মুনীর ভাই এর অন্তিম শ্রদ্ধা

মুনীর ভাই এর অন্তিম শ্রদ্ধা
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

সংবাদে একী হলো? মাত্র ক’দিন আগে তার প্রাক্তন সাময়িকী সম্পাদক সুসাহিত্যিক খ্যাতনামা সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ সম্পাদক আবুল হাসনাতকে বিদায় জানাতে হলো, ২৪ নভেম্বর সংবাদের মালিক-সম্পাদক প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব আহমেদুল কবীরের সপ্তদশ মৃত্যুবার্ষিকী, বেশ কয়েক বছর আগে চলে গিয়েছেন প্রথম ভারপ্রাপ্ত সংবাদ বজলুর রহমান। আর আজ ২৪ নভেম্বর সকালে একটি লেখা লিখছিলাম প্রিয় বৌদি, সংগ্রামী সহযোদ্ধা রাখী দাশ পুরকায়স্থ স্মরণে। হঠাৎ টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে ভেসে উঠলো সকাল সাতটার পর পর সংবাদ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খোন্দকার মুনীরুজ্জামান ঢাকার মুগদা হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা চলাকালে বিদায় নিলেন ইহধাম থেকে।
জানি না, কে দায়িত্ব নেবেন এখন ‘সংবাদ’ এর সম্পাদনায়। তবে পত্রিকাটির সম্পাদনা বিভাগ একটি মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হলো। এই পত্রিকাটিই দেশের প্রাচীনতম দৈনিক এবং পাকিস্তান আমলের দু:সাহসী প্রগতিশীল আন্দোলনের মুখপত্র রূপে ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এক গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছিল। তার কঠিন মাশুলও দিতে হয়েছিল পত্রিকাটিকে। নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তান সরকার। আবার ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই পাক সেনারা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ‘সংবাদ’ এর বংসাল রোডস্থ দোতলা ভবনকে। অত:পর সামরিক সরকার চাপ দিয়েও খোলাতে পারে নি সংবাদকে বাংলাদেশ অবরুদ্ধ থাকাকালে। প্রকাশিত হলো মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে বাঙালির বিজয় অর্জনের পর থেকে। বাকশাল প্রতিষ্ঠার সময় পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ‘সংবাদ’কে বিস্ময়করভাবে।
অত:পর নানা দুর্যোগের মধ্য দিয়েই ‘সংবাদ’ এর দিনগুলি কেটেছে এই স্বাধীন বাংলাদেশেও। দফায় দফায় সামরিক শাসন, সংবাদ ও মতামত প্রকাশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও হুমকি সামাল দিয়েই চলছে পত্রিকাটি। ঘোরতর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। এই ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছে প্রাচীনতম এই দৈনিকটি।
এককভাবে হাল ধরেছিলেন পত্রিকাটির প্রখ্যাত সাংবাদিক বজলুর রহমান। নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যে তিনি সম্পাদকীয় বিভাগ সহ সকল বিভাগই দক্ষতা, সততা ও নীতি নিষ্ঠতার সাথে পরিচালনা করে গেছেন।
আহমেদুল কবীরের কথা বলতে চাই না। আমার দৃষ্টিতে তিনি সংবাদের মালিক পার্টির সাবেক নেতা, সুবক্তা-বিশেষ করে ঘরোয়া আলোচনায়। আমার ধারণা, তিনি উপযুক্ত নজর দিলে ‘সংবাদ’ আরও ভাল আঙ্গিকে বেরুতে পারতো-প্রচার সংখ্যাও যথেষ্ট পরিমাণে বাড়তে পারতো। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি সংবাদ যদিও একটি সংবাদপত্র তবু সংবাদ মানে সংগ্রাম-সংবাদ মানে অকুতোভয় যোদ্ধা। সংবাদ যুদ্ধ করে চলেছে সেই ১৯৫৫ সাল থেকে সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অশিক্ষা-কুশিক্ষা-দারিদ্র্য-বেকারত্বের বিরুদ্ধে, নারী নির্য্যাতন, সংখ্যালঘু নির্য্যাতনের বিরুদ্ধে সকলের সম-অধিকার ও বৈষম্য মুক্ত, কূপমস্তুকতামুক্ত একটি শোষণহীন সাম্যের সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘সংবাদ’ এর যুদ্ধ অবিরাম-আপোষহীন ও দুসাহসী ১৯৭২ এর সংবিধানের চার মৌলনীতি অক্ষুন্ন রাখা এবং ১৯৭৫ পরবর্তী পর্যায়ে সংবিধানে সৃষ্ট তাবৎ আবর্জনা মুক্ত করায় প্রত্যয়ী।
‘সংবাদ’ এর সাথে আমার সম্পর্ক ১৯৫৫ সাল থেকে। সেই থেকে আজতক ৬৫ বছর ধরে ‘সংবাদ’ এর সাথেই আছি। থাকবোও বাদবাকী কয়টা দিন।
‘সংবাদ’ পেয়েছে জহুর হোসেন চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার, তোয়াব খান সংখ্য প্রায় সবগুলি দিকপাল সাংবাদিক সাহিত্যিককে যেমন আলাউদ্দিন আল আজাদ, কে জি মুস্তফা মেনন? সবাই স্মরণীয়-সাবই বরণীয় আমিও নিজেকে ধন্য মনে করি ঐ সব দিকপাল সাংবাদিকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুবাদে। তোয়াব তাই আজও সক্রিয় জনকণ্ঠে, উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে-বাদ-বাকী সবাই লোকান্তরিত।
বাংলাদেশে সাংবাদিক তৈরীর কারখানা ছিল ‘সংবাদ’ এর বংশাল বোর্ডের সাবেক কার্যালয়টি যে কার্যালয় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল রাতের অন্থকারে পাক-সেনারা ১৯৭১ এ। বাংলাদেশে আজও খ্যাতনামা কোন সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া যাবে না-যিনি সংবাদ থেকে সাংবাদিকতার শিক্ষা গ্রহণ করেন নি।
দু:খজনক হলেও সত্যি, সংবাদ দেশের সাংবাদিক তৈরীর সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারে নি-বোধ করি সে চেষ্টাও করে নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান চাপে আজ যে আর আগের মত ব্যয়ে কোন সাংবাদিক কর্মচারীর দিন চলতে পারে না। সাবেকী ধরণের অঙ্গসৌষ্ঠব, মেকআপ, প্রিন্ট প্রভৃতি বজায় রেখে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে ‘সংবাদ’ যে পাঠক প্রিয়তা বাড়তে পারবে না আশা করবো সংবাদের বর্তমান মালিকেরা তা উপলব্ধি করবেন এবং সে ব্যাপারে উপমুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে দ্রুত উদ্যোগী হবেন। দেশের স্বার্থে প্রগতির সাথে, শিশু-সাহিত্যের স্বার্থে এটার প্রয়োজন।
সংবাদ এর বংশাল বোর্ডের কার্যালয় ছিল বামপন্থী রাজবন্দীদের ঢাকা জেল থেকে মুক্তিরপর প্রথম মিলনস্থল ও অনেকের বাড়ীর মত থাকারও জায়গা। সারা প্রদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আটক রাজবন্দীদের একটি বড় অংশকে এনে রাখা হতো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাই ঢাকার বাইরের যে রাজবন্দীরা মুক্তি পেতেন তাঁদের ২/১ রাত ‘সংবাদ’ অফিসেই থাকতে হতো।
আমি পাবনাস্থ সংবাদ দাতা, বংশাল অফিসে ১৯৫৯-৬০ সালে ডেস্কে সাব এডিটার, পরে আবারও পাবনা সাংবাদদাতা এবং ২০০১ থেকে এ যাবত কলাম লিখে চলেছি? না, কোন বৈষয়িক প্রাপ্তি সংবাদ থেকে কোনদিন ঘটে নি-তবু আকর্ষণ কমে নি।
মুনীরুজ্জামানের যাঁকে মুনীর ভাই বলে ডাকতাম, নিয়ে লিখতে নিয়ে লিখলাম ‘সংবাদ’ নিয়ে বিশাল পটভূমি হিসেবে লেখাটি দাঁড়িয়ে গেল। পাবনাতে বরাবর থাকতে ব্যক্তিগত যোগাযোগ মুনীর ভাই এর সাথে তেমন একটা ঘটে উঠতো। তবু প্রতিটি সাক্ষাত ছিল আনন্দের। কর্তব্যনিষ্ঠা ও আদর্শ বজায় রেখে রাজনতির বাইরে এসেও সংবাদকে করে নিয়েছিলেন আদর্শ প্রচারের মূল বাহনে। বিপ্লব পিয়াসী মুনীর ভাই কে তাই তুলতে পারবো না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!