ষোড়শ সংশোধনী ও অবিকল বাহাত্তর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন

 

ষোড়শ সংশোধনী ও অবিকল বাহাত্তর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন

রণেশ মৈত্র,

সভাপতি মন্ডলীর সদস, ঐক্য ন্যাপ

আমাদের আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিমূল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাতিল করার পর থেকে হঠাৎই যেন বাহাত্তর সংবিধানে ফেরার কথা বারবার বলে চলেছেন। বিষয়টি একটা ধূম্রজালেরও সৃষ্টি করেছে আমাদের জনমনে-এ রকমটাই মনে হয়।
তাই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন মনে করে এই নিবন্ধটি শিখতে প্রবৃত্ত হয়েছি।

বাহাত্তর সংবিধানে ফিরে যাওয়া হোক পরিপূর্ণভাবে এটা বাংলাদেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ দিনের দাবী। জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে যখন রাষ্টধক্ষমতা দখল করে রাইফেলের বাঁট দিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী জারী করে “বিসমিল্লাহ্” সংযোজন করেন, জামায়াতে ইসলামী সহ ধর্মাশ্রয়ী দল ̧গুলিকে বৈধতা প্রদান করেন-তখন আওয়ামী লীগও বাহাত্তরের সংবিধানের অবিকল পুনরুদ্ধারের দাবীতে সোচ্চার হয়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের দাবীও উত্থাপন করেছিল। অপরাপর গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী দলগুলিও ঐ দাবীর সর্মথক হওয়ায় তারাও একত্রে ঐ আন্দোলনে যৌথভাবে শরীক হয়েছিলেন।

অত:পর অপর সামরিক স্বৈরশাসক হোসেন মুহাম্মদ এরশাদ যখন অবৈধভাবে প্রায় একই পন্থায় রাষ্টধক্ষমতা দখল করে অষ্টম সংশোধনী জারী করে “রাষ্টধধর্ম ইসলাম” সংযোজন করেন-শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করেন এবং ১৫ দল গঠন করে ঐক ̈বদ্ধভাবে আন্দোলনে নামেন বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরূদ্ধারের দাবীতে।

বহু বছর ধরেই ঐক্যবদ্ধ এ আন্দোলন চলছিল সকল দলের সম্মত নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐ কর্মসূচীর অন্যতম মূল সুর ছিল  জনগণের দ্বারা এবং অবাধ, নিরপেক্ষ, শন্তিপূর্ণ ভোটে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে যৌথ নেতৃত্বে। স্বৈরশাসকের মত রাষ্ট্রপতির হাতে সকল ক্ষমতা রাখা হবে না। বিচার বিভাগ হবে সম্পূর্ণ  স্বাধীন ইত্যাদি। টার্গেট স্বৈরাচারী এরশাদ।

যা হোক স্বৈরাচার বিরোধী ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন সফল হলো এরশাদের ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করার মাধ্যমে।

অত:পর নির্বাচন ১৯৯১ তে। ঐ নির্বাচনী ফলাফলে কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় বি.এন.পি সরকার গঠন করে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে। এর বিরূদ্ধেও আন্দোলন হয়েছে জামায়াতের সাথে আঁতাতের বিরোধিতা করে।

অবশেষে ১৯৯৬ এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে মন্ত্রী সভা গঠন এবং পাঁচ বছর ব্যাপী দেশ শাসন করলেও সংবিধান সংশোধনীর বিষয় ভাবা সম্ভব ছিল না প্রয়োজন মত দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার ফলে। তাই ঐ দফাতেও বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যাবর্তন সম্ভবপর হয় নি বা বিল উত্থাপন করে তার প্রতি অন্যান্য দলের সমর্থন কামনা করাও হয় নি।

ইতোমেধ্যে বি.এন.পি’র ১৯৯১ এর সরকার চলাকালে অবশ্য বি.এন.পি সকল দলের সর্মথন নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে যার মাধ্যমে রাষ্টধপতির ক্ষমতা ভয়ানকভাবে হ্রাস করে সকল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যাস্ত করা হয়। রাষ্টধপতির হাতে থাকলো বছরের জাতীয় দিবস ও ধর্মীয় উৎসব সমূহের দিনগুলিতে বঙ্গভবনে সম্বর্ধনা ও কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন এবং মন্ত্রীসভা তথা প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে পাঠানো সকল ফাইলে স্বাক্ষর দান। রাষ্টপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে কোন ভারসাম্য রাখা হয় নি ঐ
সংশোধনীতে।

যা হোক, এ কথা সত্য যে বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারপতিদের নিয়োগ, ক্ষমতাচ্যুত, বদলি, পদোন্নতি প্রকৃতি রাষ্টধপতির হাতেই ন্যাস্ত ছিল। এ কথাও সত্য যে জিয়াউর রহমানের সামরিক আমলেই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যাস্ত করা হয় রাষ্টধপতির হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল তদন্ত করবে যদি কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপিত হয়। তদন্ত রিপোর্ট তাঁরা পাঠাবেন রাষ্টধপতির কাছে। রাষ্টধপতি তদনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিচারক বা বিচারকবৃন্দের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

জিয়ার এই বিধানের বিরুদ্ধে সংসদে আনা বিল অনুযায়ী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাশ করা হয় সংসদে। এই সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল রহিত করে রাষ্টধপতির হাতে ক্ষমতা পুনরায় ন্যাস্ত করা হয়। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল, তৎকালীন বিধানমতে, সর্বোচ্চ আদালতের সর্বজ্যেষ্ঠ তিনজন বিচারক সমবায়ে গঠিত হতো। অতএব সংসদে বলা হলো : “ওঁরা নিজেদের বিচার নিজেরাই করতে চান”।
যা হোক, এই ষোড়শ সংশোধনী সারা দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়। অভিযোগ উত্থাপিত হয় যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এর দ্বারা হরণ করা হলো এবং বিচার বিভাগকে কার্য্যত: শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রনে নেওয়া হলো।

এই বিতর্কের এক পর্যায়ে জনৈক আইন জীবী হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। যাতে বলা হয় যে ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে এবং কার্য্যত: বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের অধীনস্ত করতে চাওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট রুশ ইস্যু করেন এবং যথাসময়ে হাইকোর্টে উভয় পক্ষের শুনানীর পর হাইকোর্ট উক্ত ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করে তাকে বাতিলের আদেশ প্রদান করেন। রাষ্টধপক্ষ যথারীতি ষোড়শ বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করেন।

আপিলের শুনানীর জন্যে সুপ্রিম কোর্ট ১০ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রখ্যাত আইনজীবীকে আদালতকে সাহায্য করার জন্য এমিকাস কিউরী নিয়োগ দান করেন। অত:পর রাষ্টধপক্ষ-বাদীপক্ষ ও এমিকাস কিউরীদের সহ আদালতে দীর্ঘ শুনানী অন্তে সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চ এক দীর্ঘ রায়ে সর্বসম্মতভাবে ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা হরণকারী ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করেন। ফলে তাৎক্ষনিকভাবেই সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল প্রথার পুনরুজ্জীবন ঘটে।

এই রায়ের সাথে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দধ কুমার সিনহা বিদ্যমান নানা বিষয়ে তাঁর পর্য্যবেক্ষণ প্রদান করেন যাতে সংসদ, রাজনীতি, আইনের শাসন, রাষ্টেধর তিনটি শাখার মধ্যে সমন্বয় ও সুসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর ভাবনা লিপিবদ্ধ করাঁ হয়।
রায়টি প্রকাশের সাথে সাথেই এটর্নী জেনারেল তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, সরকার চেয়েছিলেন সামরিক শাসক প্রবর্তিত বিধান বাতিল করে বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যবর্তন। সেই বিষয়টি এই রায়ের ফলে দুরূহ এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়লো।

অর্থমন্ত্রী আবুল আল আবদুল মোহিত সিলেটে এক সমাবেশে বলে বললেন। সংসদ প্রণীত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিষয়টি আমরা মানব না। আমরা আবারও সংসদে ঐ সংশোধনী পাশ করবো। যদি এর পরেও আদালত তা বাতিল করে বা তারা যতবার তা বাতিল করবে আমরা ততবারই তা পাশ করবো। বিচারকরা কারা? আমরাই তো তাদের নিয়োগ দিই।

এমন উক্তি কোন সভ্য দেশে কল্পনাই করা যায় না। অবশ্য আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট তাঁর দেশের আদালতের বিরুদ্ধে যত্র-তত্র কঠোর উক্তি করে থাকেন যা ঐ দেশের আর কোন প্রেসিডেন্ট করেছেন বলে মনে পড়ে না। তবে সর্বাত্ম জনগণ কদাপি ট্রাম্পের ঐ সকল সভ্যতা বিবর্জিত উক্তি প্রতি সমর্থন জোগান নি।

যা হোক, অত:পর ২০১৭ সালের আগষ্টের শুরুতেই যখন সুপ্রিম কোর্টের ঐ বহুল আলোচিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণী প্রকাশিত হলো, মনে হলো জাতীয় শোকের মাসটি ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকরীদের চাইতে আমরা বহুগুন বেশী করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম প্রধান বিচারক এস.কে সিনহার বিরুদ্ধে। আমরা দিব্যি আদাজল খেয়ে প্রচার প্রচারণায় নেমে পড়লাম। এ প্রচারে কে কার চেয়ে বেশী আক্রোশ ঝাড়বেন তার জন্যে যেন তীব্র এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো গোটা সংসদ, সকল নেতা-উপনেতা-পাতিনেতা।

বিষয়ের সাথে লক্ষ্য করা গেলো জনৈক অবসর প্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এক মহা সুযোগ পেয়ে গেলেন এস.কে. সিহার বিরুদ্ধে তাঁর ব্যাক্তিগত আক্রোশ ঝাড়ার। সরকারী দলের কেউ কেউ সিনহার পদত্যাগ দাবী করতে শুরু করেছিলেন, ঐ সম্মানিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারক আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে দাবী তুলে বসলেন, শুধু পদত্যাগ করলেই হবে না – তাঁকে দেশ ছেড়েও চলে যেতে হবে। শুনা যায়, যখন ঐ অবসার প্রাপ্ত বিচারপতি কর্মরত ছিলেন, এস.কে. সিনহার কোন কাজ তাঁর স্বার্থে হানি ঘটিয়েছিল। অবশ্য বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে আমার কোন স্পষ্ট ধারণা নেই।

দেখা গেল, শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি এস.কে. সিনহাকে বেশ দধুতই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হলো এবং বিদেশ থেকেই রাষ্টধপতির কাছে তাঁর পদত্যাগ পত্রও পাঠিয়ে দিতে হলো। সাথে সাথে তা গৃহীতও হলো। আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

অত:পর সুপ্রিম কোর্টের কর্মে জ্যেষ্ঠতম পরবর্তী বিচারক, যিনিও ঐ রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ ঐক্যমত্য ঘোষণা করে স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব সরকারীভাবে অর্পন করা হলো। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে অদ্যবধি তিনি কর্মরত আছেন। সুপ্রিম কোর্টের কাজকর্মও যথারীতি চালু আছে তবে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে বিচারপতি সিনহার বিদেশ যাত্রার অব্যবহিত পরেই নানা স্থানে আকস্মিকভাবে বদলি করে দেওয়া হয় সম্ভবত: তাঁদেরকে সিনহার সমর্থক বলে চিহ্নিতও করা হয়। অদ্যবধি সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী প্রধান
বিচারক তো দূরের কথা, বহু সংখ্যক শূণ্য পদে কোন বিচারপতির নিয়োগও দেওয়া হচ্ছে না। এ ব্যপারে বিচারকার্য স্বভাবত:ই বিলম্বিত হতে থাকলেও কোর্টের পক্ষ থেকে সত্বর বিচারপতির শূণ্য পদগুলিতে নিয়োগ দানের কথাবার্তাও শুনা যায় না-যা সিনহার আমলে যদিও তা হামেশাই শুনা যেত।

যা হোক, দীর্ঘ সময়, তর্ক-বিতর্কের ও নানাবিধ পদক্ষপ গ্রহণের পর সরকার অবশেষে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পুনর্বিবেচনা করে ঐ রায় বাতিল এবং প্রধান বিচারপতির পর্য্যবেক্ষণ সমূহও বাতিল ঘোষণার দাবী জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পুনর্বিবেচনার আবেদন লিখিতভাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সুপ্রিম কোর্টেই দায়ের করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এ তথ্য এটর্নী জেনারেল এবং আইন মন্ত্রী উভয়েই জানিয়েছেন।

এই আবেদন দাখিল উপলক্ষ্যে আহুত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পৃথক পৃথক দিনে তাঁরা জানিয়েছেন সরকার চায় সামরিক ফরমানে জারী করা বিধান কার্য্যকর না থাকুক বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত যেতেই এই উদ্যেগ। জানি না, যে বিচারকেরা (বিচারপতি সিনহা ব্যতিরেকে) বাতিলের ঐ রায় সর্বসম্মতভাবে দিয়েছিলেন, এক-দুইজন না থাকলেও বাদ বাকী বিচারকেরা সম্পূর্ণ রায় ও পর্য্যবেক্ষণ বাতিল ঘোষণা করবেন কি না বা তাঁদেরই উক্তিমত ঐ ষোড়শ সংশোধনীকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণকারী বলে
উল্লেখ করেছিলেন তা নিজ হাতেই বে-আইনী ঘোষণা করবেন কি না তা আজও কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব না। তবে এই  পুনর্বিবেচনা ও তার আদেশের প্রতি দেশ-বিদেশের কৌতুহলী নজর যে বিশেষভাবেই থাকবে তা বলা বাহুল্য।

এবারে ফিরে আসা যাক আইন মন্ত্রী মহোদয় এবং এটর্নী জেনারেল যে সদিচ্ছা প্রকাশ করে বলেছেন, জিয়ার সামরিক আইনের সংশোধনী নয়, বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়াই ছিল সরকারের ইচ্ছা এবং সে কারণেই সংসদ ষোড়শ সংশোধনী নামক সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল।

ঘোষিত এই উদ্দেশ্যটিকে মহৎ বলতে হবে কারণ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ যে মৌলিক আদর্শগুলির ভিত্তিতে ব্যপকতম ঐক্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল তার সব কটিই বাহাত্তরের সংবিধানে যথাযথভাবে বিধৃত হয়েছিল। সে কারণেই বাহাত্তরের সংবিধান ও বাঙালি জাতির মু৩িযুদ্ধ দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে সমার্থক হয়েছিল।

ঐ মৌল আদর্শগুলি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জনগণের সকল মৌলিক ও মানবধিকারের স্বীকৃতি।

আবার এ কথাও আমরা স্পষ্টত: জানি ঐ সংবিধানটির সম্পূর্ণ বে-আইনী এবং সংবিধান বহির্ভূত পন্থায় সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদ সংশোধন করে কতকগুলি বিষায় ও মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শ বিরোধী কতিপয় সংশোধনী এনে সংবিধান ও রাজনীতিকে কলুষিতই শুধু করেন নি-তাঁরা এদেশের রাজনীতিতে সাম্পধদায়িক পাকিস্তানমুখী ভাবধারার পূনরুজ্জীবন ঘটাতেও প্রয়াস পেয়েছেন। তাই যদি একটি বিষয়ে যথা ষোড়শ সংশোধনীই বা জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা বাতিলের মধ্যেই যেন প্রচেষ্টা সীমিত না থাকে তার চাইতে অধিক গুরুত্ব ও আন্তরিকতা দিয়ে যেন-

এক. জিয়া প্রবর্তিত “বিসমিল্লাহ্” সংবিধান থেকে যেন বিদেয় দেওয়া হয়;

দুই. একই সামরিক শাসক জিয়া প্রবর্তিত জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলিকে ও তাদের রাজনীতিকে দ্রুত সংবিধান সংশোধন করে স্থায়ীভাবে অবৈধ করে দেওয়া হয়;

তিন. জিয়া ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়েছিলেন সংবিধান থেকে তাই তা যেন কোন ক্রমেই অপর কোন বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সাংঘর্ষিক সকল কিছুই যেন সংবিধান থেকে পূরোপুরি বিদেয় দেওয়া হয়। বাহাত্তরের সংবিধানে যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল তা যেন সেভাবেই করা হয়;

চার. দ্বিতীয় সামরিক শাসক এরশাদ অনুরূপ অবৈধভাবে রাষ্টধক্ষমতা দখল করে সংবিধানে “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” সন্নিবেশিত করে সংবিধান এবং রাষ্ট্রকে পূরোপূরি সাম্প্রদায়িক করে তুলেছিলেন, সেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ কেও যেন দ্রুত একটি সংশোধনী এনে তাকে তুলে দিয়ে সংবিধানটিকে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে অবিকল ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

পাঁচ. প্রকৃতই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে উচ্চ আদালত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুন:প্রতিষ্ঠা করেছেন কি না সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সকল সাবেক বিচারক ও বাংলাদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের মহাসম্মেলন ডেকে ধীরস্থিররভাবে সকলের মতামত নিয়ে সর্বজন গ্রহনযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচার-বিভাগ সংক্রান্ত অস্থিরতার দ্রুত অবসান ঘটানো হোক।

মোট কথা বাহাত্তরের সংবিধানের উপরোল্লিখিত মৌল আদর্শগুলিকে যেন এড়িয়ে যাওয়া না হয় যেমনটি করা হয়েছে কুখ্যাত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।


 

 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

কাগজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!