গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের জমি ও জীবন

একই সঙ্গে আমি জমির লড়াইয়ে লিপ্ত গোবিন্দগঞ্জের বিশেষ করে এবং সাধারণভাবে সারা দেশের আদিবাসীদের জীবনপণ লড়াইয়ের সঙ্গে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের মাধ্যমে সংগ্রামী সংহতি প্রকাশ করছি।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই, যেমন দেখছি অস্ট্রেলিয়াতেও, আদিবাসীদের (indigenous) প্রতি নির্মম, বর্বর নির্যাতন সুদূর অতীতে চললেও, সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে এবং ঘটতে চলেছে। এখন তাঁরা তাদের অতীতের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য আদিবাসীদের museum গড়ে তুলতে পেরেছেন।তাদের হস্ত ও কারুশিল্প প্রভৃতি নানা প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত ও সমাদৃত হচ্ছে। তাদেরকে নিয়ে তথ্যবহুল অসংখ্য বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি তাঁরা নানা রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে রাজ্য সংসদে ও ফেডারেল পার্লামেন্টেও সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলিতে অত্যন্ত সীমিত সংখ্যায় হলেও নির্বাচিত হয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছেন।

সর্বোপরি, ২০০০ সালে নির্বাচিত হয়ে অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির নেতা ও তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এখানকার আদিবাসীদের উপর অতীতে যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তার জন্যে “SORRY” বলে দুঃখ প্রকাশও করেছেন। এ ঘটনা আমি তখন সিডনিতে বসে টেলিভিশনে লাইভ শোতে দেখেছিলাম।

সত্য বটে, আজও সেই indigenous population বা আদিবাসীদের সকল দাবি-দাওয়া পূরণ হয়নি। কিন্তু বেশ কিছু দাবি যে পূরণ হয়েছে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। এখানকার আদিবাসীরা একদিকে তা স্বীকার করেন, অপরদিকে বাদ-বাকি দাবি নিয়ে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে আন্দোলন করে চলেছেন।

কিন্তু বাংলাদেশে? এখানে আদিবাসীদের তো সাংবিধানিক স্বীকৃতিই নেই। সরকার এদেশে আদিবাসীর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাদেরকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলা হয়ে থাকে– যে পরিচিতি আদিবাসীদের প্রকৃত পরিচিতি নয় এবং তাঁরা তা মানতে আদৌ রাজি নন। স্মরণে আনুন, আমি পার্বত্য চট্টগ্রাম-রাঙামাটি অঞ্চলের নিকট অতীতের করুণ ও রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা বলছি। বছরের পর বছর ধরে চলা ঐ লড়াইয়ে হাজার হাজার আদিবাসী ও বাঙালি সৈন্যকে অহেতুক প্রাণ হারাতে হয়েছিল।

সমস্যাটির সৃষ্টি হয়েছিল জিয়াউর রহমান যখন আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে বাঙালিদেরকে নানা অঞ্চল থেকে নিয়ে স্থায়ী বসতি গড়তে ঐ অঞ্চলে পাঠান, তখন। দ্বন্দ্ব শুরু হয় পাহাড়ি আদিবাসী বনাম নতুন বসতি গড়া বাঙালিদের মধ্যে। ঐ বাঙালিদেরকে রক্ষা করতে ঐ অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় ক্যান্টনমেন্ট। সৈন্যদেরকে Settler বাঙালিদের পক্ষভুক্ত করে দেওয়া হয়ে। এত সব করেও ঐক্যের শক্তিতে বলীয়ান পাহাড়ি আদিবাসীদের পরাজিত করা সম্ভব হয়নি।

অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন পাহাড়িদের পক্ষ থেকে তাদের অবিসংবাদিত নেতা সন্তু লারমার সঙ্গে। ‘সীমান্ত চুক্তি’ বলে খ্যাত ঐ চুক্তি সাক্ষরের পর তার শর্ত অনুযায়ী সন্তুর নেতৃত্বে পাহাড়িরা দেশে ফিরে তাদের যাবতীয় অস্ত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে ফেরত দেন। এ ঘটনা প্রায় দুদশক আগের। দেশ-বিদেশে ঐ ঐতিহাসিক চুক্তি সমাদৃত হয়। বন্ধ হয় রক্তপাত।

দুঃখজনক যে, বাংলাদেশ সরকার ঐ চুক্তির শর্তগুলির মধ্যেকার প্রধান প্রধান এবং বেশিরভাগ শর্তই আজও পূরণ করেননি। ফলে দানা বাঁধছে ক্ষোভ। এই ক্ষোভ দীর্ঘকাল বজায় থাকার ফলে আদিবাসীদের একাংশের মধ্যে উগ্রবাদী প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার তার স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্তাবলী পূরোপুরি এবং অতিসত্বর পূরণ না করলে ভবিষ্যত অনাকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। আশা করি দ্রুততার সঙ্গে চুক্তির সকল শর্ত পূরণ করে উভয় পক্ষ পার্বত্য এলাকায় স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করবেন।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের আদিবাসীরা সমতলের বাসিন্দা হওয়ায় তাঁরা ‘সমতলের আদিবাসী’ বলেই অভিহিত। এঁরা পাহাড়িদের চাইতে আপাতদৃষ্টিতে দুর্বল। কারণ এঁদের মোট সংখ্যা যাই হোক, এঁরা নানা অঞ্চলে বিছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ফলে এঁরা সুসংগঠিত না হওয়ায় যুগ যুগ ধরে শিকার হচ্ছেন নিষ্ঠুর নির্যাতনের। তাদেরকে ভিটে-মাটি জমি-জমা থেকে যে কোনো মূল্যে উৎখাত করে সেগুলি গ্রাস করাই হল এর মধ্যে প্রধান ধরন।

বাস্তবে ভূমিগ্রাসীরা সারাদেশের সকল অঞ্চলে সক্রিয়। কিন্তু, আমার কথা হল, তারা কোনো কিছুই করার ক্ষমতা রাখত না যদি না তাদের পেছনে সরকার, আমলা বা সরকারি দলের কোনো না কোনো অংশের প্রকাশ্য বা গোপন মদদ থাকত। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের দেড় শতাধিক হতদরিদ্র আদীবাসীর উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে ভূমিগ্রাসী বলে পরিচিত কোনো মহল নয়– সরাসরি সরকারি আমলা, পুলিশ ও সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা। সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা যেমন আদিবাসীদের পক্ষভুক্ত হয়ে একদা আন্দোলন করেছিলেন, আজও সেই নেতাই তাঁর দলবল, সমর্থক গুণ্ডা-পাণ্ডা নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রায় এক সহস্র অসহায় দরিদ্র আদিবাসীকে ৬ নভেম্বরে প্রকাশ্য দিবালোকে উৎখাত করে গ্রহহীনে পরিণত করলেন।

ঘটনাটি ভয়াবহ এক বর্বরতার। একবিংশ শতাব্দীর এ যাবতকালের সকল নিষ্ঠুরতা যেন ম্লান করে দেয়। এই ১৫০ সাঁওতাল পরিবার সেখানে বহুকাল ধরে বাড়িঘর নির্মাণ করে শান্তিপূর্ণভাবে ভোগ দখল করে আসছিলেন। এঁরাও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের জীবন বাজি রেখে অপরাপর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রণাঙ্গনে লড়াই করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন। এঁরা বাংলাদেশের সমঅধিকারসম্পন্ন নাগরিক।

অতীতে সরকার যখন ঐ এলাকায় একটি চিনিকল প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন তখন স্বভাবতই মিল স্থাপন, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অফিস ও আবাসন নির্মাণ, ইক্ষু উৎপাদন প্রভৃতির জন্য যথেষ্ট জমির প্রয়োজন হলে, সাঁওতালেরা সে জমি দিতে কার্পণ্য করেননি। তখন সরকার জমি অধিগ্রহণের সময় যে সকল শর্ত দেন তাতে এটি ছিল যে, ঐ জমিতে যদি কদাপি আখ চাষ না করা হয় তবে তা ফিরে পাবেন মালিক সাঁওতালরা, সরকার ঐ জমি তাদেরকে ফিরিয়ে দেবেন। এটি ছিল ঐ চুক্তির ৫ নং শর্ত। যা আজ লঙ্ঘিত।

এখন দেখা যাচ্ছে, অতীতে সেখানে আখ চাষ করা হলেও বেশ কিছুদিন যাবত সেখানে তা না করে ধান-পাট প্রভৃতি চুক্তিবাহির্ভূত ফসল বেআইনিভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে। তাই এখানে চুক্তিভঙ্গকারী হল সরকার বা মিল কর্তৃপক্ষ। যখন দাবি করতে করতে হয়রান হয়েও সাঁওতালরা জমি ফেরত পাচ্ছিলেন না তখন তাঁরা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন এলাকার এক তরুণ আওয়ামী লীগারেরর নেতৃত্বে। সেই আন্দোলনের সাফল্যের ফলে তাঁরা ঐ এলাকায় বসতি স্থাপন করে আসছিলেন। একে অবৈধভাবে জমি দখল কোনোক্রমে বলা যাবে না।

অতঃপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি তখন ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দাঁড়ান। আওয়ামী লীগ তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে অপর একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় ও তার অনুকূলে নৌকা প্রতীকও বরাদ্দ করা হয়। তখন ছাত্রলীগ নেতা শাকিল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে নৌকা প্রতীকধারী প্রার্থীকে পরাজিত করে চেয়াম্যান নির্বাচিত হন। ঐ সাঁওতালদের ভোটেই তাঁর বিজয় নিশ্চিত হয়।

পরিহাস, আজ উচ্ছেদ অভিযানের নায়কও এ চেয়ারম্যান শাকিল। তার পেছনে প্রশাসন, মিল-মালিক ও পুলিশ। তারা ৬ নভেম্বর ঐ গরীব সাঁওতাল পরিবারগুলিকে উচ্ছেদ করতে যখন মিলিতভাবে এসে ঘর-দুয়ার ভেঙ্গে ফেলতে প্রবৃত্ত হলে বাধ্য হয়েই আত্মরক্ষার নিমিত্তে তাদের সম্বল তীর ধনুক হাতে তুলে নিলেন সাঁওতালরা। কয়েকজন পুলিশ কর্মী তাতে আহত হন। তখন পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। সে গুলিতে চার জন সাঁওতাল নিহত ও অনেক নর-নারী আহত হন।

আহতদের মধ্যে যাদের অবস্থা ছিল গুরুতর তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ঠিকই, কিন্তু হাসপাতালের বেডে অবস্থানকালেও তাদের কোমরে দড়ি এবং হাতে হাতকড়া লাগিয়ে বর্বরতার চূড়ান্ত নজির স্থাপন করা হয়। পুলিশ থাকে প্রহরায়।

ঘটনা সাংবাদিকদের কল্যাণে ব্যাপকভাবে দেশে-বিদেশে জানাজানি হয়। ছুটে যান বামপন্থী, মধ্যপন্থী নানা রাজনৈতিক দলের নেতারা; মানবাধিকার সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও। তাঁরা ঐ আশ্রয়হীন সাঁওতালদের সঙ্গে সংহতি স্থাপন করে অবিলম্বে তাদের পুনর্বাসনের দাবি জানান। ছুটে যান নানা সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা নিয়ে ফটো সংবাদিকসহ অন্যান্য সংবাদকর্মীরা। সরকারি দলের নেতারও সেখানে যান, সহানুভূতি জানান। তবে এই চেয়ারম্যান বা পুলিশ প্রভৃতির ভূমিকা সম্পর্কে তাঁরা বোধগম্যভাবেই মুখ খোলেননি।

দেখা গেল, সাঁওতালদের বিরুদ্ধে পুলিশ দুতিনটি মামলা দায়ের করেছে ও অনেককে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু চার চার জনকে গুলি করে হত্যা করা সত্বেও পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা শান্তিমূলক বা ডিপার্টমেন্টাল ব্যবস্থাও গৃহীত হয়নি।

অপরপক্ষে কদিন আগে কিছু খাবার-দাবার নিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউএনও, পুলিশ প্রভৃতি গেলে ঐ অভুক্ত দরিদ্র আশ্রয়হীন সাঁওতাল নারীপুরুষ একবাক্যে সরকারি ঐ সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আগে তাদের জমি-জমা ফেরতের দাবি জানান। এই সাহসিকতার জন্য গোবিন্দগঞ্জের আদিবাসী সাঁওতালদের অভিনন্দন জানাই।

সঙ্গে সঙ্গে শাকিল চেয়াম্যান ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও তাদের কর্মকর্তা, প্রশাসন ও অন্যান্য যারাই দায়ী তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে পদচ্যুতি, মোকদ্দমা দায়ের ও গ্রেফতারেরও দাবি জানাই। দেশবাসীর কাছে অতিদ্রুত গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের মুক্তহস্তে সাহায্য দিতে অকাতরে এগিয়ে আসার জন্যও আহ্বান করছি। তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগও জরুরি। আর দরকার হল ক্ষতিপূরণ।

আশা করছি সত্যের জয় অবধারিতভাবেই ঘটবে।

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!