষে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী সর্বদা ঊর্ধে তুলে ধরেছেন।
১৯৭০ এর নির্বাচন এলো প্রবল আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৬৯ এর ঐতিহাসিক গণ অভ্যূত্থানকে স্মরণে রেখে। নির্বাচনী পোষ্টারে ব্যবহৃত হলো না “বিসমিল্লাহ” বা অন্য কোন ধর্মীয় ইঙ্গিত। শুধুমাত্র দল, দলীয় প্রতীক ও প্রার্থীর নামে মাত্র কয়েক হাজার পোষ্টার। প্রার্থীরা আর্থিক সামর্থহীন কয়েক হাজার লিফলেট আর ইউনিয়নগুলিতে একটি করে জনসভা। ব্যস জনগণের বিপুল ভোটে বিজয় সামান্য দু’তিন হাজার টাকা ব্যয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো পাকিস্তানকে আমেরিকা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির সশস্ত্র সহযোগিতা পরাজয় নিশ্চিত করে। শুধুমাত্র পাকিস্তানকে পরাজিত করা হয় নি-পরাজিত করা হয়েছিল তার আদর্শিক অবস্থানকে। অর্থাৎ ধর্মাশ্রয়ী চেতনাকে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুও হয়েছিল গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনের লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে যা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করে ছিলেন।
তেমনই আবার মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনায় বাংলাদেশের সংবিধান রচিত ও অনুমোদিত হলো যাতে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো-নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ ও ধর্মবিশ^াস নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সম-অধিকার ও সম-মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্য হিসেবে বর্ণিত হলো।
এই বিশাল ইতিহাস, বিশাল কর্মকা-কে স্মরণ, কথায় ও কাজে তার বাস্তবায়ন, রাষ্ট্র ও সমাজকে সেইভাবে গড়ে তোলা, সম্পদ মুষ্টিমেয়ের হাতে পুঞ্জীভূত করা নয় বরং নিষ্ঠার সাথে তার সুষম বণ্টন এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার কর্মসূচী সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়নে অগ্রসর হওয়ার দাবীকে তীব্র করে তুলে তাকে পুনরায় সর্বজনীন দাবীতে পরিণত করতে পারলেই কেবল বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী পালন যথার্থ এবং ফলপ্রসূ হতে পারে শুধুমাত্র নানাবিধ জৌলুষ প্রদর্শন ও আবেগঘন বক্তৃতা ভাষণে বা মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে নয়। সেগুলি থাকবে তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার ভিত্তিতে অগ্রসর হয়েই ভূল-ভ্রান্তি সংশোধন করে, নতুন করে গজিয়ে ওঠা জঙ্গী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলির সাথে নিরন্তর লড়াই চালিয়েই আমরা বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত প্রস্তাবে স্মরণীয় করে তুলতে পারি-তাঁকে যথার্থভাবে সম্মান দেখাতে পারি।
তাই দ্বিধা-সংকোচ পরিত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মের মাস মার্চের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা ভাল হয় ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আগ দিয়ে
এক. সংসদের অধিবেশনে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে ১৯৭২ এর বঙ্গবন্ধু প্রণীত মূল সংবিধানের পুনরুজ্জীবন ঘটানো;
দুই. রাষ্ট্রে যেহেতু সকল ধর্মাবলম্বীরা সম অধিকার এবং রাষ্ট্রটি যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ তাই বঙ্গবন্ধুর পদাংক ও গণতন্ত্রের বিধান অনুসরণ করে “বিসমিল্লাহ” অপসারণ ও জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম সহ সকল ধর্মাশ্রয় দল ও প্রতিষ্ঠানকে বে-আইনী ঘোষণা করা;
তিন. একই কারণে দুর্গাপূজায় খয়রাতি সাহায্য ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তহবিলে মন্দির, মসজিদ, গীর্জা ও প্যাগোডা প্রতি নির্মান বন্ধ করা;
চার. যে সকল মন্দির, মসজিদ, গীর্জা প্যাগোডা প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ভাংচুর বা বিনষ্ট করা হয়েছে বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল অবধি তার জন্য দায়ী দলমত নির্বিশেষে সকল সন্ত্রাসীকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট মোকর্দমা দায়ের করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার কঠোর শাস্তি প্রদান ও উপযুক্ত ক্ষতি পূরণ আদায় করা এবং
পাঁচ. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সর্বকারী ডিজিট্যাল মামলা, সকল বয়াতী সহ যাঁরাই এই জাতীয় আইনে আটক আছেন, অবিলম্বে তাঁদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার ও বিনাশর্তে মুক্তিদায়ের ব্যবস্থা করা হোক।
দেশের সকল বুদ্ধিজীবী, সকল মুক্তিযোদ্ধ সকল শিক্ষক-আইন জীবী-নারী-ছাত্র যুব সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলি উপরোক্ত দাবীতে সোচ্চার ভূমিকা পালন এবং মুজিব শতবর্ষ উপযুক্তভাবে উদযাপনে এগিয়ে এসে এই বর্ষটিকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় উৎসবে পরিণত করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!