শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্ত বৃাথা যাবে কি?

 

সিডনীর কথামালা-৫৬

রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য
E-mail:raneshmitra@gmil.com

সেদিন ওরা ভুল করে নি। ওরা স্বাধীনতার শত্রুরা, মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধীরা। তারা সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী তৈরী করেছিল-মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই। সে বাহিনীগুলির নাম আমরা জানি। আলবদর, আল সামস ও রাজাকার বাহিনী। নিরস্ত্র বাহিনীও ছিল তার নাম শান্তি কমিটি এই কমিটির কাজ ছিল কারা মুক্তিযুদ্ধের খাতায় নাম লিখিয়েছে, কারা দেশের অভ্যন্তরে বা ভারতে গিয়ে অস্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে-তাদের পরিবারের কে কোথায় বা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে কে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে সেগুলির তথ্য সংগ্রহ করে গোপনে পাক বাহিনীকে সরবরাহ করা এবং সে দায়িত্ব তারা যথার্থই পালন করেছিল।

এই শক্তিকমিটি নামটি ছিল অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। অনেকে বিভ্রান্তিতে ভুগেওছেন বলে পরে দেশে ফিরে এসে শুনেছি। হ্যাঁ, কোথাও কোথাও তারা ২/১ টি নির্দোষ পরিবারকে বা তাঁদের পাড়াকে নিরান্ধ রেখেছেন পাকবাহিনীে ক কোন বিরুপ খবর সরবরাহ না করে। কিন্তু তার সংখ্যা নেহায়েতই হাতে গোনার মত। বাদ-বাকী যে বিশাল জনগোষ্ঠী হিন্দু-মুসলিম নিবির্ েশষে – তাঁরা কিন্তু শান্তি কমিটির ঝাল ঠিকই বুঝেছেন-তার স্বাদ কেমন তাও টের পেয়েছেন-মাশুলও দিয়েছেন নিজের মোমও মেয়েকে যখন তারা তুলে নিয়ে গিয়ে ইসলামের হেফাজতকারী মদ্য পানরত পাক-সেনাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে এসেছে শ্রেফ তাদের যৌন লালসা মেটানো এবং ঐ মেয়েদের গর্ভ থেকে ‘খাটি মুসলমান’ পয়দা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যে। মা-বাবা-ভাই-বোনদের কোন কাকুতি-মিনতিই শান্তি কমিটির নেতাদেরকে ঐ কাজ থেকে বিরত করতে পারে নি। এতৎ সত্বেও স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে এ যাবত শান্তি কমিটির লোকজন খুব কমই বিচারের সম্মখীন হয়েছে।

কিন্তু শান্তি কমিটি অফিসিয়ালি সশস্ত্র বাহিনী ছিল না। আলবদর, আলশাম্স্ ও রাজাকার বাহিনীগুলো গঠিতই হয়েছিল অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র সজ্জিত করে। পাকিস্তানকে ‘হেফাতকৃৎ করার নামে প্রগতিশীল বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন তাদের আশ্রয়দাতা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবী এবং সর্বোপরি দেশের হিন্দুসমাজ পরিপূর্ণভাবে ছিলো এই বাহিনীগুলির টার্গেট। ফলে যাঁরা শরণার্থী
হিসেবে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে শতকরা ৯০ ভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত।

হিন্দুরা তখন ঝড়েবংশ বিতাড়িত হলেন এবং দেশ যে প্রকৃৃতই হিন্দুশূণ্য হয়ে পড়েছে এবং শুধুমাত্র মুসলিমরাই পূর্ব পাকিস্তানে রয়েছেন তা স্পষ্ট করার জন্যে এবং তঁদের বাড়ীঘরগুলো যাতে হিন্দুর বাড়ীঘর বলে মনে না করা হয় তাই বাড়ীর দরজায় বড় বড় হরফে লেখা হলো “This is Muslim’s House অন্তত: শহরগুলোতে তাই করা হয়েছিলো।

মুসলিমরাই শুধু আছেন তা শুধুমাত্র ঐ দেয়াল লিখনের মাধ্যমে পাক-সেনাদেরকে বুঝানো পূরোপূরি সম্ভব হয় নি। পথে ঘাটে চলাফেরার সময় অতর্কিতেই ঐ সৈন্যরা ছোল ছোট ব্যারিকেড রচনা করে কাপড় খুলে দেখতো সত্যই তাঁরা মুসলমান কি না। এমন বর্বরতার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া ভার।

বাস সার্ভিস গুলোকে পুলিশী মেজাজ এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে চালু রাখা হয়েছিল কিন্তু তাদেরও ঝামেলা কম পোহাতে হয় নি। চলমান বাসগুলিকে যেখানে-সেখানে থামিয়ে অস্ত্র বহন কারী কেউ আছে কি না তা চেক করার নামে যাত্রী হয়রানির সীমা থাকতো না। তাদের ব্যাগ বা পোঁটলা খুলে দেখা ছাড়াও কাপড় খুলে অপর যাত্রীদের সম্মুখে (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) হেনস্থা কি কম করেছে ঐ বর্বরেরা।

পাবনা জেলা স্কুলের তদানীন্তন জনপ্রিয় ছাত্র-অভিভাবক বান্ধব হেড মওলানা কফিল উদ্দিন আহমেদকে বাসে গ্রামে যাবার সময় পাবনা শহর থেকে ১৪ মাইল দূরে মাধপুর নামক জায়গায় বাস থেকে নামিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে পাক-সেনারা। পাবনার প্রধান মানুষের আজও মওলানা সাহেবকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন দলমত নির্বিশেষে। তিনি শহীদ হন ১০ জুন, ১৯৭১।

মওলানা কসিম উদ্দিন আহমেদ ২৬ মার্চ ভোরে তাঁর জরাজীর্ণ বাই সাইকেলে চড়ে পাবনার রাজনীতিক ও নেতৃস্থানীয় ছাত্র-যুব কর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে সকলকে ডেকে তুলে শিগগির বাড়ী ছেড়ে চলে যান কোন নিরাপদ আশ্রয়ে-পাক-বাহিনী মধ্যরাতে পাবনা শহরে এসে গেছে-প্রধান প্রধান সড়কে জীপে করে টহল দিচ্ছে-সান্ধ্য আইন জারী করেছে। তাই বাসায় থাকা নিরাপদ না-এহেন খবর স্বতো:প্রবৃত্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে গোপনে পৌঁছে দিয়ে তৎকালীন পাবনার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র ও যুব নেতৃত্বকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

শুধু তাই নয়, ঐ খবর দেওয়াতে সকলের প্রাণরক্ষা ছাড়াও যে কাজটি হয়েছিল তা হলো পাবনাতে পাক- সেনা বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ তাঁর অজান্তেই ত্বরান্বিত হয়েছিল।

মাওলানা কছিম উদ্দিন ঐ দিন কাক-ডাকা ভোরে নিঝুম পাবনা শহরে যখন আমার বাসায় এসে অতর্কিতে কড়া নেড়ে আমাকে ডেকে তোলেন, তখন আমার সহধর্মিনী পূরবী তাড়াহুড়া করে ঘুম থেকে উঠে তাঁকে এক পেয়ালা গরম চা এনে দিলে তিনি বিনীত ভাবে বললেন, “না, আজ আর চা খাওয়ার সময় নেই। আমি ছুটবো আরও অন্যান্য নেতাদের বাড়ী বাড়ী। সেনাবাহিনী এসে সমস্ত টেলিফোন সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় সাইকেল ছাড়া খবর রাত থাকতে পৌঁছানো বিকল্প আর কোন পথ নেই।” বলেই চলে যান তাঁর আবদ্ধ কাজ সম্পন্ন করতে। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।

মাওলানা কছিম উদ্দিন শহীদ হলেন কিন্তু তিনি কোনভাবেই কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। আজ দীর্ঘ ৪৫ বছর পরে বিদেশের মাটিতে বসে বার বার তঁকে মনে পড়ছে আর বেদনার্ত বোধ করছি এই ভেবে যে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও আমরা পাবনা বাসী পারিনি তাঁর, ডা. অমলেন্দু দাক্ষীর, জনপ্রিয় শিক্ষক সিবাজী সিংহের স্মৃতি রক্ষার জন্য দৃশ্যমান কোন কিছু করতে। তাই নতুন প্রজন্ম জানেই না তাঁদের নামটুকুও। এ জন্যে  আমরা দায়ী-আমরা অপরাধীও।

জাতীয় ভাবে যে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে আমাদের জাতীয় সংবাদপত্র সমূহে প্রকাশিত হতে দেখি তাতেও পাবনার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের (এবং দেশের নানা অংশের -ঢাকা শহর ব্যতীত) নাম আজও প্রকাশিত হতে দেখি না। তবে ধন্যবাদ জানাই স্নেহভাজন অনুজ প্রতিম রশীদ হায়দারকে (কথা সাহিত্যিক) বাংলা একাডেমী প্রকাশিত তাঁর লেখা এক গ্রন্থে এদের সম্পর্কে লিখেছিলেন
কিন্তু আজ সম্ভবত: আর ঐ বইও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পাবনার ক্ষেত্রে একমাত্র শহীদ আমিন উদ্দিন এর নামে পাবনা ল’কলেজ ও পাবনা ষ্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে কিন্তু তাতে তো তাঁর অবদান কি ছিল তা জানা জাবে না। তিনি পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান এবং পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয় যে আইনজীবী সমিতিও শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা আইনজীবীদেরকে স্মরণে রাখার মত কোন কিছু করার উদ্যোগ আজ পর্য্যন্তও গ্রহণ করেন নি। অথচ পেশায় তিনি ছিলেন আইনজীবি সারাটাদিন কাটাতে কাটাতেই বস্তুত আমরা যেন জাতি হিসেবে এক চরম অকৃতজ্ঞজাতি হিসেবেই নিজেদেরকে তুলে ধরছি-ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলার এ এক তীব্র প্রতিযোগিতা যেন।

জাতীয় পর্য্যায়ে কথা তুলেছি। ১৪ ডিসেম্বরের পত্রিকাগুলিতে এবারও নিশ্চয়ই ছবিসহ প্রকাশিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম ও ক্ষদ্রাকবরের ছবি। তাতে স্থান পেয়ে থাকেন হাতে গোনা ১২/১১৪ জন মাত্র। এঁদের মধ্যে স্মরণে আসে মানবতাবাদী ও দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক ডা. জি.সি.দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক গুহ ঠাকুরতা, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দিন হোসেন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ডা. ফজলে রাব্বী,
অধ্যাপক রশিদুল হাসান প্রমুখ।

শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন সংবাদ এর যুগ্ম সম্পাদক ও নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সাংবাদিক ইউনিয়ন (ই.পি.ইউ.জে) এর সভাপতি। ঢাকাতে নিজ বাসা থেকে রাত গভীরে তাঁকে চোখ বেধে মুখোস পরা আলবদর বাহিনী তুলে নিয়ে যায়।

তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের নানভাবে সহায়তা করছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধের উপর রচনা করছিলেন একটি বই। সংবাদ অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বন্ধ ছিল পত্রিকাটি।

সিরাজউদ্দিন হোসেন তখন ছিলেন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক। ঐ গভীর দুঃসময়ে যখন কঠিন সেস্মরশীপ আরোপিত হয়েছিল সংবাদপত্রগুলির উপর এবং সেনা-কর্মকর্তাদের অনুমোদন ব্যতীত কোন কিছুই প্রকাশ করা নিষিদ্ধ ছিল তখনও সিরাজউদ্দিন হোসেন ভাষার মারপ্যাঁচে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের ব্যাপারে কিছু কিছু ইংগিত দিয়ে লিখেছিলেন পাঠক-পাঠিকাদের মনে অনুপ্রেরণা সঞ্চার ও হাতাশা দূরীকরণের জন্য। তঁকেরও একইভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে আলবদরের হত্যা করে।

অধ্যাপক আনোয়ার পাশার কথা অনেকবার লিখেছি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন দেখে সেখানকার বাংলা বিভাগের শূন্যপদে নিযোগের জন্য দরখাস্ত করলে একটি ইন্টারভিউ কার্ড পান এবং ইন্টারভিউ দেন। ছিলেন বহরমপুর কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অত্যন্ত মেধাবী ও গুনী ছাত্র ও শিক্ষক। খুবই ভাল করলেন ইন্টারভিউতে কিন্তু শ্রেফ মুসলমান ঘরের সন্তান হওয়ার চাকরিটি হলো না ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রধানের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে। ক্ষোভে, দু:খে অপমানে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে এসে বাংলা বিভাগের শিক্ষক পদে যোগ দেন। কয়েক বছরের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেয়ে চলে যান স্ব-পরিবারে।

পাবনায় থাকাকালে ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রাতে আনোয়ার পাশা এডওয়ার্ড কলেজের হিন্দু হোস্টেলের অসহায় প্রায় ৩০ জন হিন্দু ছাত্রকে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে একক চেষ্টায় বাঁচালেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক পাক বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদররা তাঁকে তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এডওয়ার্ড কলেজে তার বা শহীদদের কোন স্মৃতি নেই।

পাবনার সন্তান ডা. ফজলে রাব্বী। কিন্তু কিছুই আজও করা হয় নি তাঁর স্মরণে। বারবার লিখেছি নিজের পাবনায় প্রতিষ্ঠিত সরকারী মেডিক্যাল কলেজটির নামকরণ করা হোক “শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী সরকারী মেডিক্যাল কলেজ, পাবনা” রূপে।

কিন্তু হয় নি। বস্তুতই আমরা শহীদদের আমরা ভূলতেই বসেছি।

 

 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!